মনের ভেতর বসত করে কয়জনা
কখনও পুরনো বন্ধুর সঙ্গে দেখা হলে, হয়ত অনেক কথা বলা হল। কিন্তু পরে দেখলাম, সেই বন্ধুটির নাম আর কিছুতেই মনে পড়ছে না। এত যে পুরনো স্মৃতি
নিয়ে আলোড়ন তুললাম দুজনে, ভাল লাগায়
ভরে রইলাম কিছুক্ষণ, কিন্তু সেই পুরনো সঙ্গীর নাম মনে পড়ল না
বলে কোথায় যেন একটা কাঁটা খচখচ করতে লাগল। আর লজ্জায় মুখ ফুটে নাম
জিজ্ঞেস করতেও পারলাম না। আবার হয়ত চেনা কেউ, মানে তার নাম বিলক্ষণ জানি, দেখা গেল কোনো অমুকের কথা আমাকে বলছে, আমি সেই অমুকের মুখটা ভাবার চেষ্টা করছি, কত রকম রূপ
দিচ্ছি, তবুও চেহারাটা ধরতে পারছি
না। হয়ত তাকে একবার দেখলেই
চিনতে পারব, হয়ত তখন আবার তার নাম মনে পড়বে না... এই রকম বিভ্রান্তি নিয়ে আমি থাকি প্রায়ই। অথচ অনেক পুরনো স্মৃতিই আমার মনে টাটকা ধরা পড়ে। শুধু নামের ব্যাপারেই এমন হয়। এও হয়ত এক ডিসঅর্ডার। সে যাইহোক, নামের
ফেরে আরও অনেক ক্ষেত্রেই পড়ি। যেমন শিরোনাম নিয়ে আমি
প্রায়শই দ্বিধায় থাকি। কিছু লিখে তার শিরোনাম
দেওয়াটা আমার কাছে এক মহা ঝক্কির ব্যাপার। তাই সম্পাদকের হাতেই এই ঝামেলার কাজটা গছিয়ে দিই। মনে আছে, সেই কোনো এক কালে বই করার
সময়েও নাম দিতে পারি নি। নামে আসলে কিছু যায় আসে না। নাকি যায় আসে? কী জানি!
নাম ভুলে যাওয়া একটি ডিসঅর্ডার অবশ্যই। একে বলে
নমিনাল অ্যাফাসিয়া। আমাদের মস্তিষ্কের ভেতরে স্মৃতি সঞ্চয়ের জন্য তিনটে ব্যবস্থা
রয়েছে। প্রথমে স্মৃতি সঞ্চিত হয় সেনসরি মেমরিতে। এখানে এই স্মৃতি মাত্র তিরিশ
সেকেন্ড থাকে। এরপর এরা চলে যায় শর্ট টার্ম মেমরিতে। সেখানে স্মৃতি অল্প সময় থাকে।
যেন একটা ওয়েটিং রুম এই শর্ট টার্ম মেমরিটি। এরপর এরা পাকাপাকি ভাবে চলে যায়
নিজেদের বাড়িতে অর্থাৎ লং টার্ম মেমরিতে। স্মৃতিভ্রংশ মানুষ যেমন নিজের বাড়ির
ঠিকানা মনে করতে পারে না আর নিখোঁজ হয়ে যায়, আমাদের মস্তিষ্কের কিছু স্মৃতিও তেমনি
ভাবে লং টার্ম মেমরিতে যেতে ভুলে যায়। যারা নাম ভুলে যায়, তাদের ক্ষেত্রে এটাই
ঘটে। দীর্ঘদিন বাদে তারা আর পরিচিত মানুষের নাম মনে আনতে পারে না। তবে এই ডিসঅর্ডার
মারাত্মক কিছু ব্যাধি না, কারণ রোগটির নামেই তার উল্লেখ রয়েছে। কমন অ্যাফাসিয়া
সত্যিই কিন্তু খুব কমন।
এইসব কমন ব্যাপার স্যাপারের
বাইরে অনেক অনেক আনকমন প্রশ্ন আসে কিন্তু পরীক্ষায়! তখনই আমরা যারা কমন পিপল তাদের
ধাঁধা লেগে যায়। মানে ধরুন গিয়ে প্রশ্নটা হয়ত খুব শক্ত না, কিন্তু একটু পেঁচিয়ে
গেছে ডানদিকে, আর বাঁদিকে একটু বেঁকে
গেছে। আর তার মাঝখানে পড়ে আমরা আকূল পাথার দেখছি চোখে। ধরাযাক একজন গুরুগম্ভীর
ব্যক্তি, যাঁকে সবাই শ্রদ্ধার চোখে, সম্ভ্রমের চোখে, কিছুটা ভয়ের চোখেও দেখে,
তাঁকে যদি কোনোদিন বিকেলে ছাদে উঠে লেবু লজেন্স খেতে বা কিতকিত খেলতে দেখা যায়, তাহলে নিশ্চই আমরা
ধরে নেব ওঁর মাথার গন্ডগোল হয়েছে। যাঁর যেমন ব্যক্তিত্ব, তার বাইরের কাজটি তিনি
যদি করে ফেলেন, আমাদের তা মানতে অসুবিধে হয়। আসলে ওই আদি, অকৃত্রিম শিশুটি সেই গম্ভীর
মানুষটির মধ্যে ছিলই। হঠাৎই তার প্রকাশে আমাদের অস্বস্তি বেড়েছে। একটি মানুষের মধ্যে অনেক সত্ত্বা থেকেই যায়। আমরা তো
মিস্টার জ্যাকল অ্যান্ড হাইডের গল্প শুনেছি। বাস্তবেও কি তেমন চরিত্র নেই? অবিকল
না হলেও কিছুটা কাছাকাছি? একেকটি মানুষের মধ্যে লুকিয়ে থাকে এক বা একাধিক চরিত্র।
সেই চরিত্রগুলো যখন প্রকট হয়ে ফুটে ওঠে কারুর আচার ব্যবহারে, তখনই হয় সমস্যার
শুরু। সমস্যা তার না, আমাদের। আমরা তার কোন চরিত্রটি খাঁটি, তা ভাবতে গিয়ে
বিভ্রান্ত হই। প্রকৃতপক্ষে এই মানুষরা এক বা একাধিক চরিত্রের মধ্যে নিজেদের মিশিয়ে
দেয়। তার ফলে আমরা তাদের স্বাভাবিক বা সুস্থ মানতে পারি না। অবশ্যই এটিও একটি
মেন্টাল ডিসঅর্ডার। আর একে কমন বলা যাবে না কিছুতেই। বেশ জটিল এই অসুখ। সাধারণত
স্প্লিট পার্সোনালিটি নামেই এই অসুখকে আমরা চিনি। ডাক্তারি ভাষায় ডিসোসিয়েটিভ
আইডেন্টিটি ডিসঅর্ডার বা ডিআইডি এই অসুখের নাম। আগে অবশ্য মাল্টিপল পার্সোনালিটি
ডিসঅর্ডার বা এমপিডি বলা হত একে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দেখা যায়, ছোটবেলার কোনো আকস্মিক আঘাত থেকে এই সমস্যার সূত্রপাত হয়।
কিন্তু কেমন ধরনের দেখতে হয় এই রোগ? এই
রুগীরা কি ‘পাগল’? একটু জানার চেষ্টা করি বরং...
‘কমন’ শব্দটাকে ইচ্ছে করলেও এড়িয়ে যাওয়া যায় না। যেমন এড়ানো যায় না কমন
ম্যানদের, কমন প্রবলেমদের। ডিআইডির মতো বিতর্কিত এক অসুখকেও আমরা কিছু কমন ছকে বেঁধে ফেলতে চেয়েছি। সাতটি
‘কমন’ চরিত্রর রূপ আছে এই ‘আনকমন’ ডিআইডির।
১) ডিআইডি খুব অপ্রচলিত একটি ঘটনা, এরকম বলা হয়ে থাকে এবং মাত্র ১% থেকে ৩% মানুষের এই রোগ হতে দেখা গেছে। কমন
বাইপোলার ডিসঅর্ডার বা স্কিজোফ্রেনিয়ার মতো অসুখের উৎপত্তি স্থল বলা যেতে পারে এই
ডিআইডিকে। যদিও রিসার্চের ফলে উঠে আসা এই
তথ্য যে কতদূর সঠিক, তা নিয়ে সন্দেহর অবকাশ রয়েছে। আজ অবধি ন্যাশনাল ইন্সটিউট অফ
মেন্টাল হেলথ ডিআইডি নিয়ে একটিও চিকিৎসা সংক্রান্ত রিপোর্ট লিখে উঠতে পারে নি।
২) সাধারণত টিভি বা সিনেমায় ডিআইডি আক্রান্তদের নিয়ে যেসব ঘটনা বা তথ্য
পাওয়া যায়, তার বেশিরভাগই অতিরঞ্জিত। ডিআইডি আক্রান্তদের সঠিক রোগনির্ণয় করাটাই হল
আসল সমস্যা। হতাশা, পোস্টট্রমাটিক স্ট্রেস ডিসঅর্ডার , ইটিং ডিসঅর্ডার – এই ধরনের
চিকিৎসার জেরে এদের সত্যিকারের ক্রাইসিসটাই অধরা থেকে যায়। এমনও দেখা গেছে এই
পরিস্থিতি ধরা পড়তে প্রায় সাত বছর লেগে গেছে!
৩) এটা সম্পূর্ণ ভুল ধারণা যে, ডিআইডি আক্রান্তদের বিভিন্ন রকম চরিত্র
থাকে। বরং এদের বিভিন্ন রকমের চরিত্রের দশা (স্টেট)-র মধ্যে অবস্থান থাকে। আমাদের
অর্থাৎ সাধারণ মানুষেরও যেমন বিভিন্ন রকম সত্ত্বা থাকে কিছুদূর পর্যন্ত, এরা
কিন্তু এই বিভিন্ন সত্ত্বার মধ্যে যখন অবস্থান করে, তখন এরা প্রত্যেক পর্যায়ে কি
বলছে বা কি করছে, নিজেরাও মনে রাখতে পারে না। বিভিন্ন সত্ত্বায় এরা সম্পূর্ণ আলাদা
আলাদা ক্রিয়াকর্ম করে থাকে। যদিও খুব সূক্ষ্মভাবে দেখলে বোঝা যায়, সমস্ত
সত্ত্বাগুলোর মধ্যে কোথাও না কোথাও একটা মিল রয়ে গেছে।
৪) সমালোচকরা বলেন যে ডিআইডির রুগীদের চিকিৎসা করলে নাকি আরও মুশকিল! অবশ্য
এমন মনে করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। বেশিরভাগ সময়ে দেখা যায়, থেরাপিস্টরা ভুল বা
পুরনো ধরনের পদ্ধতি ব্যবহার করেন। যদিও ইন্টারন্যাশনাল
স্টাডি অফ ট্রমা অ্যান্ড ডিসোসিয়েশন তাদের নিজস্ব হোমপেজে এই চিকিৎসার সম্পূর্ণ
গাইডলাইন দিয়েছে।
৫) থেরাপিস্টরা প্রায়শই এই রুগীদের বিভিন্ন মানসিক দশার মধ্যে
সমন্বয় রাখার চেষ্টা করেন। তাঁরা রুগীদের শেখান কীভাবে তাদের অনুভূতি, উদ্দীপনা,
স্মৃতিকে নিয়ন্ত্রণ করতে হয়। এটা অবশ্যই জরুরী, কারণ কখনও কখনও দেখা যায় রুগীরা
নিজের নিজস্ব দশাকে অতিক্রম করে তীব্র কোনো স্মৃতি যেমন ভয় বা রাগ ইত্যাদির মধ্যে ঢুকে পড়ছে। রুগীদের বিভিন্ন
মানসিক দশাকে একত্রিত করে দেওয়াই একজন অভিজ্ঞ থেরাপিস্টের কাজ, যা অনেক সময়
সাপেক্ষ। এভাবেই একদিন দেখা যায়, সেই রুগীর বিভিন্ন মানসিক দশাগুলো আবছা হতে থাকছে
আর নিজস্ব মানসিক দশাকে সম্পূর্ণ মুছে না দিয়েই সে তার তীব্র অনুভূতিগুলোকে
নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে।
৬) ব্রেন স্টাডি থেকে জানা গেছে, হাই ডিসোসেটিভ আর লো ডিসোসেটিভদের
মস্তিষ্কের ক্রিয়াকর্ম পৃথক পৃথক। হাই ডিসোসেটিভরা চিকিৎসায় ধীরে ধীরে সাড়া দেয়। কারণ
এদের মস্তিষ্কের আবেগ নিয়ন্ত্রণকারী অংশ অধিক সক্রিয় থাকে।
৭) অনেকে বলেন হিপনোসিসের মাধ্যমে নাকি এই ধরনের
রুগীরা তাদের ‘খারাপ’ স্মৃতিগুলো থেকে
বেরোতে পারবেন। কিন্তু রিসার্চ বলছে, অভিজ্ঞ থেরাপিস্টরা কখনই হিপনোসিস ব্যবহার
করেন না। কারণ পূর্বের মারাত্মক স্মৃতি খুঁড়ে এই রোগের চিকিৎসা সম্ভব না। একমাত্র
প্রচণ্ড উত্তেজনা বা উদ্বেগ কাটাতে হিপনোসিস ব্যবহার করা যেতে পারে। প্রসঙ্গত বলা
যায়, সেলফ হিপনোসিস বা অটো হিপনোসিস কিন্তু মানসিক স্থৈর্য আনতে থেরাপিস্টরা
রুগীদের শিখিয়ে দেন। এই পদ্ধতিতে ওঁরা রুগীদের একটা নির্দিষ্ট শব্দ বা শব্দ-বন্ধ
বারবার আউড়ে যান যার ফলে রুগী ক্রমশ শান্ত হতে থাকেন। এরপর সেই রুগী যখন ওই
শব্দ-বন্ধকে নিজের আয়ত্ত্বে এনে ফেলেন, তখন তিনি নিজেই ওই শব্দ-বন্ধের দ্বারা
নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ আনতে সক্ষম হয়ে যান। একেই বলা হয় অটোহিপনোসিস। ধ্যানেও কাজ হয়
অনেকসময়।
সাধারণত ডিআইডি আক্রান্তদের
মধ্যে এক অসীম শূন্যতার বোধ কাজ করে। সে ভাবতে থাকে - সে একা, তাকে সবাই কোনো না
কো্নো কারণে বঞ্চিত করে চলে গেছে, সময়
নিয়েও এদের ভয়ানক ক্রাইসিস তৈরি হয়। একটা ‘টাইম গ্যাপ’-এর মধ্যে এরা থাকে। বিভিন্ন
রকম অসুখের কল্পনা করে, কখনও বলে জ্বর হয়েছে, কখনও বলে পেটব্যথা বা মাথাব্যথা।
আবার দেখা গেল সেই রুগী নিজেকে প্রচন্ড রকম মদ্যপ ভেবে নিচ্ছে, তার জন্য হ্যাং
ওভারেও আক্রান্ত হচ্ছে। অথচ সে হয়ত মাঝেমাঝে নেশা করে বাস্তবে। এই রকম নানাধরনের
খুঁটিনাটি নিয়ে নিজেকে ও তার আশেপাশের
মানুষদের সে ব্যস্ত রাখতে ভালবাসে, অন্যের মনোযোগ আকর্ষণের একটা চেষ্টা সব সময়ে
তার মধ্যে সক্রিয় থাকে। আরও একটা কথা বাদ গেল, অতিরিক্ত হতাশার কারণ জনিত
শূন্যতাবোধ থেকে এরা আত্মহত্যাপ্রবণ হয়ে পড়ে। যার ফল হয় মারাত্মক।
থেরাপির বাইরে যে কোনো
ধরনের মনোরোগীর সব থেকে বেশি প্রয়োজন তার পাশের মানুষটির সহানুভূতি, সঙ্গ ও
ভালবাসা। আর হ্যাঁ, অবশ্যই ধৈর্য। কমবেশি পাগল
আমাদের প্রত্যেকের মনেই বাস করে। প্রকাশের বিভিন্নতা দিয়ে আমরা কে সুস্থ আর কে
অসুস্থ, তার বিচার করি, এই যা। মনে রাখতে হবে এটিও একটি অসুখ মাত্র। এর ওষুধ আছে
আমাদেরই কাছে। একটু মনের ছোঁয়া আর একটু যত্ন, একটু স্নেহই এই ধরনের অসুখকে অনেকটা
কমিয়ে দিতে পারে। আমরাও একটু চেষ্টা করে
দেখি না এবার!
0 কমেন্টস্:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন