কালিমাটি অনলাইন

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

শুক্রবার, ২৫ নভেম্বর, ২০১৬

তুষ্টি ভট্টাচার্য

শ্যামাপোকা 




এক গোপন প্রেম আছে আমার। শ্যামাপোকার সঙ্গে। অবশ্য গোপন বলাও চলে না ঠিক একে। প্রতি বছরই এই প্রেমের কথা কাউকে না কাউকে বলে ফেলি। তাই অতটা গোপন আর নেই বোধহয় এই প্রেমটা। শ্যামাপোকা নামটা অবশ্য আমার পছন্দ না। কালীপুজোর আগে আসে বলে হয়তো এই পোকাদের এমন নাম রাখা  হয়েছে, উপযুক্ত নামও হয়েছে। তবু কেন জানি আমার ভালো লাগে না। শ্যামা  নামটার মধ্যে ওই যে একটা ঠাকুর ঠাকুর গন্ধ, তার জন্যই বোধহয়। ঠাকুর থাক না তার জায়গায়, উচ্চ বেদীতে! এরা তো আর ঠাকুর হতে আসে নি! সবেতেই ধম্ম  ধম্ম ভাব দেখানো একটা বাতিক বাঙালির।
  
প্রথম আকর্ষণ জন্মালো অবশ্যই এর রূপ দেখে। অনেক অনেক বছর আগের কথা- হঠাৎ পিন ফোটার মতো গায়ে কী একটা এসে পড়ল লক্ষ্য করলাম। ঠিক পিন  ফোটার মতো তীব্রতা নেই – যেন একটা শোলার পিন এমনটাই মনে হলোতাকিয়ে  দেখলাম একটা খুব ছোট্ট আর চঞ্চল পোকা। রঙ কিছুটা কালচে। পরক্ষণেই উড়ে গেল আলোর দিকে। দেখলাম ওকে ঝাঁকে মিশে যেতে। আর তখনই মনে হলো, গায়ের রঙটা কালচে নয়তো! সবুজ। আর সবুজের মধ্যে কালো কালো টিপ  কয়েকটা। আর সেই জন্যই বুঝি সবুজ রঙটা না বুঝে কালচে ভেবেছি। এত ছোট লম্বাটে বিন্দুর মতো সবুজ এর আগে তো আমি দেখি নি! তারপর দেখলাম এই  পোকাদের ঝাঁক কেমন আলোর চারদিকে ঘুরে যাচ্ছে নাচের ছন্দে। আলো নিভিয়ে দিলেই এরা পালিয়ে যাচ্ছে অন্যখানে। বেশিরভাগ আবার অন্ধকার হলেই মরে ঝরে পড়ছে মাটিতে।



ধীরে ধীরে জানলাম এই শ্যামাপোকাদের ইংরেজিতে বলে ফায়ার ক্যাচার। সত্যিই তো, আগুন ধরতে যায় বলেই যেন এদের আগুনে পুড়ে মৃত্যু হওয়াটাই নিয়তি। হেমন্তকাল এলে এদের আসার সময় হয়। তার আগে বর্ষার সময়ে এদের ডিম ফুটে লার্ভা, পিউপার কালক্রম পেরোয় ধান বা ঘাস জাতীয় গাছের পাতায়। সবুজ ঘাসে জন্মায়  বলেই হয়তো এরা এত সবুজ! সবুজে জন্ম, সবুজে বেড়ে ওঠা বলেই বুঝি সবুজ রঙ  ছাড়তে পারে না। চিরসবুজ থেকে যায়। আর যে বছর বেশি বর্ষা হয় বা বর্ষাকাল প্রলম্বিত হয়, সে বছর যদি ধান বা ঘাস জমি জলে ডুবে থাকে তাহলে শ্যামাপোকাদের কম দেখতে পাওয়া যায়। কারণ এদের ডিম ফুটে বাচ্চা হতে আর্দ্রতার সঙ্গে সঙ্গে চাই রোদের তাপ। হেমন্তে আর্দ্রতা হারালে এদের তাগদ বাড়তে থাকে। আর রাত নামার পরেই এই সবুজ পোকারা কুয়াশার হাত ধরে আলো লক্ষ্য করে ছুটে যায়।

এই শ্যামাপোকার নাম আমি বদলে দিয়েছি। আমি ওদের আহ্লাদী বলে ডাকি। বড় বেশি গায়ে পড়ে সোহাগ জানায় যখন তখন। তাই ওই নাম দিয়েছি। আর আদরের কোনো ছিরি ছাঁদও নেই এদের। কখন চোখের মণিতে চুমু খেতে আসে, কখন   জামাকাপড়ের ভেতরে সেঁধিয়ে গিয়ে অসভ্যতা করে... ছি ছি... বড় বেহায়া সব!  শুনেছি মেক্সিকোতে এদের নাকি ল্যাম্পপোস্টের তলা থেকে কুড়িয়ে নিয়ে বাজারে বিক্রি করে লোকজন। তারপর ভেজে খায়। আমারও এমন ইচ্ছে যে মাঝে মাঝে হয় না, তা বলি কী করে! ইচ্ছে করে এই আহ্লাদীদের ভেজে পাঁচফোড়নের সঙ্গে মিশিয়ে ছয় ফোড়ন করে রান্নায় ফোড়ন দিই। একটু তো স্বাদ বদল হবেই! তবে মুখের ভেতরও  তো এরা কম সেঁধোয় নি! তাই দেখেছি, তেমন কোনো স্বাদ এদের নেই। তাহলে না হয় নুন মরিচ দিয়ে মেখে নেব!


সেদিন সন্ধ্যেবেলায় কী মনে হলো, শ্যামাপোকাদের আসরে গেছিলাম অযাচিত হয়ে। দেখছিলাম মানুষের তৈরি করা কৃত্রিম আলো ঘিরে ওদের উন্মাদ নৃত্য। একটু বাদে আলো নিভে গেলে যে ওদের অস্তিত্ব থাকবে না সে ব্যাপারে সম্পূর্ণ উদাসীন। যেন এই নাচটুকুই ওদের জীবন। ওরা সূর্যের আলো দেখে নি। ওদের অন্ধকারও দেখতে হয় নি। তবু ওদের এই সামান্য জীবনে কোথাও কৃত্রিমতা নেই। মানুষ অন্ধকারকে চিনেছে। তাই যখন তখন আলো নিভিয়ে দিতেও ভয় পায় না। মানুষের হাতে তৈরি আলোর রকমেরও শেষ নেই। তবু কৃত্রিমতার পাকে পাকে জড়িয়ে গেছে মানুষের জীবন। আলো আমাদের যতই মুগ্ধ করুক না কেন, আলো ঘিরে অমন উন্মাদ হয়ে নাচতে পারব না। আমাদের খুশি, আমাদের আনন্দ, আমাদের কান্না, সবই এখন ঢেকেঢুকে রাখতে হয়। অসম্ভব লাগে অতি প্রকাশ্য অনুভূতিদের। আবার যারা অতি প্রকাশ্য, যেমন সাজগোজ বা পার্টির তুমুল উন্মাদনা, তাকেও দেখনদারী ছাড়া আর কিছু ভাবতে পারি না আমি

তো, সেই প্রথমে যে কথা বলছিলাম, আমার আর আহ্লাদীর প্রেম নিয়ে, সে প্রসঙ্গে  আসি। এখন হেমন্তের প্রথম যে সন্ধ্যেয় ওকে প্রথম দেখি, মনটা ব্যাজার হয়ে যায়। মনে মনে ভাবি, নাও হয়ে গেল! আবার চলবে একমাস ধরে এদের অত্যাচার। আস্তে আস্তে ওদের দল ভারী হতে থাকে। আমিও যেন মনে মনে দল পাকাই। ওদের সঙ্গেই। ওদের সঙ্গেই মনে মনে নাচতে থাকি আলো ঘিরে। ঘুরে ঘুরে। এ এমন একটা আবর্ত, যার পাকে ঢুকে গেলে আর বেরনো যায় না। ঘুরতে ঘুরতে মাথার মধ্যে একটা মহাকাশের কক্ষপথ ঢুকে পড়ে। আমি যেন একটা অনামী ছোট গ্রহ, সূর্যকে ঘিরে নিঃশেষ হওয়া পর্যন্ত চলবে আমার এ ঘূর্ণন। আমার নিজেরও একটা মেরুদন্ড আছে, যাকে ঘিরে আমি রোজ একবার ঘুরি, আর এই নিজেকে ঘোরাতে ঘোরাতে চলে আমার প্রদক্ষিণ। বেশ ভেসে থাকা যায় এভাবে। কোনো ক্লান্তি নেই, কোনো বেদম  হওয়া নেই। শুধু একটা আফসোস জাগে। যখন দেখি অনেক গ্রহের উপগ্রহ আছে, আর আমারই কেবল নেই... খুব ফাঁকা ফাঁকা লাগে। এক অসীম শূন্যে ঘুরতে ঘুরতে যেন আরও বেশি করে শূন্য হয়ে যাওয়া।


এভাবে চলতে চলতে কখন যেন কালীপুজো এসে যায়। বেদম বাজি পুড়তে থাকে। আলোর রোশনাইয়ে আমরা অন্ধকার দূর করি। সেই দীপাবলী আমাদের জীবনে আলো আনে, আর আমার আহ্লাদীদের জীবনে ডেকে আনে অন্ধকার। তারপর দিন থেকে ওরা হারিয়ে যায় আবার এক বছরের জন্য। আমার শূন্যতা আরও বাড়তে থাকে। দেওয়ালে ঠেস দিয়ে আলোর দিকে চোখ মেলে দাঁড়িয়ে থাকি, আর মনে মনে বলি, কই রে আয়... আমার চোখের মণিতে একটা চুমু দিয়ে যা! কিন্তু ওরা ততক্ষণে ফুরিয়ে গেছে। আমার খুব রাগ হতে থাকে নিজের ওপরেই। ভাবি কী বোকাই যে আমি! এই পোকাগুলো বিদেয় হলে লোকে শান্তি পায় আর আমি উল্টো কথা ভাবছি! আর তারপর... তারপর আবার সব ভুলে গিয়ে নিজের চক্রে ঘুরে চলা। এখানে কোনো কক্ষপথ নেই। কোনো ভেসে থাকা নেই। অনেকটাই চোখ বেঁধে কলুর বলদের  তো, ঘানি টানার মতো এই চক্র। তারপর একদিন এক কুয়াশা মাখা ভোরে যেদিন  আকাশে প্রথম দেখতে পাই, কয়েকটা কালো বিন্দু আবছা আলোর মধ্যে ভেসে যাচ্ছে, বুঝতে পারি শীত আসছে আর পরিযায়ীরা এসে পড়ল তাই। এরা আমার আহ্লাদীর মতো কাছে আসে না, কিন্তু ভোরবেলা এদের খুঁজতেই আমি আকাশ দেখি। যেদিন  দেখতে পাই, ভাবি এরা আমার সেই আহ্লাদীরাই। বড় হয়ে গেছে বলে আমায় চিনতে পারছে না। না চিনুক, আমি তো খুঁজে পেয়েছি ওদের



   

0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন