কালিমাটি অনলাইন

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

বৃহস্পতিবার, ২৩ মার্চ, ২০১৭

সুমনা পাল ভট্টাচার্য

রক্তের মুখোমুখি





ট্রেন আসতে এখনও খানিক দেরী ওয়েটিং রুমে বসে ম্যাগাজিনের পাতা ওল্টাচ্ছি পাশে বসে থাকা বছর আশির বৃদ্ধটি হঠাৎই গুনগুন করে উঠলেন আমার খুব চেনা সুর
নাই বা হল মিলন মোদের...
গুনগুন করছেন এক কলি, আর আপন মনেই বলে চলেছেন, “আহাকী সব কথা, এই সুর... কোথায় এখন, আহা আহা...” 

আমি আর থাকতে পারলাম না, বৃদ্ধ ভদ্রলোকটির দিকে তাকিয়ে জিগ্যেস করলাম, “নমস্কার জ্যেঠু, আপনি এই গানটি জানেন?”
ভদ্রলোক আমায় বেশ আপাদমস্তক মেপে খুকি বলে কি হেন একটা ভাব দেখিয়ে বললেন, “তোমরা চেনো এসব শিল্পী কে? শুনেছো নাম? এটা কার গান জানো? ইনি আমার শৈশব আর কৈশোর জুড়ে আছেন, বুঝলে মা? গান সে যুগের বিখ্যাত শিল্পী শ্রী গৌরীকেদার ভট্টাচার্যের আমার বাড়িতে এনার গানকে পুজো করা হত, বুঝলে মা! বাবাকে দেখতাম, কী অসম্ভব তাগিদের সাথে শিল্পীর সব রেকর্ড সংগ্রহ করতেন আহা! কি কথা, গলার কি রেঞ্জ... ‘নাই বা হল মিলন মোদের, এই জীবনে তোমায় আমি ভুলব না গো, তোমার  কথাই রইবে মনে’
কত গভীর অনুভবআছে, তোমাদের এখনকার গানে?

যেন একমুঠো চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেওয়ার ভঙ্গিতেই গড়গড়িয়ে বলে গেলেন তিনি  কথাগুলো এক নি:শ্বাসে আবেগে, উত্তেজনায় তাঁর ঘোলেটে চোখ ছলছল করছে
আমার কী মনে হল, কে জানে! ভদ্রলোককে একটা প্রণাম করলাম, তারপর তাঁর দিকে চেয়ে বললাম, “উনি আমার ঠাকুরদাআজ আপনি আমায় অনেক কিছু দিলেন জ্যেঠু...
এক নিমেষে ভদ্রলোকের চোখ মুখ বদলে গেল আমার দুটি হাত নিজের কাঁপা মুঠোয় চেপে ধরলেন, তারপর বললেন, “হে ভগবান, সৌভাগ্যও আমার হওয়ার  ছিল? তোমার ঠাকুরদা, তুমি তার আত্মার জন, তুমি তার উত্তরসূরি... ওহ, আর আমি তোমাকেই বলছি তাঁর কথা? তার মানে তুমিও নিশ্চয় খুব ভালো গান করো, তাই তো?
আমি হেসে বললাম, “না জ্যেঠু ওই আর কি, তেমন কিছু নয়”
এবার বেশ ক্ষিপ্র স্বরে ব্যস্ত হয়ে তিনি বললেন, “তা তো বললে চলবে না, ধারা তো তোমরাই বহন করে নিয়ে যাবে...
আমি খুব লজ্জার সাথে মাথা নাড়লাম
সত্যিই তো, দাদুর সম্পর্কে আজ যতটুকু জানি, তা কাগজ পড়ে, তথ্যচিত্র দেখেকিছু মানুষের মুখ থেকে শুনে...

কিছুদিন আগেই রবীন্দ্রসদনে দাদুকে নিয়ে হয়ে গেছে এক বিচিত্র সঙ্গীত সন্ধ্যা দাদুর জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে বর্তমান প্রজন্মের প্রথিতযশা শিল্পীরা গেয়েছিলেন  দাদুর বিভিন্ন গান জানিয়েছিলেন তাঁদের শ্রদ্ধাঞ্জলি

আমার ব্যাগ হাতড়ে পেলাম, দাদুর সঙ্গীতজীবন সম্পর্কে প্রকাশিত একটি ছোট লেখনী, যা সেদিন তুলে দেওয়া হয়েছিল প্রত্যেক শ্রোতা দর্শকের হাতে এবং নতুন করে এইচ এম ভি মিউজিকন-এর সাহায্যে দাদুর গানগুলিকে সংকলিত করা  সিডি টি সেই দুটোই তুলে দিলাম তাঁর হাতে
ট্রেন এসেছে উঠতে হবে “ভাল থাকবেন জ্যেঠু...
ভদ্রলোক তখন আবেগে বিহ্বল
তাঁরঠিকানা, ফোননম্বর সব ধরিয়ে দিলেন আমায় বললেন, “একদিন আসবে তো,  মা? সেদিন কিন্তু দাদুর অনেক গান শুনবো তোমার গলায়!” বললাম, “হ্যাঁনিশ্চয়ই জ্যেঠু”
তিনি দু’হাত তুলে আশীর্বাদ করছেন, আর আমি পথে অনন্ত যাত্রার অঙ্গীকার নিয়ে  এগোচ্ছি সম্মুখে

দাদুর জন্ম চট্টগ্রামের পরৈকোড়া গ্রামে পিতা কবিরাজ অপর্ণাচরণ ভট্টাচার্য্য মাতা বাসন্তী দেবী পেশাগত কারণে বাবা চলে আসেন বারাণসীতে ছোটবেলায় মাত্র তিন বছর গান শেখার সুযোগ পেয়েছিলেন বারাণসীর বিশিষ্ট ধ্রুপদাচার্য হরিনারায়ণ মুখোপাধ্যায়ের কাছে এরপরই কবিরাজ অপর্ণাচরণ তাঁর জ্যেষ্ঠ পুত্রকে পাঠিয়ে দেন কলকাতায় বিদ্যাশিক্ষার জন্য স্থান পরিবর্তন বা পড়াশোনা কোনোটাই তাঁকে সংগীত থেকে দূরে রাখতে পারেনি গান শুনে মুগ্ধ অনুপম ঘটক  গৌরীকেদারকে যোগাযোগ করিয়ে দেন হিন্দুস্থান রেকর্ড কোম্পানীর সঙ্গে ফেব্রুয়ারি ১৯৩৭ প্রকাশিত হয় তাঁর প্রথম রেকর্ড“সুরের ধারায় স্নান করাবো”;  গীতিকার নরেশ্বর ভট্টাচার্য সুরকার গোকুল মুখোপাধ্যায় বছরেরই ডিসেম্বর মাসে শিল্পী রেকর্ড করেন আরও দুটি বাংলা ইসলামী গান, ‘উঠেছে দীনের রবি  ‘নবীন মদিনায় জানাইতে ব্যথা’; কথা: আর. সুলতান সুর অনুপম ঘটক অবশ্য  বলে রাখি, এর বহু আগেই ১৯৩৩ সালে তিনি রেডিওতে গান গাইবার সুযোগ পেয়েছিলেন সম্ভবত গৌরীকেদারই একমাত্র শিল্পী যিনি একই সঙ্গে তিনটি নামে রেকর্ড করতেন স্বনামে বাংলা আধুনিক গান, ‘গোলাম কাদেরনামে গজল, ইসলামী গান বাংলা কাওয়ালি এবংসুকুমার ভট্টাচার্যনামে পল্লীগীতি
১৯৪১এর মে মাস প্রণব রায়ের কথায় সুকৃতি সেনের সুরে তাঁর সুপার ডুপার হিট রেকর্ড  কতদিন, কতদিন তুমি কাছে নাইএরপর থেকেই গ্রামাফোন কোম্পানি তাঁকে রয়ালটি দেওয়া শুরু করে

আগষ্ট ১৯৪১ চিত্রশিল্পী অমূল্যকুমার মুখোপাধ্যায় পন্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের দৌহিত্রীর একমাত্র কন্যা ষোড়শী শেফালীর সঙ্গে শিল্পী পরিণয় সূত্রে আবদ্ধ হন শিল্পীর জনপ্রিয়তার পালে যেন উজান হাওয়া লাগল বিবাহের পরে কখনও শৈলেন রায়ের কথা ও কমল দাশগুপ্তের সুর, কখনও বা মোহিনী চৌধুরীর কথা ও চিত্ত রায় বা দূর্গা সেনের সুর, বা প্রণব রায়ের কথা ও সুবল দাশগুপ্তের সুর এভাবে একটার পর একটা সুপারহিট গান তিনি উপহার দিয়ে গেছেন

গৌরীকেদার জনপ্রিয়তার শীর্ষে পৌঁছেছিলেন বিরহের গানে শৈলেশ দত্তগুপ্তের সুরে আর মোহিনী চৌধুরীর কথায়নাই বা হল মিলন মোদেরবাএনেছি আমার শতজনমের প্রেমবা শৈলেন রায়ের কথায় আর কমল দাশগুপ্তের সুরেনিও না গো অপরাধবা অরূপ ভট্টাচার্যের কথায় ও শৈলেশ দত্তগুপ্তের সুরেসমাধিতে মোর ফুল ছড়াতে কে গো এলে - গানগুলির আকুল আর্তি শ্রোতা-হৃদয়কে ছুঁয়ে গেছে বারবার

১৯৪৫ সালে শিল্পী হলেন গ্রামাফোন কোম্পানির এক্সক্লুসিভ আর্টিস্ট পরিস্থিতি  প্রয়োজন অনুযায়ী শিল্পী গেয়েছেন বিভিন্ন গান তারই কিছু নমুনাদেশ স্বাধীন হল, শিল্পী গাইলেন, ‘বল ভাই মাভৈ মাভৈ, নবযুগ এলো বা দূর্গা সেনের সুরেজিন্দাবাদ জিন্দাবাদ হিন্দুস্তান প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠা হল, শিল্পী গাইলেন, ‘চক্রশোভিত  তিনরঙা জাতীয় পতাকাখানি, মানুষের মাঝে করিবে প্রচার সুখশান্তির বাণী
দেশভাগের ফলস্বরূপ হাজার হাজার উদ্বাস্তু যখন বাঁধভাঙা বন্যার মতো এদেশে  আসছে, তখন মরমী শিল্পী তাঁর দরদী কণ্ঠে গেয়ে উঠলেন, ‘আমি এক বাস্তুহারা ভাই, আমি স্বদেশে বিদেশী হইলাম, দেশ বলিতে নাই রে আমার দেশ বলিতে নাই সুভাষচন্দ্র নিখোঁজ গৌরীকেদার গাইলেন, ‘বিপ্লবী নেতা হে বীর সুভাষ তুমি তো এলে না ফিরে

শিল্পীর বিস্তার ছিল বিভিন্ন গানে উর্দু গজল, হিন্দি ভজন, ভাটিয়ালি, শ্যামাসঙ্গীত, আধুনিক, ইসলামী গান, বাংলা কাওয়ালি, পল্লীগীতি এরকম নানাবিধ গানে তিনি  ছিলেন স্বমহিমায় উজ্জ্বল ভাস্বর বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ . যতীন্দ্রবিমল চৌধুরী . রমা চৌধুরীর অনুরোধে বেশ কিছু সংস্কৃত গানে নাটকে সুর দিয়েছিলেন শিল্পীর সুর করা গান নিজেদের কণ্ঠে তুলে নিতে তাঁর কাছে আসতেন . ধ্যানেশনারায়ণ চক্রবর্তী, সত্যেশ্বর মুখার্জী, শিশির ভট্টাচার্য (শিবানন্দ গিরি) প্রমুখ বিশিষ্টজন ভারত সেবাশ্রম সংঘের স্বামী বিজয়ানন্দ শিল্পীর কাছে আসতেন গান শিখতে তাঁর একান্ত অনুরোধেই শিল্পী বেশ কিছু সঙ্ঘগীতির স্বরলিপিও করে দিয়েছিলেন

হেন বহুল গুণের আধার প্রণম্য গৌরীকেদার হঠাৎ রেকর্ড করা বন্ধ করে দেন জনপ্রিয়তার শীর্ষে থাকাকালীন জলসাতেও আর গাইতেন না ২৩ শে এপ্রিল ১৯৭৪ সাল তিনি সংসার ত্যাগ করে সন্ন্যাস গ্রহণ করেন; নাম গ্রহণ করেন মোহন্ত  চন্দ্রশেখর গিরি শেষজীবনটা সন্তানদের অনুরোধে তিনি গৃহী সন্ন্যাসী রূপে সংসারেই কাটান ১৯৮৩ সালের ৪ঠা ফেব্রুয়ারি এই মহাপ্রাণ সংগীতসাধক দূরারোগ্য ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে রামকৃষ্ণ মিশন সেবায়তনে শেষ নি:শ্বাস ত্যাগ করেন

ট্রেন ছুটছে দ্রুত গতিতে ছন্দ, সুরে তালমগ্ন চেতনায় আমি বুঁদ হয়ে আছি রক্তের গন্ধে নিজের আনমনেই গুনগুনিয়ে উঠছি দাদুর গানের কলিচোখের সামনে ভেসে উঠছে শ্রদ্ধায় নিমজ্জিত বৃদ্ধ ভদ্রলোকটির দুটি বাঙ্ময় চোখ

মনে মনে যে কতবার তানপুরার গায়ের ধূলো ঝেড়ে ফেললাম, সে কেবল জানলাম আমি আর আমার রক্ত

1 কমেন্টস্: