জায়েন্ট হুইল
গভীর দুলুনি, বাবা! প্রবল দুলুনি।
সেই যেদিন ইলেকট্রিক নাগরদোলায় আমাকে চাপিয়ে তুমি নিচে অপেক্ষায়, তোমার মাস ফুরোনোর খালি জেব তোমাকে বাড়তি শখ পালন করতে দিল না, তাই কেবল একটাই টিকিট কাটা গেল! তাই, তুমি রইলে নিচে আর আমি একা পা বাড়ালাম নৈঋতে। সে তুমি কী করবে বলো -- তুমি ঐ গোলকদোলায় আমাকে বসিয়ে অস্থির পদক্ষেপে এদিক ওদিক! তোমার আঙুলের ফাঁকে সিগারেট ধিমধিম পুড়তে লাগলো একা। আমি একটু একটু করে উঠতে লাগলাম । আমার উত্তেজনায় একটুখানি ভয়, আমার রোমাঞ্চে কিয়ৎ বুক ধুকপুক তখনও মিশে ছিল। তাই ঘন ঘন তোমাকে দেখছিলাম। তখনও হাত বাড়ালেই তোমার চশমাটা ছুঁয়ে দিতে পারি,
তখনও লাফ মেরে সেই দানবদোলক থেকে মাটি ছোঁয়া যেত। অথচ সে আমাকে নিয়ে উঠতে লাগলো ওপরে, তুমি অসহায় হাত নাড়তে লাগলে স্কুলের গেটে দাঁড়িয়ে যেমন করে হাত নেড়েছো আজীবন। সেই জোনাকি জ্বলা তারাগুলির খুব নিকটবর্তী হওয়ার উত্তাল আনন্দে আকাশ দেখতে গিয়ে তোমার দিকে ফিরে তাকালাম না তখন।
একসময়, উঠতে উঠতে, চড়তে চড়তে, তোমার নাগালের বাইরে চলে গেলাম বাবা। হাত পাতাতে বৃষ্টি ফোঁটায় ইচ্ছেরা আলপনা আঁকতে লাগলো। তুমি আর সাবধানী হয়ে বললে না -- বুবুন, অল্প ভিজো মা,
ঠাণ্ডা লাগবে যে! মেলার মাঠটি ধুলোর আবরণে চুপ করে ছিল।
সবকটি আলো অস্থির দপদপানি অথবা অবৈধ কানেকশনের জটিল তারগুলিকে লোপাট করে দিয়ে স্থির হলো, যেন যুগান্তের কোনো নক্ষত্র ।
ধীরে ধীরে গতি বাড়াচ্ছে জায়েন্ট হুইল, আমার ভিতরে হাউই উড়ছে সোঁ সোঁ। একবার সেই প্রৌঢ় যেন ডেকে বলেছিল -- খুকু একা ভয় পাবি বাবা! নেমে আয়!
কী যে কম জানা পৃথিবী তোমার বাবা! একবার উঠতে থাকলে নিজের থেকে যে নামা যায় না, সে তুমি কি জানবে? যার জীবন একটি স্থির মফস্বলী ডোবা, বিকেল হলে যে বুকের কাছে বড় জোর মশারা যুথবদ্ধ গান ধরে রাখে,
তার কাছে এই রাক্ষুসে চাকার চড়নদার নেশা না ছোঁয়াই থাকবে। অথবা, লোভ একটু তোমারও কি ছিল বাবা?
আমাকে অনন্ত উঁচুতে দেখার লোভ?
আমি যে ক্ষণে মাঝ শূন্যে পৌঁছেছি, একটু ঝুঁকে নিচের দিকে তাকালাম। সেই মদির মেলাটি নিটোল কাঁচপোকা টিপ হয়ে মস্ত ব্রহ্মাণ্ডে আটকে আছে। আমি আলাদা করতে পারছি না, জল দানবী আর জোড়া মেয়ের তাঁবু, আচার - কাসুন্দী আর কেষ্টনগরের মৃন্ময়শিল্প ।
এবং তুমি?
কোথায় তুমি?
তোমার হাতের জ্বলজ্বলা সিগারেট। তোমার অস্থির চোখ?
অসহায় জেব।
জায়েন্ট হুইল আচমকা প্রবল দোলায় দুলিয়ে হু হু করে তারাদের দিকে ছুটতে লাগলো। জ্যাকের সীমের বীচি থেকে যেমন আকাশফোঁড়া গাছ, সেই উন্মত্তপ্রায় ওপরচড়ায় প্রবল দোলাচলে আমি একটা ঘামে ভেজা জ্যাবজ্যাবে পাঞ্জাবীর পিঠ খামচে ধরতে গিয়ে দেখি, এত উঁচুতে ঘাম নেই,
আঁৎকে ওঠার পরে আশ্বাস নেই,
ধরার কোনো দেওয়াল বস্তুত নিরেট শূন্য । তারাগুলো যে শুধুমাত্র দহক্ষম, তারা জোনাকির মতো ভালোবাসাবাসির আলো শরীর দিয়ে বহন করে না, এ সব আমি জানতাম না।
তুমিও কি জানতে না! আমার ওড়ার স্বপ্ন কি তোমারও মোতিবিন্দু চোখের আবছায়া স্বপ্ন ছিল না ? যখন রেস্তে কুলোয় নি, কেন তবে আমাকে একা নাগরদোলায় বসিয়ে দিলে বাবা?
আমি দুলতে দুলতে হাত ফস্কে, কখনো মুঠিতে হাওয়া ভরে উপরে উঠতে
লাগলাম ক্রমাগত। তারপর হঠাৎ মেশিন বিকল হয়ে যেতে থেমে গেলাম মহাশূন্যে। তারাগুলো অগ্নিগোলক হয়ে আমাকে ছোবল মারবে কি
মারবে না ভাবছিল। এত উঁচুতে কেউ খুব জোরে
হাসে না,
বড় জোর অপরের বিপদে চাপা শ্বাস ফেলে। এখন এই মুহূর্ত মধ্যের
স্থির শূন্যতায় তোমাকে দেখতে ইচ্ছে করে বাবা।
আমার ফিল ইন দ্য ব্ল্যাঙকের বাড়ির কাজ, আমার অল্প আইকিউ, আমার না শেখা
গণিতের ফর্মুলা আমাকে এই মাঝশূন্যে ঝুলিয়ে রেখে দিল। তোমাকে দরকার, খুব দরকার যে এখন! তুমি কি বাড়ি চলে গেলে ঐ অনন্ত অন্ধকারে আর কখনো আমাকে পাবে না জেনে?
তুমি কি ভাবলে আর কিছু টাকার জোগাড় হলেই ওরা মেনে নেবে সব আর আমাকে ছেড়ে দেবে আমার নিজের পৃথিবীতে?
এমন আর হবে না কখনো।
আমি আগে জানলে ইলেক্ট্রিক হুইলে চড়বার বায়না করতাম না বাবা!
তুমিও কি জানতে না কিছুই?
0 কমেন্টস্:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন