হাতঘড়ি
ঘড়ি নিয়ে কত কথাই তো শোনা যায়। আমাদের নুলা মুসা বাঁহাতে যে হাতঘড়ি পড়ে সেটির মুল্য নাকি চার কোটি টাকা। অবশ্য অনিকের ঘড়ির গল্প নিতান্তই সাদামাটা, আটপৌরে, চাকচিক্যহীন।
বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ পাওয়ার সাফল্যে তার বড় ভাবী একটা ঘড়ি কিনে দিয়েছিল। কালো রংয়ের ক্যাসিও কোম্পানীর ঘডিটি পড়াশোনায় অবদান রাখবে এমনটিই ভেবেছিলেন তিনি। পরবর্তী কয়েকটি বছর এ ঘডিটি তার সার্বক্ষণিক সাথী হয়েছিল। এটি যত না পড়াশোনার কাজে ব্যবহৃত হয়েছিল তার চেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয়েছিল পারুলির সাথে সম্পর্ক টিকিয়ে রাখার ক্ষেত্রে।
বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার প্রথম বছরেই অনিকের সাথে সম্পর্ক হয়েছিল পারুলির। ঘড়ি ধরে ডেটিংয়ে হাজির হতে না পারলে কিংবা টিফিন ব্রেকে পাঁচ মিনিটের মধ্যে ক্যাফেটেরিয়ায় উপস্থিত হতে না পারলে ঠোঁট ফুলিয়ে উল্টোদিকে হাঁটা দিত পারুলি। যে কারণে সকালে উঠে ক্লাসের বইখাতা নিতে ভুল হলেও কালো রংয়ের সে হাতঘড়ি পড়তে কোনোদিন ভুল হয় নি। অবস্থা এমন হয়েছিল যে শুধু গোসলের সময়টুকু ছাড়া তার হাতঘড়ি খোলার কথা মনে থাকত না। মাঝে মাঝে এমনও হয়েছে যে গোসল সেরে আসার পরও হাতঘড়ি কব্জিতেই ছিল। হাতঘড়ি খুললে তার কব্জির চর্তুদিকে একটি হালকা সাদা দাগ সহজেই চোখে পড়ত ।
তৃতীয় বর্ষের শেষের দিকে এসে হাতঘড়িটি নষ্ট হয়ে যায়। সাড়ে তিনশ টাকার ঘড়ির আয়ুষ্কাল এর বেশি হওয়ার কথা নয়। পারুলি অবশ্য অনেকবারই হাতঘডি কিনে দিতে চেয়েছিল, কিন্তু সে তা নেয় নি। এ নিয়ে মাঝে মাঝেই তাদের মাঝে রোমান্টিক কথাবার্তা হতো-
-আর কটা দিন, তারপরই তো বিয়ে। তখন শ্বশুর মশাইয়ের পক্ষ থেকে তাকে একটা হাতঘড়ি না দিয়ে পারবে না।
- তা তো দেবেই, কিন্তু হাতঘড়ি না থাকার কারণে বাকী সময়টা একদিনও দেরি করতে পারবে না।
এমন কঠিন শর্তে রাজি হয়ে পারুলিকে হাতঘড়ি কিনে দেওয়া থেকে বিরত রেখেছিল অনীক।
বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বের হয়ে বেকার অবস্থায় বিয়ে করেছিল তারা। বেকারজনিত আর্থিক সমস্যার কারণেই হলুদ, কবুলসহ সকল আনুষ্ঠানিকতা হয়েছিল একই দিনে। অনুষ্ঠান শেষে মুরুব্বীদের যখন সে সালাম করছিল তখন তার প্রতিবারই মনে হচ্ছিল, হয়তো এখনই তাদের পকেট থেকে বেরিয়ে আসবে ষ্টিল ফ্রেম আর চেইনের কালো ডায়ালের একটি সিকো ফাইভ ঘড়ি,
তখন সেটিই ছিল তার চোখে মহামূল্যবান।
কিন্ত না,
সেদিন কারো পকেট থেকেই এমন চকচকে মহার্ঘ্যবস্তু বেরিয়ে আসে নি। এ নিয়ে মন খারাপ হলেও জীবনে তার সামান্য প্রভাব পড়েনি। বিয়ের পরে তারা নতুন করে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল জীবনযুদ্ধে। বিষয়টি দু'জন ভুলেই গিয়েছিল তখন সময় দেখার জন্য হাতে হাতে উঠে এসেছে মোবাইল ফোন। কিন্তু অনীক বুকে চিনচিনে একটা ব্যথা বয়ে বেরিয়েছ দীর্ঘদিন।
বিয়ের পরে সে আর কখনও সেভাবে হাতঘড়ি পড়েনি। বিভিন্ন উৎসব পার্বণে পারুলি তাকে বেশ দাম দিয়েই ঘড়ি কিনে দেয়, কিন্তু হাতে দাগ বসে যাওয়া ঘড়ি পড়ার সে ইচ্ছে তার আর কখনও হয় নি।
দীর্ঘ ত্রিশ বছর পর সে একটা কাজে গিয়েছিল বিশ্ববিদ্যালয়। পুরনো স্মৃতি খুঁজতে গিয়ে সে ঢুকে পড়েছিল ক্যাফেটেরিয়ায়। টেবিলে সামনাসামনি বসে দুটি তরুণ তরুণী বেশ আবেগ নিয়ে গল্প করছিল। প্রেমিক প্রেমিকাই হবে। পাশের টেবিলের একটা চেয়ারে বসে চায়ের অর্ডার দিয়ে ছেলেটির বাঁহাতের কব্জির দিকে অনীকের দৃষ্টি চলে যায়। ঘড়িটি বারবার খোলা আর পড়ার মাঝেই সে দেখতে পায়, পড়ার স্থানটিতে চর্তুদিকে শ্বেতী রোগীর মতো একটি সাদা দাগ বসে গিয়েছে।
এতদিন পর শ্বেতীরোগী হতে অনীকের খুব ইচ্ছে করছে।
0 কমেন্টস্:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন