কুঠিবাড়িতে কিছুক্ষণ
এই যদি তোমার কুঠিবাড়ি হয়, তাহলে আমার বাড়ি তো নেহাতই
ঝোপরি। এই যে বারান্দাখানা পড়ে আছে, লম্বায় এক নদীর মত আর চওড়ায় বিশাল এক চিতল মাছ
– একে বারান্দা বলে নাকি, কেউ! মাথা খারাপ ছিল তোমার নির্ঘাৎ। আর দেখ, এই হলুদ এলা রাঙানো মোটা মোটা থাম দিয়ে
ঘেরা রট আয়রনের গ্রীলের রেলিং, ওপরে আবার পলিশড্ মেহগিনি কাঠ দিয়ে মোড়া, যার ওপর
দুহাতে ভর দিয়ে তুমি কিঞ্চিৎ ঝুঁকে আছ, তোমার দীর্ঘ দেহ আর ততধিক দীর্ঘ জোব্বা এই
পড়ন্ত বিকেলকে কেমন ভারী করে তুলেছে, খেয়াল করেছ? আর কী অদ্ভুত স্তব্ধতা এখানে!
তুমিও স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছ – নীচের মাঠে তোমার ছায়াকে দেখছ পলক না ফেলে। এত এত
লম্বা কেন তোমার ছায়া? আমার তিন ফুটের ছায়া তোমার ছায়ার নীচে চাপা পড়ে গেছে। শুধু
তাই নয়, এই যে আমার প্রচন্ড ছোটাছুটি করে এই বারান্দায় খেলতে ইচ্ছে করছে, টের
পাচ্ছ? পাচ্ছ না। তাই আমিও কেমন জড়সড় হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছি।
(শিলাইদহ নামটি আধুনিক, আগে খোরশেদপুর নাম ছিল
এই জায়গার। উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে ঠাকুর পরিবার এই গ্রাম কিনে নেয়। তার আগে
এখানে শেলি নামের একজন নীলকর সাহেবের কুঠি ছিল। গড়াই আর পদ্মা নদীর স্রোতে এখানে
একটি গভীর দহ তৈরি হয়েছিল আর সেই থেকে এই গ্রামটি শেলি-দহ নামে লোকে চিনত, যা কিনা
মুখে মুখে পরে শিলাইদহ নাম পায়। ১৮০৭সালে দ্বারকানাথ ঠাকুর রামলোচন ঠাকুরের উইল
সূত্রে এই জমির মালিক হন। রবীন্দ্রনাথ ১৮৮৯ সালের নভেম্বর মাসে জমিদারী দেখাশোনা
করতে প্রথম এখানে আসেন। পরে পদ্মার ভাঙনের ফলে পুরনো কুঠিবাড়ি ধ্বংস হলে, নতুন করে
পুরনো বাড়ির ইঁটপাথর দিয়েই আবার নতুন করে কুঠিবাড়ি তৈরি করা হয়। ১৮৯১ থেকে ১৯০১ সাল পর্যন্ত রবীন্দ্রনাথ এখানে এসে প্রায়ই
থাকতেন।)
সন্ধ্যে নেমে এল। তোমার ঘরের আলোগুলো কেউ জ্বেলে
দিয়েছে। তুমি এখন ঘরের ভেতরে যাচ্ছ দেখে আমিও তোমার পিছু নিলাম। ঘরে ঢুকেই তো আমার
হাঁ মুখ আরও হাঁ হয়ে গেল। ভাগ্যিস তোমার এখানে মাছি নেই! যাইহোক, এটা মানতেই হবে
রুচি আছে তোমার। বিশাল বিশাল একেক খানা মাঠের মত ঘর, লম্বা লম্বা ইতালীয়ান জানালা, পায়ের নীচেও ইতালীয়ান মার্বেল (আমাদের ঘরের মেঝেতেও আজকাল মার্বেল থাকে আকছার, কিন্তু এমন মার্বেল
বাপের জন্মে দেখি নি, স্বীকার করে নিলাম), ঘরের দেওয়াল ধবধবে সাদা, সিলিং-এ একটা
ফ্যান আর বাল্ব ঝুলছে... যত সোফা, টেবিল, খাট, দরজা সব কালো টিকউডের। এই দুর্ধর্ষ
সাদা কালোর কম্বিনেশন আর অমন ঠান্ডা মেঝে, দেওয়াল, ঘর... আর চারিদিক থেকে অন্তহীন
এক নিঃশব্দ চিরে ঝিঁঝিঁ পোকার একটানা ডাক আর অন্ধকারে কয়েকশো জোনাকির মিটমিট দেখে
আমার খুব শীত করে উঠল। আমাদের বাড়িতে এত শীত নেই তো! এত শব্দ ওখানে... এত কোলাহল
করে সবাই... গায়ে গায়ে থাকি আমরা, তাই শীতও তেমন বুঝি না। আচ্ছা, তোমার শীত করে
না? এবার দেখলাম, তোমার দাড়িগোঁফের আড়াল থেকে একটু হাসির আভাস এল। তারপর আমার হাত
ধরে নিয়ে চললে... নীচে নেমে যাচ্ছ তো যাচ্ছই... কী বিশাল বাড়ি তোমার বাবা! পা
ব্যথা হয়ে গেল। আমার এমন ‘কুঠি’ থাকলে এখানেই মর্নিং ওয়াক হয়ে যেত। এই ঘোরানো
সিঁড়িটা আমার সব থেকে পছন্দ হল কিন্তু। তুমি এক স্টেপ নীচে আমার হাতটা ধরে দাঁড়াও।
আমি একেকটা স্টেপ বাদ দিয়ে লাফিয়ে লাফিয়ে নামব। আরে! হাঁ করে মুখের দিকে তাকিয়ে আছ
কেন? হাতটা শক্ত করে ধর, এই দেখ লাফিয়ে তোমার পাশে এলাম... এরকম ভাবেই নামব আমি।
বুঝলে? বেশ লক্ষ্মী ছেলের মত এভাবেই নীচে নেমে তোমার বাগানের মধ্যে নিয়ে এলে আমাকে।
বাহ! তুমি তো দারুণ লোক! এর মধ্যে বন ফায়ারের ব্যবস্থা করে ফেলেছ! আমার শীত করছিল,
বুঝলে কী করে? ধুর... তোমার ওই মিটিমিটি হাসি দেখলেই আমার গা জ্বলে। এখন আস্ত আস্ত
মুরগি পোড়ানোর বন্দোবস্তও করে ফেল ঝটপট। সঙ্গে আমাকে একটু ভাল জাতের রেড ওয়াইন আনিও, কেমন?
(৩৩বিঘে
জমির ওপর আড়াই বিঘে নিয়ে তৈরি হয়েছে এই কুঠি। বাউন্ডারি ওয়াল যেন পদ্মার ঢেউ! এই
কুঠিতে ১৮টি ঘরে, সতেরোটি দরজা আর তিরিশটি জানালা। তিনতলায় ছিল কবির লেখার ঘর। এখানেই ছাদে বসে
পদ্মার শোভা দেখতেন তিনি। আগে এই লেখার ঘরের জানালা থেকে
পদ্মা ও গড়াই দুই নদীকেই দেখা যেত। এখন
শুধু পদ্মাকে দেখতে পাওয়া যায়। নদীর টানে কবি প্রায়ই ছুটে যেতেন পদ্মার ধারে, কখনও
বজরায় ঘুরতেন, কখনও সাঁতার কাটতেন। কুঠিবাড়ির ছাদ জাপান থেকে টালি এনে তৈরি
হয়েছিল। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ জার্মান থেকে মিস্ত্রি এনে এক বিশেষ কায়দায় তিনতলার সিঁড়িটি
বানানো হয়েছিল। এই সিঁড়ির কোনো বীম নেই। এই কুঠির বাইরে দিয়ে অবশ্য গোল করে
প্যাঁচানো লোহার একটি সিঁড়িও আছে। এখানে কবির ছোটবেলা থেকে মৃত্যুশয্যার ছবির
পাশাপাশি মহাত্মাগান্ধী, অ্যান্ড্রুজ, ইয়েটস-এর ছবি, কবির নিজের হাতের লেখা কবিতা,
নোবেল পুরস্কার পাওয়ার পর প্রকাশিত কবির ছবি ও শংসাপত্র, যেসব নাটকে অভিনয় করেছেন,
সেই চরিত্রের ছবি সংরক্ষিত আছে। এই বাড়ির দোতলায় কবির শোওয়ার
ঘরে একটি পালঙ্ক, ছোট একটি গোল টেবিল,
কাঠের আলনা রাখা আছে। এছাড়াও কবির ব্যবহৃত চঞ্চল ও চপলা নামে দুটো স্পিডবোট, একটি
পল্টুন, আট বেহারা ও ১৬ বেহারার পালকি, কাঠের চেয়ার, আরাম কেদারা, হাত পালকি, দুটো
গদি মোড়া চেয়ার, সোফাসেট দুটো, দুটো টেবিল, ঘাস কাটার মেশিন একটি, চীনা মাটির তৈরি
একটি ওয়াটার ফিল্টার রক্ষিত আছে। একতলা
থেকে তিনতলার ৯টি ঘরে কবির ও বিভিন্ন মনিষীদের সঙ্গে গ্রুপ ফোটো, কবির নিজের হাতে
আঁকা ছবি ও কবিতার ছবি রয়েছে। )
কাঠ পোড়ার ফটাস ফটাস শব্দে চারদিকের নিস্তব্ধতা কেটে
যাচ্ছে একটু একটু করে। আগুনের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকতে থাকতে কেমন চোখ ব্যথা
করছিল। তুমি দেখি আমারই মত একই ভাবে আগুনের দিকেই তাকিয়ে চুপচাপ বসে আছ। একবার
পেছন ফিরে দেখ – তোমার লম্বা ছায়া কেমন আমার ছায়াকে ঢেকে দিয়েছে। আমার ছায়ার কোনো অস্তিত্বই নেই। এভাবেই আগলে রেখ আমাকে। আমাদের। তুমি এত কম কথা বল কী করে? সত্যি বলতে
কি, আমিও কথা বলি না তেমন ভাবে, এই তোমার কুঠিবাড়িতে এসে আজ আমায় কথায় পেয়েছে।
খেলায় পেয়েছে। তোমার মত এত বিখ্যাত মানুষকে যে কী জ্বালান জ্বালাচ্ছি! জ্বালাচ্ছি,
বেশ করেছি। এই তো কাল সকালেই চলে যাব তোমার আস্তানা ছেড়ে, তারপর থাক না নিজের মত
করে। এতদিন শুনেছিলাম, তুমি বুর্জোয়া কবি, ধনী মানুষ, এখন কিন্তু তোমাকে আমার
একটুও নাক উঁচু টাইপের মনে হচ্ছে না। আর দেখেছ – আমাদের পোশাকে কত্ত মিল! আমার এই
লম্বা ঝুলের কুর্তি আর ঢোলা পালাজো, তোমার ওই জোব্বা আর পাজামার মতই। একটু
মডার্নাইজ, এই যা। ঠিক যেমন তুমি এত পুরনো যুগের লোক হয়েও এখনকার মত। এখনকার মতই
তোমার উদার চিন্তাভাবনা, যা তুমি সেই কবেই লিখে রেখে গেছ। আর তোমার লেখকজীবনে যেমন
তুমি তোমার সময়ের সমস্ত প্রচার মাধ্যমকে কাজে লাগাতে, এখনকার লেখকরাও তেমনি কাজে
লাগায়। আরও বেশি করে লাগায়। তোমার পুরস্কার পাওয়া নিয়ে লোকে গালিগালাজ দিত, এখনকার
লেখকদেরও দেয়। কাদা ছোঁড়াছুঁড়ি তখনও ছিল, এখনও সমান ভাবে আছে। তোমাকে বলত, তুমি
সুর টুকলি কর, এখনকার সুরকাররাও করে। জানি না, সময়ের বদল হয়েছে কি আদৌ হয় নি। যাইহোক,
কাল সকালে তোমার লেক-এ বোটে চেপে ঘুরব... বাগানে ছোটাছুটি করব খানিক, তারপর বিদায়
হব, বুঝলে? এখন চল, ঘুমোতে যাই। গুড নাইট।
( কুঠি বাড়ির চারপাশে রয়েছে ফুলের বাগান। উত্তর দিকে
রয়েছে প্রাচীন আমগাছ, পশ্চিমদিকে রয়েছে ঐতিহ্যবাহী বকুলতলার
ঘাট। এই ঘাটেই তিনি স্নান করতেন। কবির
যৌবনের অনেকখানি কেটেছে এই শিলাইদহে। নোবেল প্রাপ্ত ‘গীতাঞ্জলী’ও এখানে লেখা। বকুলতলার ঘাটে বসে
লিখেছেন কিছু বিখ্যাত গান। যেমন – ‘পড়বে না মোর পায়ের চিহ্ন এই বাটে’। কয়াতে বসে কবির লেখা বিখ্যাত কবিতা
‘ হে মোর দুর্ভাগা দেশ, যাদের করেছ অপমান, অপমান হতে হবে সবার সমান’, গড়াই নদীর
বোটে বসে লেখা ‘সীমার মাঝে অসীম তুমি বাজাও আপন সুর’। শিলাইদহে বসে লেখা ‘আমার এই পথ
চাওয়াতেই আনন্দ’, কৃষ্ণকলি আমি তারেই বলি’, ‘হে নিরুপমা’, ‘হৃদয় আমার নাচে রে
আজিকে’, ‘নীল নবঘনে আষাঢ় গগনে তিল ঠাঁই আর নাহি রে’, ‘গায়ে আমার পুলক লাগে’, ‘তাই
তোমার আনন্দ আমার পর’ – এমন বহু জনপ্রিয় গান সৃষ্টি করেছেন।)
রোদ পড়ে এই কুঠি একদম অন্যরকম লাগছে। মনে হচ্ছে যেন
এক গভীর শোক ভুলে যাওয়ার পরে হেসে উঠেছে কোন মুখ। লেকের জলে চিকচিক করে ছড়ানো
অভ্রকুচি আমাকে বলল, বেশি ছটফট কর না বোট-এ। সাঁতার জান না, খেয়াল রেখ। আর শুনেই
সেই বকবক করা, খেলতে চাওয়া বালিকাটি আমার কাছ থেকে চলে গেল। তুমিও আর চিনতে পারলে
না। আমি কিন্তু তোমাকে ভুলব না। তোমাকে আমি কবিগুরু বলি না, কারণ আমার গুরু আমিই।
তবুও এই কুঠি ছেড়ে যাওয়ার সময়ে তোমাকে মনে মনে প্রণাম জানিয়ে গেলাম। আবার আসব কিনা
জানি না, তবু দেখা হবে, কথা হবে আমাদের। মনে মনে।
0 কমেন্টস্:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন