কালিমাটি অনলাইন

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

শুক্রবার, ২৫ নভেম্বর, ২০১৬

অপরাহ্ণ সুসমিতো

অমঙ্গলে মঙ্গল


সকাল বেলাটায় যখন ভোর রাতের শীত দূরের ট্রেনের মতো পালাতে থাকে খামচি মারা রোদের আগমনে, তখন তাকে প্রচ্ছন্ন সকাল বলা যায়।

এরকম প্রচ্ছন্ন সকালে মঙ্গলজানের কাজে আসতে ইচ্ছে করে না। আবার ঘুমোতেও যে ভালো লাগে, তা নারায়ের বাজার বস্তি বেলা পর্যন্ত ঘুমোনোর জন্যে আরামদায়ক   না। মঙ্গলজান জিগাতলার বাসা থেকে পাওয়া ম্যাজেন্টা রঙের জামাটা পরে কাজে চলে যায়। এই ম্যাজেন্টা রঙের ছোট কামিজে ওকে বেশ সুখী সুখী দেখায়।

মঙ্গলজানের জন্ম মঙ্গলবারে বলে ওর নাম মঙ্গলজান। রায়ের বাজারের চ্যাংড়া ছেলেরা কেউ কেউ ওকে সুর করে শুধু জান বলে আহ্লাদ করে। সে এসবে মাইন্ড করে না আজকাল। গা সওয়া আলগা পিরীতি...

এই বাড়িতে তার ২ ঘন্টা কাজ, মাস শেষে ৩ হাজার টাকাশুরুতে না বললেও এখন দেখা যাচ্ছে একটু বাড়তি মসলা বাটা, অতিথি আসবে বলে একগাদা তোলা বাসন ধুইয়ে নেওয়া, ছাদে রাখা গাছে পানি দেওয়া, এমনকি মুদি দোকানে যাওয়া, বাড়ির কর্ত্রীর চুলে তেল দিয়ে দেওয়া এসব কাজও তাকে করতে হয়। প্রতিদিনের ঘর  মোছা, বাসনমাজা, মসলাবাটা, রুটি করা, কাপড়কাচা তো আছেই বাই ডিফল্টতাতে মঙ্গলজানের বাধে না। তার মতো সুঠাম শরীরের মেয়েমানুষ এসব ফ্ল্যাটবাড়িতে দেখা যায় না।

নাজিরগঞ্জে থাকতে স্বামীর ঘরে মঙ্গলজান কত কাজ করত, তা এরা ভাবতেও পারবে  না। এই ফ্ল্যাটবাড়ির কাজ সে তুলনায় তার মামুলি লাগে। তবুও মাঝে মধ্যে এবাড়ির কর্ত্রী যখন চিৎকার করে তাচ্ছিল্যের স্বরে ধমকায়, একই কাজ আবার শুরু থেকে করায়, বারবার হাত ধুয়ে নিতে বলে - যেন তার হাতে ডাস্টবিন; তখন ওর  অসহায় লাগে। মনে হয় এক ঝটকায় সব ফেলে নাজিরগঞ্জের ভাষায় পাল্টা জবাব দিতে। সংসার করা এই ইট পাথরের মানুষ কী জানে! সংসার কি সে করেনি, করেনি স্বামীর সংসার?

কিন্তু সে সামলে নেয়।  

আরও কয়েক মাস তার সামলে চলতে হবে। যেন গর্ভের প্রাথমিক কয়েক মাস। জিগাতলার আপা কথা দিয়েছে ওই অফিসে একটা কাজ নিয়ে দেবেঅফিসের ডেস্ক পরিষ্কার, চা বানানো আর দুপুরের রান্না। চাকরিটা পাওয়া মাত্রই সে এই কাজ ছেড়ে দেবে। ভেবে রেখেছে, ম্যাডামের মুখের উপর এই চাকরবাকরের কাজ সে ছুঁড়ে দেবে।

প্রায়ই তার কাজে মন নেইরুটি সেঁকতে গিয়ে হাত পোড়ে, বাসন মাজতে গিয়ে একটা দুটো ভাঙেসে অবশ্য ভাঙ্গা কাপ পিরিচ প্লেট চটজলদি সরিয়ে ফেলে। জিজ্ঞেস করলে বলে দেয়, সে দ্যাখেনি। এমন অভিনয় করে যে, সে আকাশ থেকে পড়ল মাত্র। একটু পরেই নিজে নিজের অভিনয়ে মুগ্ধ হয়। কল থেকে দীর্ঘক্ষণ পানি পড়ার শব্দে এক ধরনের মোহ থাকে, অতীতমুখী টান থাকে। মঙ্গলজানের নিজেকে হিন্দি সিরিয়ালের ছোট কামিজ পরা সেই নায়িকার মতো লাগে।

ম্যাডামের ছেলেটা যখন আড়চোখে ওর দিকে তাকায়, তখন ওর গা ঘিনঘিন করে।  আরো যন্ত্রণা হলো ম্যাডামের স্বামীও ওকে দেখলে ‘চোলিকা পিছে কেয়া হ্যায়’ সুর তোলে। ঘর ঝাড়তে ছেলেটার ঘরে ঢুকলে ভয় করে। আবার ভাবে কাজের বাসায় এরকম একটু হয়ই।

টোটার কথা মনে হয়কী করছে টোটা এখন? নতুন বউয়ের সাথে সংসার টিকলো  তো? গাড়ি চালানোর চাকরিটা আছে? টোটা মঙ্গলজানের ১০ বছরের সংসার ছিল। শেষের দিকে কী যে হলো, প্রায়ই গায়ে হাত তুলতে শুরু করলবাজার করে  না, রাতে বাসায় ফেরে না, বাচ্চাদের জন্যেও কোনো টান নেই। শেষমেশ একদিন বিকেলে নতুন বউ নিয়ে হাজির

মঙ্গলজান বিলাপ করল, বাচ্চাদের দোহাই দিয়ে বিলাপ। তাতে বিশেষ লাভ হলো না। পাড়ার মুরুব্বিরা এসে বলল সতীনের ঘর এত বিলাপ করার মতো ব্যাপার না।  সবাই বলল মানিয়ে নিতে। সে তখন নাজিরগঞ্জের মূর্খ মেয়ে, সতীনের ঘর ছেড়ে কোথাও যে চলে যাবে, সে অসম্ভব। তার আর যেতে হলো না। মাস ছয়েক পর  ওরাই ব্যবস্থা করল। মঙ্গলজান দুটো বাচ্চা আর নিজের লম্বা সুঠাম শরীরটা নিয়ে বাপের বাড়ি হাজির হলোসবাই হায় হায় করে উঠল। সে শোক সপ্তাখানেকের মাঝে  শেষ

তিনজনের খরচ যোগানো তালাক পাওয়া মেয়ের থেকেও কঠিন। মঙ্গলজান তার  একমাত্র সম্পত্তি শরীরটা নিয়েই ঢাকার পথে পাড়ি জমালশুরুতে ভেবেছিল পারবে না এত বড় শহরে এত মানুষের শহরে সে টিকে থাকতে। তিন বছর এরই মধ্যে পার  করে দিয়েছে। বাড়িতে টাকা পাঠাতে হয় নিয়মিত। শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে কাজ করতে শুরু করে। সেবার টাইফয়েড হলো, তাতেও সে কাজ ছাড়েনিকাজ ছাড়লে  তার চলবে না। কিন্তু এত কিছুর পরেও এ বাড়ির ম্যাডামের ছেলে, জিগাতলার আপার জামাই, রায়েরবাজার বস্তির নেতা সালাম এদের কারো আড়চোখে তাকানো থেকে রক্ষা হয় না।

নদীর মাছের মতো সে ভেসে থাকে শহরের মানুষ নদীতে। চারপাশের কিলবিল মানুষ যেন সকাল সন্ধ্যা হাতে মাছ ধরার জাল নিয়ে ঘোরে। কেউ কেউ টোপ দেওয়া বড়শি।

মঙ্গলজানের দুপুরের কাক, অবেলায় ম্যাডামের ছেলে দরজা বন্ধ করে কি যেন করা, এই ছেলের বিছানার তোষকের নিচে ধারালো চাপাতি, বিকালের ফুস করে শব্দবিহীন চা, প্রাক সন্ধ্যায় ঢল ঢলানো ম্যাডামের গা মালিশ আর এত মানুষের এত লোভ!

কই টোটা তাহলে নতুন বউ আনল যে!

টোটার কথা মনে আসতেই ওর গা গোলাতে শুরু করেশরীরের মাংসপেশী দুর্বল ঠেকল। হনহন করে ম্যাডামের ছেলের ঘরে গিয়ে হাতের ঝাড়ু ফেলে মঙ্গলজান শীতল চোখে জিজ্ঞেস করে-
: ভাইজান আমারে কি খুব খারাপ দেখা যায়?


0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন