কালিমাটি অনলাইন

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

শুক্রবার, ২৫ নভেম্বর, ২০১৬

শাপলা সপর্যিতা

লখিন্দরের গান আর অশ্রু পার্বণের সাথে কিছুদিন




মরণ চির প্রিয়তরের মতো জীবনের গভীরে ব্যাপ্ত হয়ে বসেছিল আমার প্রাণের ঠাকুরের কাছে তাই তাঁর কাব্য রচনার ধারে কাছে মরণের ছিল অবিরত বাস ঠেকাতে পারেন নি তিনি তারে কিংবা ঠেকাতে চাননি আজ আমিও লিখতে বসলে কীভাবে যেন সেই মরণ এসে গড়াগড়ি যায় পায়ের কাছে আমি নিত্যই ভাবি, আসলে কি আমার আজীবন ঠাকুর পাঠের সজ্ঞান? নাকি জীবনের অনেক বেলা পার হয়ে ক্রমশ ধাবিত হচ্ছি যেদিকে তার প্রতি গভীর দৃকপাত! নিশ্চিত হয়ে গেছে যার অবস্থান অবিরত জীবনের পরতে পরতে তারেই আদরে সাদরে সম্ভাষণে জীবনের আনন্দে বিষাদের সাথে লয়ে এক অদ্ভুত রস আস্বাদনের অপচেষ্টা! অপচেষ্টা এজন্য যে, তাঁরই মতো করে এমন ভাষায় বর্ণমালায় কে পারে, গভীরে বোধে কে আর পারে, মরণরে জীবনেরও আরো আরো উঁচুতে দিতে সঠিক অবস্থান তবু পড়ি। শুরু করি এক নতুন বই, নতুন কবিতা। নিঃশেষে আগাই আরও এক অসাধারণ পাঠের দিকে তার শুরুই হলো সেই চির পরিচিত মরণরে সাথে লয়ে। মুগ্ধ বিস্ময়ে  অসাধারণ সব শব্দ উপমা আর দারু মাত্রাবৃত্ত ছন্দের দুর্দান্ত কম্পোজিশনে দেখি মরণের আর এক রূপ যা মাটির সাথে শেকড়ের সাথে চিরকালের প্রবহমান জীবনের সাথে জীবনেরও অধিক সম্ভাষণে বিরাজে বিষাদে আনন্দে... 

এখানে মরণ/অস্থির গায়ে/দনকলসের/পাতা - ///
বাকল খুলেছে/মহাকাল ঋষি,/ভেষজের নীল/ছাতা///
মাটির ডেরায়/ডিমের আদল,/ঘুমাও পরম/গুরু ///
তোমাকে ফোটাই/দাদাজান পাখি/এখানে তাবৎ/শুরু/// (পরম্পরা)


এই মহাকাল, ঋষি, এই দাদাজান পাখি শব্দগুলো আমারে তাড়িয়ে নিয়ে চলে আমি কোথায় হারাই! আমার সুগভীর চৈতন্যেরও সীমারেখা ভেদ করে কতদূর --দূ-র্   বহুদূর! আর কোথায় বা ব্যপ্ত হয় আমার ভাবনা শুধু টের পাই চলে যাচ্ছি কোনো এক নিশ্চিত নির্দিষ্ট শেকড়ের কাছাকাছি যেখান থেকে শুরু আর যেখানে গিয়ে শেষ

পরম্পরা কবিতাটির নাম অর্থাৎ জীবন জীবন বংশানুক্রম জানিনা কবির কি  লা আছে হয়তো আমার সাথে আছে তার বোধের বিস্তর পার্থক্য কিন্তু সাহিত্যে  রিসেপশন থিওরী বলেও তো একটা কথা আছে আমি এক অকালপক্ক রিসেপ্টর কিছুটা বা নির্বোধও আমি দেখি এখানে এক হতে আর এক বংশানুক্রমিক চির প্রবহমানতা মানুষের বোধের চিন্তার ভাবনার প্রাত্যহিক জীবনের কাজের শ্রেণিগত বিভেদ আর সাজুয্যের এক অসাধারণ পরম্পরা সেই মনুসংহিতা থেকেশুরু হয়েছিল,  যার কাল চর্যাপদ বেয়ে যুগে যুগে বদলে গেছে সে আত্মা কত না কতই রূপে প্রকাশিত হয়েছে তার কর্মযজ্ঞ আবার কখনো বা হয়েছে অন্তরি অন্য আরও এক দারুণ অরূপে সাথে আঠারো মাত্রার অক্ষরবৃত্তের দারুণ ছন্দোবদ্ধ বাঁধন দুর্দান্ত এক  অপরূপে বেঁধেছে তারে, অন্তত আমার পাঠের আনন্দে যোগ করেছে এক আনন্দপ্রদ  অসাধারণ মাত্রা-

আপন দীক্ষার মাছি করো, কিম্বা ওড়ার সাধক
সুফলা অনার্যা কবি চেটেপুটে অমৃতের ত্বক
কাহ্নপার জিভ হই সান্ধ্যবোলে ভন-ভন ভন
সাতপুরুষের জমি নেই; চামে এখানে লুণ্ঠন
চর্যার ভিটায় বসে গুম হই গীতল ভুসুক
মরমে পরমটুকু গানে গানে আঠালো থাকুক (পরম্পরা)

এই পরম্পরায় যে কী নেই! জায়গায় জায়গায় অসাধারণ ছন্দোবদ্ধ পংক্তির বাঁধন পুঁজিবাদ নিষ্পেষণ থেকে শণতন্ত্র, শোষ নিপীড়ন থেকে বিশ্বায়্ন অসহায় মানব  মন যাঁতাকলে পিষ্ট মানবের সুকোমল মানবিক বোধ আর সেই মানবিক বোধের ক্রমাগত স্খলন, লুন্ঠ, প্রতারণা কবিতাটির পরতে পরতে মানবিক বিকার আর তার স্বীকারের অ্যবস্ট্রাক্ট সব চিত্র্র আঁকা আঁকা রয়েছে পুঁজিবাদের যাবতীয় নৃশংস হুঙ্কার  আর কান্নার বীভৎস করুণ শব্দ, লালসা আর তার চরিতার্থতার বিচিত্র বিকৃত বিশদ ছায়া আর তার ছবি শক্তিমানের চিরায়ত লোভ, পরের সম্পদ লুণ্ঠন আর আত্মগত করবার ক্রমপ্রক্রিয়ার ফলাফল লোভীর অত্যাচারীর মুখোশ আর তার আড়ালের নিষ্ঠুতার প্রকাশ পদে পদে হয়েছে ব্যক্ত জটিল সাম্রাজ্যবাদ প্রজাশাসন  ধর্মের মাকাল বাক্যবাণীর আস্ফালন তার যাঁতাকলে অসহায় মানুষের দীর্ঘশ্বাস আর আর্তনাদ কী যেন এক অসাধারণ রূপ পেয়ে গেছে এখানে এসে দাদাজানএখানে সিম্বলাইজ হয়েছেন এক আদি আর চির প্রকৃত স্বজাত্যবোধের ধারক হিসেবে-

ডিমের আদলে ঘুম যাও দাদা; ফাটাবোনা এই যাপনের ঘুম - ///
মৃত্যু টানেনা তোমাকে অপার;এখানে হাড়ের নয়া মওসুম///
তামাম দুনিয়া মন্ডু খুঁজেছি, ধুনুচি পুড়িয়ে চেতনার দম- ///
বর্গীবাজার আড়ৎ ডিঙিয়ে গোড়ালি চিনুক তোমার খড়ম///

কিংবা

পশ্চিমে সুরঙ্গ আছে-উন্মুক্ত বাজার/পুবালি সুষমা ঢেলে এত যে বিভোর ডাকো আয় আয়/ধনের পচনতন্ত্রে আজ/মন্ত্র দিয়ে ফুঁক/কিছু দাও সম্পৃক্ত পাঠক/বহতার রক্তে ফিরে অটুট বিদ্যায় লিখি/ক্রম নদী, হালচাষ/বাঁক-ফেরা জলের শাসনে/সাঁকোর দহন লিখি জলধির সমান সমান

আর অবশেষে প্রত্যাশার সুর বের হয়ে এসেছে কোনো একদিন হয়তো মানুষ চিনবে তার প্রকৃত শেকড় আর ধাবিত হবে তারেই পানে-
শুধু যে বিষয়ের গভীরতা কিংবা আন্তর্জাতিক বোধের জটিল টানাপোড়েনে সমৃদ্ধ  পরম্পরা বিশাল শরীর তাই নয়, পংক্তিতে পংক্তিতে অসাধারণ সব জটিল  সরল উপমা রূপক উৎপ্রেক্ষার দারু সুসংহত আর সংযত প্রকাশ এখানে তাঁর  কবিতা পড়তে পড়তে আমার এমনই মনে হয়, উপমা যেন প্রস্তুত হয়ে থাকে কখন বসবে তার কবিতার শরীরে শরীরে আর অলংকৃত হয়ে উঠবে নিজেই দারুণ সব ভিজ্যুয়ালাইজেশন তৈরি হয় যা ড়ার সাথে সাথে মনের কিনারে

একটু দৃশ্যান্তর প্রয়োজন একটি দীর্ঘ-দারুণ-সুখপাঠ্য-দুর্বোধ্য-জটিল কিন্তু অসাধারণ  কবিতা পাঠের পর আমি একটু রিক্রিয়েশন খুঁজি একের পর এক পড়তে থাকি না কবিতার নাম ধরে খুঁজি কোনো পলকা সুখপাঠ্য কিছু নামে পেয়েও যাই এমন এক  পড়তে শুরু করি কিন্তু না তাতেও জীবনের জটিল কিন্তু ধ্রুব কিছু সত্যের আবছায়া দেখি নদী আর নিজের ঘর যেন এক করে ভাবি এই হ্বানে শুরু করি-
নদীকে নিজের বাড়ি মনে করো তখন ভাবতে হবে না যে তুমিও ভাসছ স্রোতের সমান/যদিও আবাস তার-পৃথিবী নিরত ঘুর্ণন বুঝতে পারেনা কেউ/তাই তো অটল থাকে বিবর্ণ বিষাদে সফল ক্ষমায় (ফেরার ইচ্ছে)

মন এই এক তামশাজীবনে মন আর তার কত কত যে রূপ অপরূপ হয়ে উঠেছে  যুগে যুগে কাব্যে আর কবি ভাবনায়! বিপরীত রূপেও কি তা পায়নি অন্য আর এক অবয়ব? অধরা চিরায়ত রাধার যাতনায় কি কৃষ্ণের ছলাকলায়! পেয়েছেলেখা হয়েছে একের পর এক সব কবিতা মহাকবিতা মানব মনে প্রেম আর তার প্রত্যাহৃত যাতনা কী দারুণ বিষাদে রূপান্তরিত হয় এক সবিশেষ আবেদনে তারই মূর্ত রূপ যেন   এই কয়টি পংক্তি-

তার মনে এক নেই/বহুতত্ত্ব মাটির শেরেক/কটাশ কটাশ কাটে বাঁশকাটা পাখি/ঠোঁটে তার মনের পেরেক….(কটাশ কটাশ কাটে বাঁশকাটা পা্খি)

দারূ এক ইমেজ তৈরি করে দেয় এই টি পংক্তি আমার মনে দেখি সেই শৈশবের  চেনা পাখি কাঠ ঠোকরার ছবি তখন লালমাইয়ের পায়ের কাছে আমার বাস উপড়ে পাহাড় নিত্যই ভোরে নীল আকাশ ডানা মেলে ছায়া হয়ে থাকে জীবনের গভীরে সব কিছুতেই কী দারুণ সুন্দর ঝুলানো ব্যালকনিতে দাঁড়ালেই দূরে লালামাইয়ের  ঘনচূড়া, গভীর বন, চোখের সামনে ছোট বড় শিশু গাছ আর বৃক্ষের ঘনসবুজ পাতা  গায়ে আদরের পরশ বুলায় তেমনি প্রদোষে কোনো কোনো মধ্য দুপুরে আমি দেখেছি  কাঠঠোকরার একাগ্র সাধনা নিজের ঠোঁটৈ - ঘন্টা মিনিটের হিসেব বিহীন কেটে চলেছে গাছ কেটে চলেছে কাঠ-আমার অপলক চেয়ে থাকাও তেমনি পার হয়ে গেছে তারে দেখে দেখে কি মধ্যাহ্নে কি অপরাহ্নে বিরামহীন সেই কাঠঠোকরাই আজ সেই সুদূর শৈশব থেকে চোখের সামনে উড়ে আসে ঠো্ঁটে এক নির্মম পেরেক নিয়ে নাম তার মনমন থেকে মনান্তর-এই ব্যাখ্যার অতীত কর্মক্রিয়া মানবের জীবণে বোধে কর্মে কি প্রাত্যহিক দিনযাপনে যে ক্লেশ যে প্রগাঢ় যাতনার বিষ রেখে চলে যায় তার দারুণ দারুণ সব প্রকাশ নানা উপমায় নানা ইমেজে জটিল কিন্তু অসাধারণ সব রূপকে প্রকাশিত হয়েছে কবিতাটির ভাঁজে ভাঁজে

-জল পড়ে/পাতা নড়ে/কবিতার সৌধ ভেঙে রোজ পাথরে খোদাই চিঠি ডাকবাক্সে পড়েনা এমন/আজন্ম ক্ষরণতবু লিপির অঙ্কনে শোক ভালো, ধন্য তবু হৃদয় জখম/শূদ্র ভালো, বৈশ্য ভালো, রক্তে ভালো ক্ষত্রিয় ব্রাহ্মণ; /যবনের আল্লা ভালো, নমঃ নমঃ একক ব্রহ্মায়………..(কটাশ কটাশ কাটে বাঁশকাটা পাখি)

ঠিক তেমনি আর এক শাশ্বত যাতনার বোধ আঁকা হয়ে থাকে দারুণ শব্দে দারুণ রূপকল্পে আমার কাছে যেন ব্যক্তিকেন্দ্রিক এক অসাধারণ স্যাটায়ারের উদাহরণ-

-শুনেছি তোমার মনে পরাণগঞ্জের মধুর কিরিচ/রক্তে ফুলের মৌতাত/গন্ধের বিষ্ময়ে তবু খুনের পাপড়ি/হোক প্রেম, আজ দোষ নেই/ডাগর দুনিয়া ফেটে যাচ্ছে যাক; আত্মার দুহাত বাঁধাপরী, শপথবেলুন উড়িয়ে দিলাম/ফিরে যাবনা অক্ষয় ক্ষতিবিতন্ডা পাড়ায় (পাণিপ্রার্থনা)

আবার ঠিক তারই বিপরীতে একই যাতনার বোধে প্রাজ্ঞ কবিতাটির শরীরে নারীর যাতনা পুরুষের পলিগ্যামি বিভাজিত মনে শরীরের কালিমাখা রূপ আর ভালোবাসার ক্লাসিক রূপে নারীর প্রত্যাশিতের জন্য সাধনার এক দারুন প্রকাশ কবিতাটির দুজায়গায়

-ঔরসের রক্তের মতো যে ছিল আপন, /জান্তব পুরুষের টানে ছেড়ে গেছে বহুদিন

কিংবা

-আবুল কালাম! /মানুষের কলিজা নিয়ে ধাপ্পা খেলে যে নিষ্ঠুর, /অন্তহীন অঙ্কের অকূলপাথার নিয়ে উদ্ধত যৌবনে তারও পড়ন্ত বিকেল নামে/প্রেমের বিনয়ী জল হাতে পরিপূর্ণ মাটির বাসন-/অপেক্ষা করে সে প্রাণের কুকুরী, আহা, আপন মানুষ যদি ফিরে আসে………….

কুকুরীর জন্য সংবেদনা - সত্যি যদি বলি, কবিতাটির নাম শুনে আমি একদম বাদ দিয়ে রাখি পড়ব না বলে কী ভেবে যে আবার কোনো এক ফাঁকে পড়ে ফেলি আর  মুগ্ধ বিস্ময়ে আবিষ্কা করি তার অন্তর্গত গভীর বেদনার এক শাশ্বত রূপ



অবশেষে আসি পুরো কাব্যের নামাঙ্কিক কবিতাটির কাছে ইচ্ছে করেই রেখে দি তারে  সর্বশেষ পাঠের জন্য ছোটবেলায় আমার মাকে দেখেছি যে কোনো গল্প বা উপন্যাসের প্রথমে দুএক চ্যাপ্টার পড়লেন তারপরই শেষের পাতা পড়ে জেনে নিলেন কি পরিণতি এবার শুরু হলো তার আসল পাঠ চুলায় রান্না পুড়ে যায়, বেলা পার হয়ে দুপুর বিকেল, টেবিলে তার ভাতের থালা পড়ে রয়, মধ্যরাতেও তার ঘরে আলো জ্বলে আজও জীবনের শেষ বেলাতেও রাত তিনটে কি চারটে দুচোখে ফ্যাকোর কাটাচেরা তবু বই শেষ না করা অবধি তার নিস্তার নেই আমি সেরকম হতে পারিনি বলে খুব দুঃখবোধ কাজ করে মাঝে মাঝেই আর কারণেই শেষ কবিতাটি আগে আগে পড়া হয় না আমি চাই শেষটুকু রস নিংড়ে আস্বাদন করি সেই রসে মুগ্ধ হয়ে রই সিক্ত থাকি উঠে যা্ই উর্দ্ধতর আরও আরও এক অনির্বচনীয় সত্তায় যতক্ষণ না আসে নতুন আরও এক অসাধারণ কিছু হাতের নাগালে শুরু হলো লখিন্দরের গান হায় খোদা ঈশ্বর ভগবান, তারও কি ছিল জানা একদিন তিনিই হবেন বেহুলা কোনো  এক কাব্য স্রষ্ঠার কাছে আর যাপিত জীবনে তার সৃষ্টিরই সব তারই হাতে নাকাল এক একটি লখিন্দরের আত্মা- আবার তারই সাথে মিলনে পরম প্রত্যাশা নিয়ে দিন রাতের আরাধনা মানব জনমের ১০টি পর্বে লেখা কবিতাটির প্রথম অংশটি পড়ি-

বোধিরা মরেছে আজ কেউটে ছোবল খাচ্ছি বর-
সাঁই তুমি কথা কও, জলে ভাসি এই লখিন্দর
নীলকন্ঠ হয়েছি দেখো, উদোম শরীর দেখো লাশ
আমাকে করেছ পর? কেন শুধু এই পরিহাস?

সুফিবাদী ভাবনায় বেহুলা লখিন্দরের মিথকে মোল্ড করেছেন দারুণ এক কম্পোজিশনে কি ভাবনায় কি প্রকাশে কি রূপক কি কাব্যবোধে সব জায়গায় কবিতাটি এক অসাধারণ মাত্রা পেয়েছে আমার কাছে জীবাত্মা পরমাত্মার মিলনের যে আকাঙ্ক্ষা, যে হাহাকার বৈষ্ণব পদাবলী থেকে শুরু হয়ে সুফি সাধকদের মধ্যে যা চিরকাল প্রবহমান তারই দারুণ সব ধ্বনি প্রতিধ্বনি কবিতাটির পংক্তিতে পংক্তিতে এঁকে চলেছে অসাধারণ সব ছবি যাপিত জীবনের যাবতীয় সরল আর জটিল সবকিছু পাওয়া যায় এখানে চাষী বর্গাচাষে ফসল ফলায় আর জমিদার ভোগ করে, ঠকায় চাষীকে স্বার্থ  উদ্ধার হয়ে গেলে মানুষ ভুলে যায় সব পরের সম্পদে চিরকাল অপরের লোভ সবল চিরকাল দূর্বলকে করেছে লুট দুঃসহ তার শাসন, শোষ পুঁজিবাদের করাল আগ্রাসে  ধীরে মৃত্যুর মুখে দারুণ মানুষ আর সভ্যতা মানুষ ভুলছে তার অতীত সোনালি অতীতের সব কর্ম আর শেকড়ের কথা ভুলে চলেছে কোথায় কোনো এক অসা অনামা পৃথিবীর দিকে সেই সংশয়- কি নেই এখানে লখিন্দরের চিরায়ত প্রতীকে নির্যাতিত মানুষ মানব সভ্যতার আর তার নিষ্পেষণে অসাধারণ চিত্রকল্প কবিতাটির আদ্যোপান্তে

-আমার নিয়েছে সব; তবু বৃষ্টি বয়ে যায়/টিয়ার ঠোঁটের কাছে লাল ভোর সূযের প্রাণের গান গাইবেনা, /এমনতর পাপের নিশানা দেখিনি/সানকির বয়াতি ঢোলক/ভাতের বাজনা খেয়ে ক্ষুধাতুর-এখন দীক্ষিত/বানর নাচার খেলাঘর/বৃষ্টিতে শরীর ধুয়ে নেয়..(লখিন্দরের গান)

কিংবা

পিন্ড মনে খয়রাতি মন আজ ষন্ডা লখিন্দর
কলার ভেলাতে সোনা, পালঙ্কে সন্ন্যাসী, দেহে চট
সেচের প্রকল্পে খরা, নাকি ঝড়? দোটানা চম্পট
সকালে বৈকালি তারা মুখ টিপে বেহুলার শর
হাসি হাসি বাসি ভাতে কেরানির জোড়ালো থাপড়
অঙ্কৃশে জীবন টানে লোহা লোহা শনির হোঁচট
রাজার নৈতিক বলে খুলবেনা মরণের জট-
এমন ভরসা এলে বেদখল! স্বপ্নে যাবে চর

এত এত সব জটিল রাজনৈতিক পতন কিংবা উত্থান উচ্ছৃঙ্খল জীবন যৌবনের অবাধ অগাধ ছলাকলা নিষ্পেষণ বহুমাত্রিক আর বহুধাবিভক্ত মন, মনের জটিল পরিবর্তন দূর্বলের উপর সবলের মাত্রাবোধ বিহীন ক্রম অত্যাচার কেবলই কি নিরাশা জাগিয়ে তোলে? না তা নয় কবি বলবেন আশার কথা কবি ভাঙবেন মিথ্যের জটিল চাই পূর্ণ করার পথ দেখাবেন স্বপ্নের ষোলকলা শাসন করবেন দুঃসহ শাসক ছিঁড়বেন জটাজাল আর আঁকবেন স্বপ্ন স্বদেশ গড়বেন পৃথিবী মনোরম- সেই সুরে শেষ হয়, রুখে দাঁড়ায় নির্যাতিত মন শুভ আরসুন্দরের আজন্ম প্রত্যাশায় আমি পৌঁছে যাই এক দূর্দান্ত সাবলিমিশনে লখিন্দরের গানের পাঠ শেষে শেষ কথা টির রেশ নিয়ে কাটাই বেশ কিছু দিন...

-ক্রন্দসী বেহুলা ঘুমে/সোনার রেকাবে তার এসেছি নোলক/মাছে ভাতে স্বপ্নমোড়া গুপ্ত পুলসেরাত/আমাকে দাঁড়াতে হবে/কেরামান-কাতেবিন, দ্রাবিড় কিতাবে লিখ প্রত্ন-ইতিহাস/-হল্য জীবনচরে এইখানে দাঁড়ালাম ধৃষ্ট লাঠিয়াল:/আমার দখল নেবে কে আছে এমন?

তারপর কতদিন আমি আর কিছুই পড়ি না অলস বিবশ দিন যাপন একেবারে সত্যি সত্যিই এমন এইভাবে একটি একটি দারুণ বই দারুণ কবিতা আমাকে মোহমুগ্ধ করে রাখে, নেশার রেশ কেটে উঠতে আমার সময় নষ্টহয়ে যায়লোকে এই বলে কিন্তু আমি তা অনুভব করি না আমি রসে সিক্ত থাকি, উপভোগ করি, কাঁদি নয়ন ভরে হাসি আনন্দে হৃদয়ে পূর্ণ করি বিষাদে পরিপূর্ণ হয়ে উঠি এক জনমেই যেন ভোগ করি আর এক জন্মের সাধ

তারপর শুরু হয় আর এক নতুন, অশ্রুপার্বণ...
-আমি সেই গান, সেই অধিকলহের নৃত্য জ্বেলে রেখে
খুব এক সঙ্গত নারীকে বলি, এবার আমাকে ছাড়ো
অনন্য প্রেমের নামে সাত পাক ঘুরে আসি পৃথিবী আমার
…………………………………………………………………
যাপনের ধুলো মেখে দাঁড়াও ঘনিষ্ঠ তুমি, আমূল সংস্রব
দেখবে, যৌবন জুড়ে অজস্র গীতল প্রজাপতি বার বার উড়ে আসে
আমিও অধীর ছুটি পিছু পিছু... (গৃহবাউল)

গৃহবন্দী উদাসী বাউল মনের চিত্রকল্প এত সুন্দর এত সুন্দর করে প্রকাশিত যে কবিতায়তা তো কবিতা নয়, যেন মানবের নিষিদ্ধ প্রেম অনুসন্ধিৎসা কামসুশৃঙ্খল মনকে অবদমনের অনন্ত সৌন্দর্য বহনকারী এক গোপন ইস্তেহার সেখানে দারুণ দারুণ সব উপমা রূপকেরও ব্যবহার আমাকে মোহমুগ্ধ করে ঠিক বিপরীতে কিংবা সাধারণত উপমান কিংবা উপমেয় হিসেবে ব্যবহৃত হয় না এমন শব্দ আর শব্দের পর শব্দের সমাবেশ জটিল করেছে কবিতাটির গায়ের অলংকার ঠিক কিন্তু রূপের মধুরতা নষ্ট করেছে বলাই যাবে না বরং যেন সোনার চেয়ে জুড়ে দিয়েছে কন্ঠে হীরের দ্যূতি - আমি এইটুকুই বলতে চাই সবুজ স্বাস্থ্য, শান্তির পশুদল, গোলাপমুখর হয়ে আছে,  মানুষের বিষ, ঘাসমেলা গাছ, মোরগ রঙের কিছু পাখি, সদানন্দ ঘন প্রাণ, দুধেল সঙ্গীত, নৃত্য জ্বেলে রেখে, ধুলো হয় পায়ের ঘুঙুর, গীতল প্রজাপতি... ঠিক এমনই কিছু উপমা রূপকধারণ করে আছে




পথের সাথে জীবনের গভীর সাদৃশ্য পরম ভালোবাসায় জীবণার্পন আর বিদগ্ধ যাতনায় তার প্রত্যাঘাতে হতাশার এক অন্তর্ভেদী রূপ দেখি এখানে কবির কিংবা লেখকের সূক্ষ্ম জীবনবাসনায় জীবন এবং বোধে ক্রমাগতই হতাশা সুন্দরের পাশে  অসুন্দরের অবস্থান তাকে হতাশ করে, প্রচলিত জীবনের বাঁকে বাঁকে মনন্তর তাকে হতাশ করে, সোজা পথে বাঁকা চলন তাকে উদাস করে আর এঁকে চলে পদে পদে তুমুল অভিমান লেখকের তো এমন হবারই কথা্ স্পর্শকাতরতা তারই তো স্বভাব যে সব অনুভব করতে পারে একাগ্রতায় আর যখন হয় আহত তার প্রকাশও তেমনি প্রতুল-

-হাতে ছিল নিরেট বিকেল সঙ্গে হাওয়া সহচর/আজ ভালোবাসা নয়-উপেক্ষা শিখেছি মানুষ অপর করে চলে আসি (পথ)

যতটা সময় ধরে পড়েছি তার কবিতা যাপন করেছি তার সময় ততটা সময় ধরে  কবিতায় এক অসাধারণ বিষয় আমাকে ভাবিয়েছে খুব যে কোনো জায়গায় যে কোনো অবস্থানে যে কোনো বেদনার কিংবা বিষণ্ন যাপনের আঁকা ছবিতে কিংবা রোষে বিদ্রোহে, প্রতিবাদে কিংবা ভৎসনায় বরাবর অসাধারণ করে আশ্রয় নিয়েছেন প্রকৃতিতে তার লেখায় কবিতার পংক্তিতে পংক্তিতে গাছ পাতা ফুল চাঁদ নদী হাওয়া আকাশ কিংবা বাতাস প্রকৃতির নানা রং রূপ আর অনুষঙ্গ মিশে গেছে র্যাপদ থেকে  শুরু করে রাধাকৃষ্ণ পদাবলী অবধি, প্রণয় থেকে ঘৃণা পযন্ত, আল্লাহ থেকে ভগবান প্রেম থেকে স্খলন ছাড়িয়ে দমন কিংবা অবদমন নিপীড়ন শোষ অথবা প্রজাপালনের  মতো জটিল কঠি কাঠখোট্টা বিষয়ও দেখি তার একটি রূপ এই শেষ চুমুক কবিতায়-

-হে বাতাসদেহ, রসনিকুঞ্জের পরপারে বেদন-বৃষ্টির পরিচারিকা, তুমি কি ভাববে, আমিও জীবনের বিফলে উত্তাপে অপারগ/লাটিম ঘুরাচ্ছি শুধু শুধু? /যেন আমি কাঁদাখোচা পাখি; /সোনাবউ খুঁজছি কাঁদায়?

কিংবা

-বোধি প্রেমের মধুনারায়ণ, দেখো, কবরের কাছে এলে/আমাকে জড়িয়ে ধরে পলাতক প্রফুল্ল নিশীথ; /দেখো, ঝোপঝাড় বাতাসে নির্ভার জেগে থাকে; /সারারাত কেটে যায় জোনাকির পেটভরা আগুনের হল্লা দেখে দেখে অসাধারণ ক্ষিপ্রতায় তিনি জন্মের আনন্দ কিংবা মৃত্যু অথবা মৃত্যু দিনের আসঙ্গ লিপ্সা কিংবা যাতনার রূপকে অসীম প্রাণবান করে তোলেন প্রকৃতির নানা উপাদানের সমাবেশে-

-দাদীর মৃত্যু দিনে আমিযে-গান গেয়েছিলাম; সকল সংক্রান্তি ব্যর্থ হয়ে গেলে/তাকেই আলোর মতো ধরে রাখি; বলি মায়ানারী/বিপুল বয়সী তুমি সোনার কাছিম (জলাঞ্জলি)

প্রাত্যহিক জীবনে পরিবার থেকে রাষ্ট্রে ঘর থেকে পথে সংসার থেকে রাজনীতিতে প্রেম থেকে ঘৃণায়, কোথায় না তিনি প্রকৃতির খুব ছোট আর সাধারণ উপাদানগুলোকে ব্যবহার করেননি-

-আমাদের ঘরে ঘরে হিড়িম্বা, রাবণ/প্রলম্ব নির্জনে বসে মহাজাগতিক,/সংকল্প হানছে রোজ; যেন কান্না প্রকল্পিত উলঙ্গ লিপ্সায়/ওরা খুব স্বপ্ন ভেঙে দেয়/তবে কি আমিও অলীক খাঁচার ভরকেন্দ্রে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মৌচাক দেখছি শুধু?/কখনো অনেক লাল পিঁপড়ের বাসাবাড়ি, নিম লেবু আর চড়ুইয়ের বাসা? (কথাসৌধমালা)

জানিনা, কেন? বারবারই স্বীকার করি আমি, আমার পাঠের দীনতা তবু এক দারুণ অনুভব আমার মধ্যে কাজ করতে থাকে কাজি নাসির মামুন পড়তে পড়তে পাঠের দীনতাটুকু স্বীকার করে নিয়েই বলি, বিভূতিভূষণে প্রকৃতি প্রেম আর তার লেখনী  আমাকে নিয়ে চলে প্রকৃতির কাছে সবুজ আর স্নিগ্ধ হয়ে উঠি তাঁর কবিতা কিংবা গল্প পড়তে পড়তে কাজি নাসির মামুনেও প্রকৃতির ব্যবহার শুধু যে কবিতায় কবিতায়তা বললে কম বলা হবে প্রকৃতি আর উপমা রূপক তার কবিতার পরতে পরতে যেন এক কবিতা বেয়ে উপচে পড়ে যায় অন্য কবিতায় কিন্তু সেখানে আমার অনুভব বিপরীতে অবস্থান করে বিভূতিভূষণে লেখা থেকে এখানে মনে হয়  প্রকৃতি আমাকে তার স্নিগ্ধ কোলে টেনে না নিয়ে নিজেই উঠে এসেছে এই জটিল কঠি বীভৎস নিপীড়ক শোষিত ডাকাত জীবনে-প্রেমে বিদ্রোহে বেদনায় কামে বিবাদে বিভাসে বিবিধে কখনো হয়ে উঠেছে দারুণ স্বেচ্ছাচারী তার অমরতায় কখনো উদ্ধত তার বিক্ষুব্ধতায় কখনো প্রেমময় তার স্নিগ্ধতায় কখনো রুদ্র তার সংক্ষুব্ধতায় কখনো উত্তাল তার মত্ততায় আবার কখনো নিরীহ নীরব ধ্যানমৌন তার গভীরতায়-পাঠে তৈরি করেছে আমার মধ্যে এক দারু নীরব উন্মার্গ অধিরম্য আবাস

শত শ্রদ্ধা কবির এই অসাধারণ সৃষ্টির প্রয়াসকে সুশৃঙ্খল অনুশীলনে যা ঋদ্ধ করেছে আর করেও যাবে, আমার বিশ্বাস, বাঙলা সাহিত্যের ইতিহাসকে ভালোবাসা আর  অজস্র প্রণাম জানাই তাঁকে বারে বারে  


0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন