কালিমাটি অনলাইন

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

মঙ্গলবার, ২১ ফেব্রুয়ারী, ২০১৭

জিনাত রেহেনা ইসলাম

মেয়েখেলা (পর্ব -)  




এখন জীবন প্রায় মরীচিকার মতো হাত থেকে পিছলে পালাতে চায়। আমি ছাড়া আমার কাছে আমার বাড়তি পাওনা আমার একমাত্র মেয়ে। পুরুষের মতোই বাবার কাছে কেটে গেল জীবন। কেয়ার অফ বদলায় নি, হাত ও মাথায় সধবার টিকা পড়েনি, বদলায়নি উত্তরাধিকার সুত্রে পাওয়া এই শোবার ঘর। এইখানেই বসে একদিন ১৬ বছর বয়সে জিন্সের প্যান্ট পড়েছিলাম বাবার অভিমতকে চ্যালেঞ্জ করে। সেই শুরু। এখানেই একদিন প্রশ্ন তুলেছিলাম, মা কেন দাদাকে প্রতিদিন মাছের মাথা আর  আমাকে ল্যাজা দেয়? দাদার মতো আমিও বাইরে পড়তে যাব না কেন? এক পারিবারিক আত্মীয় কেন আমার দিকে ওইভাবে তাকায়? কেন আমার ছোটকার সাথে ঘরের দরজা লাগিয়ে গল্প করতে পারব না আমি? কেন আমি কখন মা হবো তার সিদ্ধান্ত আমি নিতে পারব না? সেই ধূসর প্রশ্ন বুঝি বেডরুমের রঙের ফাঁকে লুকিয়ে হাসে!

এখানেই ঠিক একযুগ পরে আমার মেয়ে প্রতিবাদ করেছিল, কেন সে বাবার কাছে থাকতে পারলো না? কেন তার শৈশব এক অনাথের মতো কাটলো? এখানেই মা কেঁদে বলেছিল, ‘স্বামীর সাথে মানিয়ে নিতে পারলি না? জামাই তো ডাক্তার’! এই  বাড়িতে বসেই স্বামী বলেছিল বা্বাকে,আপনার মেয়ে কেন লিপষ্টিক লাগায়, কেন এত জামাকাপড়ের সজ্জা? বোঝেন না আপনি!’ একদা বন্ধ দরজার সামনে দাঁড়িয়ে  স্বামী প্রতিবাদ করে বাবাকে জানিয়েছিল, ‘আপনার মেয়ে আমার মেয়েকে নিয়ে  বেডরুম লক করে  দেয় বাবা বলেছিলেন, ‘লক ভেঙে ফেলে নিজের অধিকার আদায় করো!’ বিশ্বাসের তার এমনি করেই পায়ে পায়ে নিঃশ্বাসে নিঃশ্বাসে ছিঁড়েছে আমার, তবু জীবনের প্রতি দুর্নিবার ভালোবাসা কমেনি। অনন্ত আলোর এই জীবন, অসীম আকাঙ্ক্ষার পরতে পরতে পথের দিশা। শুধু এগিয়ে চলার পথ যেন অবরুদ্ধ না হয়ে ওঠে!

বেড়া ভাঙতে ভাঙতে এক শূন্য অক্ষরেখায় ভাসমান জীবন। পেছন ফিরে দেখলে এক বন্দীশালার অভিজ্ঞতা আমার। ঘরের বাইরে যাওয়া থেকে পোশাক সবক্ষেত্রেই লক্ষণরেখার স্পষ্ট গন্ডী। বিদ্রোহের ফণাও একসময় মাথা নামিয়ে নিতে শেখে। নিরন্তর এই প্রতিরোধের আড়ালে বাবা-মাকেই কষ্ট দিচ্ছি ভেবে পা গুটিয়ে নিতে থাকি অন্দরমহলে। বাইরের জগতের প্রকান্ড দৈত্য আমার বন্ধ জানালার ওপাড়ে পড়ে থাকে। বাবার ভাষায় মায়ের মতো ইন্ট্রোভার্ট ও ভালো মেয়ে’ হয়ে ওঠার প্রশিক্ষণ চালু হয়। পাশাপাশি পরিবারের অন্য ফর্সা মেয়েদের পদমর্য্যাদার কাছাকাছি জায়গায় পৌঁছানোর জন্য আরও নম্র ও বিনয়ী হয়ে ওঠার পরামর্শ মিলতে থাকে একটা অরবিট ধরে ঘূর্ণি মতো ঘুরতে থাকে জীবন। সারাদিনে দফায় দফায় মাইকে ভেসে আসা আজান জানান দেয়, এই বন্ধঘরের বাইরে্র এক সচলায়তন পৃথিবীর কথা। পড়া শেষে বিবাহ ও চাকরির পর যেন  নিষ্কৃতি মেলে। মাথা তুলে দেখি ক্ষতে ভরে গেছে দেহ, যন্ত্রণার কথা মনেই আসেনি।

বন্দীত্ব যে কখনো নিষ্ক্রিয় থাকে না, তা বুঝি হষ্টেলে থাকার সময়। স্বাধীনতার এক নতুন চেহারা দেখি। বিশেষত মণিপুর বা নাগাল্যান্ড থেকে পড়তে আসা মেয়েদের দেখে অবাক হতাম। কী আত্মনির্ভর আর আত্মবিশ্বাসী এরা! এদের এই বোধ খুব যন্ত্রণার ছিল আশেপাশে থাকা ছেলেমেয়েদের। সুপার এদের খুব ভালো চোখে দেখতেন না, কেননা এদের নাইট পাস নেবার চাপ থাকত। নাইট পাস নেওয়া মানেই সেটি একধরনের শৃঙ্খলাভঙ্গ মানা হতো এদের লিবার্টি এদের ফ্লেক্সিবিলিটির নির্ণায়ক ছিল বলে ধরে নেওয়া হতো আসলে যে সমাজ ও পরিবারের হাত ধরে আমাদের শিক্ষা, সেখানে অতিসারল্য বোধটাই মরে যায়। এর অনুশীলন আমরা নিজের উদ্যোগেই নতুন করে নিয়ে থাকি। মেয়ে হয়ে জন্ম নিলে তার হাসি, কান্না, আনন্দ যাবতীয় অনুভব ও মানবিক গুণের একটি নেগেটিভ স্কেল’ থাকে যা দিয়েই আচরণের ব্যাখ্যা করা হয়। কেউ রুমে এসে আলাপ করলে তার আচরকে বেঁধে দেওয়া হতো গায়ে পড়া, সুযোগসন্ধানী বলে। কেউ বেশি অমায়িক হলেও অতিভক্তি চোরের লক্ষণ’ বলে দাগিয়ে দেওয়া হতো যে মেয়ের বেশি ছেলেবন্ধু, তার থেকে দূরত্ব বজায়ের পরামর্শ আসত। 

  
সারাটা জীবন আমাদের পরামর্শ, আদর্শ ও আদেশের ভারে চাপা পড়ে থেকে গেল। প্রাভরে হাসলাম না, মনভরে ঘুরলাম না। বাড়ির শাসন পেরিয়ে প্রেমিকের শাসন, তারপর দাম্পত্যের শাসন। একটানা রাজদন্ডের প্রহার। একটা ভোরের সকাল কত সুন্দর, তা এখনো দেখা হয়নি। শুধু দুপুরের আগুন আর অস্তটুকু দাগ কেটে গেছে। একটু স্বাধীনতা, অল্প হাসির গান গাইবার স্বপ্নে কেটে গেল একটি গোটা জীবন।
          
আজ কোথাও কিছু ধরে রাখার দায় নেই। একটা ভালোবাসা নিরপেক্ষ অসীম রেখায় ভালোবাসার মানুষদের দাঁড়িয়ে দেখি যাদের ছেড়ে আসার দায় বহনের বাইরে সবটাই অচেতন, অসাড়। দেখি মোমপরীর নীরব আত্মহনন। ভাবি কী পীড়াদায়ক সেই মুহূর্ত যখন সম্পর্কের মৃত্যুকে সেলিব্রেন করে আমরা আরেকটি নতুন মৃত্যুকে আলিঙ্গনের জন্য ঝাঁপিয়ে পড়ি। বারবার প্রেমের ভাবনা মরে, ভালোবাসার আবেগ পুড়ে যায় ফিনিক্সের মতো জন্ম নেয় নতুন আত্মবিশ্বাস। ঘাতকের নল, বিদ্বেষের লেলিহান জিহবা সেই বিশ্বাসের তোপের সামনে কাঠখড়ের মতো উড়ে যেতে থাকে। ডালে ডালে, পাতায় পাতায় আবার সেই ভালোবাসার জন্ম হয়। নতুন কূলের হাতছানি, সেই ডুবসাঁতারের আহ্বান! একবুক মরুভূমিতে আবার ধুলিঝড়ের অপেক্ষা! 



(ক্রমশ)  


     

0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন