ফেরৎ
কৃষ্ণকলি আর আকাশের ভালোবাসা পাগলের মতো ছিল। হাহাকার, নখের আঁচড় সব ছিল... তবু
কেন ওদের মনে হতো কিছু নেই? চাওয়ার কোনো অস্তিত্ব নেই, পরস্পর শূন্যের ভেতর ঢুকে
পড়ছে, এখন মানচিত্রের ভেতর ঘুণ
পোকার বাসা। ইদানিং চেনা কথাগুলো বদলে
যেতে থাকে আকাশের। কারণে অকারণে অবজ্ঞা করে
কিছু বললেই বিরক্তি প্রকাশ করে। কৃষ্ণকলি অভিমান ভাঙানোর চেষ্টা করে দেখেছে, কিন্তু আকাশের
মনের
মধ্যে অবজ্ঞা আস্তানা গেড়ে বসে গেছে। কৃষ্ণকলি ভাবছে, সেই স্কুল ব্যাগের ভেতর
স্বপ্ন নিয়ে একটাই তো ঘুড়ি ওড়াতে চেয়েছিলাম, প্রাণপণ ভালোবাসাকে পুঁজি
কোরে! চোখের সামনে স্বপ্নগুলোর গর্ভপাত হতে দেখছে, কিন্তু কিছুই করতে পারছে না। বহুদিন আর এপথে আসেও না আকাশ। কৃষ্ণকলিও নিজের চাকরি আর কাজ নিয়ে
ব্যস্ত।
এর মধ্যে হঠাৎই একদিন আকাশের ফোন এলো। ফোন নম্বরটা মোবাইল থেকে ডিলিট কোরে
দিয়েছে, তবুও নম্বরটা এখনো মুখস্ত
আছে কৃষ্ণকলির।
“হ্যালো...” গলাটা একটু পরিষ্কার কোরে
নিয়ে, “আমি খুব অসুস্থ... তুমি একবার আসবে কলি?”
কথা শেষ হতে দিল না কৃষ্ণকলি, বলল, “আমি কী করব বলো! ডাক্তার দেখাও।”
আরো কিছু বলতে যাচ্ছিল আকাশ, অনেক কথা বলার আছে তার। কিন্তু কৃষ্ণকলি থামিয়ে দিয়ে গড়গড় করে বলতে থাকে, “অভিমানের ভেতর দাঁড়াতে দাঁড়াতে আমি বড় ক্লান্ত। গভীর একটা মায়া আমাকে এখনো
স্পর্শ করে, তাড়িত করে বারবার। আমি
ভেতরে ভেতরে রক্তাক্ত হই।... জানো, আমাকে পোড়ায়, কাঁদায়, তিলে তিলে শেষ করে দেয়।
ভেতরে ভেতরে নিশ্চুপ একটা কান্নায় আমি ম্লান হয়ে যাই।” এতক্ষণে আকাশ একটু বলার সুযোগ পেল, “নিজেকে বদলে নিতে পারতে কলি!”
“একটা সময় হয়তো নিজেকে বদলে নিতে পারতাম। কিন্তু কার জন্য বাদলবো
বলতে পার? আমি দেখেছি একটা খাঁ খাঁ
দুপুর কীভাবে উলঙ্গ হতে হতে
আত্মমৈথুনে মগ্ন হয়!”
“প্রত্যেক সম্পর্কেই একটা অভিমান থাকে, কলি। আমি ইদানিং মৃত্যুকে হাঁটু ভাঁজ করতে
দেখেছি। আমি আজ বড় অসহায়।”
“আমার আমি’কে একটা মোড়কের ভেতরে রেখেছি, মুঠো মুঠো রক্তগোলাপের
পাপড়ি দিয়ে। জানো, সব সম্পর্কের চিৎকার এখন আমার গা সওয়া হয়ে গেছে!”
— কলি, আমি একাকীত্বের অতলে তলিয়ে যাচ্ছি।
— আর তোমার অহংকার! তার কী
হবে? শোন, দূরত্ব বাড়তে বাড়তে এমন
একটা অবস্থায় পৌছায়, যখন আর সেই দূরত্বকে
কমানোর কোনো উপায় থাকে না। ... কতবার
ফোন করেছি তোমাকে, শুধু একটা ‘সরি’ শুনতে চেয়েছি তোমার কাছ
থেকে। কিন্তু প্রতিবারই তোমার ফোন বেজেই গেছে, ধরনি। নয়তো কেটে দিয়েছ...
দিনের পর দিন, মাসের পার মাস।
— তুমি মান্না দে’র একটা গান শুনেছ, কলি? সেই যে... “প্রিয় যবে দূরে চলে যায় /
সে যে আরো প্রিয় হয় জানি / কতদিন কতদিন দেখিনি তোমায়...”
— কথায় আমি তো তোমার সাথে কোনোদিন পেরে উঠিনি... আচ্ছা, আমাদের ভালোবাসাটা কী
শুধুই লিঙ্গবাহিত ছিল?
— যৌনতা কো্নো অসুখ নয়।
— তুমি চিরদিন আমাকে নিয়ে
খেলেছ।
— তুমি আর ফিরবে না, কলি?
— তুমি চলে যাবার পর আমি
মৃত্যুকে গোছাতে গিয়ে কবে যে বেঁচে থাকাকে গুছিয়ে ফেলেছি, আমি নিজেও জানি না। আজকাল সবুজ ভাত উথলে ওঠে, হাতের তালুতে খিদের গন্ধ পাই যে! জানো, এই শ্রাবণে আমি নীল দীর্ঘ
বিকেল দেখেছি বহু রঙের ভেতর... আকাশ, আমি বাঁচতে চাই, আমাকে আরো কিছুটা বাঁচতে
দাও, প্লিজ...”
মৃত্যুকে গোছাতে গোছাতে বাঁচাটা যখন গোছানো হয়ে যায়, তখন আর ফেরা যায়ও না।
উত্তরমুছুন