একমুঠো গোলাপ
সবাই পড়াশোনা করা ছেড়ে দিতে
বলছে। ইস্কুল কলেজে যখন মন দিয়ে লেখাপড়া
করেছি,
কোনোদিন ফার্স্ট সেকেন্ড হতে পারিনি। এখন যখন গল্প
উপন্যাস লিখব বলে এন্তার দেশ বিদেশের নামী দামী বই পত্তর যোগার করে দিন রাত্তির পড়াশোনা
করছি, ভালো গল্প বা লোমহর্ষক কাহিনী কিছুই সেরকম লিখে উঠতে পারছি না। এদিকে বই জমে পাহাড়। বন্ধুবান্ধব পরিবার পরিজন
সবাই খাপ্পা। এত লেখাপড়া করিস্নি... শেষে হয় পাগল হয়ে যাবি নয়তো গাড়ি চাপা পড়ে
মরবি, অভিশাপ দিচ্ছে সবাই।
বিশ্বজিত অনাথ এতিম বলে সুবিধা
করতে পেরেছিল। আশ্রমের পুজোর ফুল তোলা চন্দন বাটা ঠাকুরের থালা বাসন
ধোয়া গরুকে জাব দেওয়া রান্না বান্নার দিকের তরকারী টরকারীগুলো কেটে ধুয়ে দেওয়া, সব
মিলিয়ে দুর্দান্ত পারফরমেন্স! ওকে বলেছিলাম, আশ্রমের ইস্কুলেই আর দুটো বছর পড়ে নে,
তাহলেই তো বোর্ড পরীক্ষায় বসতে পারবি। শুনে বলল, ইস্কুলের প্রিন্সিপলটা হারামী
আছে। ওখানে পড়ব না। স্বামীজী মহারাজের টাইম নেই,
না হলে হায়দ্রাবাদের আশ্রমে ক্লাশে আমি সেকেন্ড হতাম।
বেশি লেখাপড়া করলে কি মাথার
ঘিলু শুকিয়ে যায়? পাগল পাগল লাগে? শেয়াল পন্ডিত বলে সবাই খ্যাপায়? লাইব্রেরীর
রিডিংরুমে দেখেছি পছন্দের বই খুলে অনেকেই চুপচাপ পড়াশোনা করে যাচ্ছে। কে এলো কে গেল,
কোনো হুঁশই নেই!
ভালোই হলো। আমিও সার্বজনীন দুর্গোৎসবে সামিল হলাম। এখন কাজ পাগলদের খুঁজে বের করা, নয়তো
গাড়িচাপাদের নামধাম বলে দেওয়া।
চৈতন্যদেব পাগল হয়ে গিয়েছিলেন।
বৈষ্ণব ধর্মের প্রতিষ্ঠাতা। শাস্ত্র পুঁথি পড়ে
পড়ে ঈশ্বর আছেন না নেই ভাবতে গিয়ে এমনই উন্মাদ হলেন যে, সমুদ্রে কেউ তাঁকে ঠেলে দিল, না কি গুপ্তহত্যা
করে দিল, আজও পরিষ্কার নয় ব্যাপারটা।
গ্যালিলিও গ্যালিলি। জ্যোর্তিবিজ্ঞানের জনক। একশোবার বলা হলো চার্চের সামনে স্বীকার করো,
তুমি যা যা বলেছ, সব ভুল! তা উনি শুনলে
তো? মাথাখারাপ ছাড়া আর একে কী বলা যায়?
কাউন্ট লেভ্ তলস্তোয়। যুদ্ধ ও
শান্তি উপন্যাসের লেখক। শেষ বয়সে গৃহত্যাগ করেছিলেন। ডিসেম্বরের মাঝরাত্তির তখন। পরিবারের কারুর সাথে মতে মিল হতো না।
জীবনানন্দ দাশ। ধূসর
পান্ডুলিপির স্রষ্টা। কী হয়েছিল কে জানে! ট্রামে কাটা পড়েছিলেন। রাস্তায় ভিড় ছিল। গাড়িঘোড়া চলছিল দেখতে পাননি বোধহয়!
রাজীব চক্রবর্তী। আটান্ন বছর
বয়েস। এন আই টির প্রফেসর। আমার প্রতিবেশী। বাড়িতে ছাত্র ছাত্রীদের ভিড়
লেগেই রয়েছে। তবু ওরই মধ্যে ভদ্রলোক ঠিক সময় বের করে
নিয়েছেন! ভদ্রলোকের স্ত্রী থানার বড়বাবুকে ফোন করে বাড়িতে আসতে অনুরোধ জানালেন। মহিলা নিজেও অরথোপেডিক ডাক্তার। একজন ডাক্তারই কেবল জানেন পুলিশকে কখন ফোন করতে হয়। অফিসারের ড্রেস পরা বড়বাবু এলেন, ঘড়িতে প্রায় তখন
রাত দশটা। পুলিশের কাছে ডাক্তারের আবেদন, প্রফেসরকে কীভাবে বাঁচিয়ে
রাখা যায়? কারণ, গত তিন দিন ধরে প্রফেসর আত্মহত্যার ব্যর্থ চেষ্টা করে চলেছেন।
ঠিক করলাম পড়াশোনা করা কিছুতেই
বন্ধ করা যাবে না। কিছু কিছু তথ্য নখদর্পনে রাখার জন্য পড়াশোনা করতেই
হবে। রাজস্থানীগুলো অবশ্য এসবের ধার ধারে না। কিছু অঙ্ক জানলেই সব কাজ ওদের শেষ। তুলনায়
কেরলের লোকগুলো হায়েস্ট লিটারেট। প্রতিটা গলিতে
চারটে করে কবি আর ছটা করে বৈজ্ঞানিক। পন্ডিতন্মন্য।
বই পড়তে পড়তে ঢুল এসে গিয়েছিল। হঠাৎ মনে পড়ল ক্লাশ থ্রী পর্য্যন্ত ইস্কুলে পড়া বড়মামীমা শেষ বয়সে পৌঁছে
নকশীকাঁথা বোনা শুরু করেছিলেন। বেগুনী কাক সবুজ সূর্য হলদে নদী। কাঁথার মধ্যে লাল নীল সুতো দিয়ে লেখা বিভিন্ন ছড়া বা
রূপকথার
ছবি। চোখে ভালো দেখতে পেতেন না, তবু
কী দুর্দান্ত সেই বুনন! ইস্কুলে পড়বার সময়
কিন্তু এত ভালো ছবি আঁকা বা ছড়া কোনোটাই পারতেন না। দীর্ঘ সংসার জীবনের শেষে কিছু একটা করতে হবে ভেবে নকশীকাঁথা বোনাকেই সবচেয়ে
ভালো বলে মনে করেছিলেন।
তাহলে
মানেটা এই দাঁড়াল যে, আগে লেখাপড়া বন্ধ। পরে দায় দায়িত্ব বৃহত্তর সমাজের সঙ্গে
আদান প্রদান। তারপর প্রাকৃতিক নিয়মে শারীরিক অক্ষমতা, বার্ধক্য। শেষে ছবি আঁকা ও লেখা।
(ঋণ স্বীকার : মলয় রায়চৌধুরী)
বেশ
উত্তরমুছুন