ডানা
তারপর একদিন ভোরবেলা ময়নাবৌ আর চন্দনা বাসা ছেড়ে উত্তরের
পাহাড়ের দিকে উড়ান দিলো। চন্দনার ডানায় তখনো লেগে আছে আগের দিনের গায়ে হলুদের হলদে আভা। সূর্যের ঠিক উল্টোদিকে উড়তে
উড়তে ওরা দুজন দুজনের দিকে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে রইল সারাটা দিন। আজ ওদের ডানায় ব্যথা
করছে না,
পালকে তাপ লাগছে না, ধুলোয় চোখ কড়কড় করছে না, গলা শুকিয়ে
কাঠ হয়নি, এমনকি ভোর থেকে লাগাতার ওড়ার নেশায়
ক্ষিদেও ভুলে গেছে। লাল ফলওয়ালা বট গাছ চলে গেল, টুসটুসে পাকা পেয়ারা ভরা গাছ, সাদা জামরুল... ওরা তাকিয়েও দেখল না, আজ শুধু ওড়া আর ওড়া।
বিকেল নাগাদ ওরা পৌঁছলো উত্তরের পাহাড়ে। এক ঝর্ণার
সামনের আপেল গাছে ওরা রাত কাটিয়ে সকালে এই
লম্বা লম্বা হাতিঘাসে সবুজ ঘর বাঁধল। উত্তরের পাহাড়ে এতটুকু গরম নেই, সারাদিন ঠান্ডা হাওয়া বয়। দূরের চুড়ো আধখানা কুলফিমালাই-এর মতো
সাদা, সেখানে রুপোর মতো
আলো ঠিকরোয়, আপেল গাছে লাল টুকটুকে আপেল ঝোলে। ময়নাবৌ গান গায়, চন্দনা লাল ঠোঁটে শিস বাজায়। ওদের সুর ছড়িয়ে যায় পাহাড় থেকে
পাহাড়ে,
উপত্যকা, ঝুম চাষের
ক্ষেতে,
বনের গহীনে। ওরা রোজ
রোজ নতুন করে ঘর বাঁধে তাজা হাতি ঘাসে।
ওদের সবুজ বাসা বাসি হতে দেয় না।
শেষমেশ শীত আসে, আপেল ফুরোয়, চন্দনা আর ময়নাবৌকে উড়তে হয় খাবারের খোঁজে। পাহাড়ের অন্য পাখ-পাখালিদের চলে
কানাঘুষো;
তোমরা কে গো! ভিনদেশি, জাত বেরাদরের ঠিক নেই, আলাদা বাসা
বেঁধেছো অথচ দুজনই মেয়ে পাখি! উহু, দু’ বোনও নও, মা আর ছা তো
মোটেই নও... সবাই নিজের মতো করে অকারণ সম্পর্ক বানিয়ে আকাশে ওড়ায়।
চন্দনা আর শিস বাজায় না, ময়নাবৌ-এর গান ফুরিয়ে গেছে, কতদিন বাসা
বদলায়নি ওরা, সবুজ ঘাস হলুদ হতে হয়ে
বিবর্ণ। এখন শুধু রাত নামলে পাশাপাশি থাকা। খুব শীতে দুজনে গা ঘেঁষাঘেঁষি করে
ঘুমিয়ে ওম নেয়, সেটুকু বেঁচে থাকার প্রয়োজনে।
একদিন ময়নাবৌ সন্ধ্যেবেলা চন্দনার পালকের ধুলো ঝেড়ে, গলার লাল পালকে মুখ ডুবিয়ে বলে, চল আবার গান
গাই শিস বাজাই। চন্দনার চোখে এক আকাশ ক্লান্তি, ওদের গান জমে না, সুর কেটে যায়, শিস বেসুরো, সুর লয় তাল সব কেটে যায়।
সেদিন প্রথম আপেল গাছে ফুল ফোটে। সকালে ঘুম ভেঙে চন্দনা দেখে পাশের চিনার গাছের পাতা লাল। একজোড়া রঙিন
পাখি গান গাইছে। চন্দনার মনে পরে ওর গায়ে
হলুদ হয়েছিল। তিন ক্রোশ দূরের বট গাছের কোটরে পূর্ণিমারাতে ওদের বিয়ের উৎসব ঠিক ছিল।
দুদিন বাদে ময়নাবৌ উড়তে উড়তে দেখে এক মা পাখি তার বাসায় বসে
ডিমে তা দিচ্ছে, চোখে সুখের ক্লান্তির ছাপ।
ময়নাবৌ-এর ফেলে আসা ছানাদের জন্যে মন কেমন করে, কে জানে বাছারা উড়তে শিখেছে কি না!
চোখের কোণ ভিজে ওঠে ময়নাবৌ-এর, ঠোঁট থেকে
বুনোফল খসে পড়ে।
দুজনের কথা বন্ধ অনেক দিন। ওরা আবার ঘর ছেড়ে উলটো উড়ান দেয়
সূর্যের দিকে। এবারে ওদের ডানায় একরাশ ক্লান্তি।
ধীরে ধীরে পৌঁছয় ওদের চেনা গ্রামে। চন্দনা এই গ্রামের মেয়ে, ময়নাবৌ এই গ্রামে নোলক পরে বৌ সেজে এসেছিল একদিন। গ্রামের
সীমানায় পৌঁছতেই রে রে করে ধেয়ে আসে কাক চিল শকুনের দল, ঠুকরে রক্ত বের করে দেয়। ক্লান্ত ডানায় ওরা বেশিদূর পালাতে
পারে না। নদীর ধারের অশত্থ গাছের নীচে
দুটো ছিন্নভিন্ন দেহ পড়ে থাকে। পাকুড় গাছের কোটরের চন্দনা চিনতে পারে না তার ঘর পালানো হবু বৌকে।
কচি কচি একরত্তি ময়নার ছানাগুলো নিজেরাই আকাশে চক্কর মেরে একে অপরকে দেখায়, দেখ
ভাই দেখ ভা্ আবার দুটো বে-ঘরে পাখি মারা গেছে!
0 কমেন্টস্:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন