কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

মঙ্গলবার, ২১ ফেব্রুয়ারী, ২০১৭

অর্ক চট্টোপাধ্যায়

লোকটা ও তাবিজ 


শহরের বাসস্টপে প্রায় প্রতিদিনই লোকটাকে দেখতো সুধন্য। কালো হ্যাটের ফাঁকফোকর  দিয়ে সাদাচুল বেরিয়ে রয়েছে। মাথাটা মাটির দিকে নামানো। মুখে সবসময় শ্রদ্ধাবনত এক সিগারেট, আর পাছে সিগারেটের ছাইয়ে গর্ত হয়ে যায় পুরনো ময়লা শার্টখানায়,  তাই গলায় বাঁধা থাকতো একটা কালো কাপড়। তার ভেতর অসংখ্য ফুটো। যাকে  বলে একেবারে ফর্দাফাঁই। সুধন্য কখনো বুঝতে পারেনি লোকটা কেন মাথা নত করে রাখে। দেখে তো তাকে কুঁজো মনে হয় না! যেন আশেপাশে কী ঘটছে দেখতে চায়  না। হয়তো বয়েসের সাথে সাথে উদাসীন হয়ে পড়েছে! খালি পা ফেলার জন্য মাটি আছে কিনা দেখে নেয় নিচের দিকে চেয়ে। এটা অবশ্য সুধন্যর ব্যাখ্যা, প্রজেকশন বললেও ভুল হবে না। সব ব্যাখ্যাই তো প্রজেকশন। কিন্তু এইসব প্রজেকশনের আলোকনিক্ষেপ না থাকলে অভিজ্ঞতা গল্প হয়ে ওঠে না। আচ্ছা, এই লেখাটা কি গল্প হয়ে উঠবে? এই লেখার বিষয়ী তো নিজেই অভিজ্ঞতা-বিমুখ এক স্মোকার! দেখা যাক। 

টু রিটার্ন টু প্রজেকশন, লোকটার গলার ঐ কালো কাপড় দেখলে সুধন্যর শেফেদের কথা মনে হতো। তারা অবিশ্যি কালো নয়, সাদা কাপড় পড়ে থাকেন সাধারণত। আর কালো কাপড়ের গায়ে ঐ গাদা গাদা ফুটো দেখে তার ঠাকুমার বলা একটা গল্প মনে পড়ত। ঠাকুমার মা নাকি তাক-তুক জানতেন। মাঝে মাঝে তাকে গ্রামের লোকজন ওঝা হিসেবে এখানে ওখানে নিয়ে যেত। পেশায় যদিও তিনি স্কুল-শিক্ষিকা ছিলেন। তা এই তাক-তুকের নানান গল্পের মধ্যে একটা বেশ দাগ কেটেছিল বাচ্চা সুধন্যর মনে। একবার নাকি এক অসুস্থ ভদ্রলোককে বড়-ঠাকুমা একটা তাবিজ বেঁধে দেন আর বলেন ওনাকে কেউ বান মারছে আর তাবিজটা পরে থাকলে এটা সেইসব আঘাত নিজে শুষে নেবে। তাবিজ বাঁধার এক বছর পর ভদ্রলোক এসে বড়-ঠাকুমাকে দেখিয়েছিলেন তাবিজটার গায়ে অজস্র গর্ত হয়ে গেছে। সেই তাবিজ নাকি সুধন্যর ঠাকুমা নিজের চোখে দেখেছিল। ছোটবেলায় এই গল্পটা শুনে গায়ে কাঁটা দিত সুধন্যর। আজ লোকটার গর্তে ভরা কালো কাপড় দেখে এই একদা-বিশ্বাসযোগ্য এখন-অবিশ্বাস্য গল্পটা মনে পড়ল 

সুধন্য অনেকদিন ধরেই তক্কে তক্কে ছিল লোকটার সঙ্গে কথা বলবে। ফাইনালি একদিন বাস থেকে নেমে বলেই ফেললো: 'দাদা, আমি কি আপনাকে এক কাপ চা খাওয়াতে পারি?' লোকটা মাথা তুললো না। ঠোঁট থেকে সিগারেটও নামালো না। চিবিয়ে চিবিয়ে বললো: 'চা? চা তো আমি খাই না। এই যে দেখছেন সিগারেট, আমি শুধু সিগারেট খাই।' সুধন্য একটু অপ্রস্তুত হয়ে বললো: 'না, মানে আপনাকে রোজই দেখি। একটু কথা বলতে চাই। বেশিক্ষণ সময় নেবো নাযদি আপনার আপত্তি না থাকে অবশ্য।' লোকটা বাসস্টপের যেখানে দাঁড়িয়ে থাকে সেখান থেকে একটু এগিয়ে রাস্তার ধরে পার্কটা যেখানে শুরু হচ্ছে সেইখানটায় গিয়ে দাঁড়ালো। সুধন্য একে সম্মতির সংকেত ধরে নিয়ে পিছু পিছু গেল। পার্কে ঢুকে প্রথম বেঞ্চটায় বসে পড়লো লোকটা। সুধন্য একটু স্পেস রেখে পাশে গিয়ে বসলো। ওদের দুজনের মাঝখানের ঐ কাঠের স্পেস লোকটার কথা শুষে নিয়েছিল কিনা কে জানে কিন্তু তার পর থেকে সুধন্য লোকটাকে যা যা প্রশ্ন করলো, লোকটা তার একটারও উত্তর দিলো না। আবার উঠে চলেও গেল না। অবনত হ্যাটের নিচে মুখমন্ডল রহস্যাবৃত রয়ে গেলসুধন্য তার গলার কালো কাপড় থেকে সবসময় মাথা নিচু রাখা পর্যন্ত, এমনকি বড়-ঠাকুমার গল্পটাও লোকটাকে বললো। সুধন্যর কথা চলাকালীন লোকটার শরীরের একটা শিরাও নড়লো না। সিগারেটটা শেষ হয়ে গেল। মুখে সিগারেট হোল্ডারটা যে কে সেই ধরা রইলো। এভাবে মিনিট পনেরো কাটলো। সুধন্য বুঝলো লোকটা উত্তর দেবে না। হয়তো তার  প্রশ্ন করা পছন্দ হচ্ছে না। সুধন্য একবার চোখ নামিয়ে দেখে নিলো, লোকটার হঠাৎ হার্ট অ্যাটাক জাতীয় কিছু হয়ে গেল কিনা! সেই আশঙ্কা এলিমিনেট করে  নিয়ে 'আসছি' বলে বেঞ্চ ছেড়ে উঠে পড়লো। ততক্ষণে পার্কে আলো পড়ে এসেছে। 

শহরের বাসস্টপে প্রায় প্রতিদিনই সুধন্যকে দেখতো লোকটা। তার কালো হ্যাটের ফাঁকফোকর দিয়ে সাদাচুল বেরিয়ে রয়েছে। মাথাটা মাটির দিকে নামানো। মুখে সবসময় শ্রদ্ধাবনত এক সিগারেট, আর পাছে সিগারেটের ছাইয়ে গর্ত হয়ে যায় পুরনো ময়লা শার্টখানায়, তাই গলায় বাঁধা থাকতো একটা কালো কাপড়। তার ভেতর অসংখ্য ফুটো। যাকে বলে একেবারে ফর্দাফাঁই। ফুটোগুলো দেখে সুধন্যর কি মনে পড়বে লোকটা জানতো। তাই একদিন পড়ন্ত বিকেলে বাসস্টপের পাশের পার্কের বেঞ্চে বসে লোকটা সুধন্যর বাল্যকাহিনীর ভেতর ঢুকে ছোট্ট একটা বদল ঘটিয়ে দিলো। সুধন্য যখন তার পাশে বসে কথা বলে যাচ্ছিলো তখন চুপচাপ তার গল্পের ভেতর ঢুকে তাবিজটার ফুটোগুলোকে সময়ের স্তব্ধ বাতাসে বুজিয়ে দিয়ে এলো লোকটা। সুধন্য দেখতে পেলো ছিদ্রহীন সেই তাবিজ। আলোকনিক্ষেপ শেষ হলে স্টেজের ওপর যে অন্ধকার নেমে আসে তার অক্ষিবলয়ে স্নান করে নিচ্ছিলো নিকষ নিশ্ছিদ্র সেই তাবিজ।       


0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন