কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

শুক্রবার, ২৭ মার্চ, ২০১৫

সুবীর সরকার

হেরম্বচরিত




শ্রীহেরম্বচন্দ্রের একাকীত্ব

হাট আবহমানের। হাট চিরন্তন। হাটের কোলাহল থেকে সরে এসে হেরম্ব নেমে যাচ্ছে মাঠঘাটের ভিতর। দোলাজমি অতিক্রম করছে সে। অতিক্রমণের নির্দিষ্ট কোনো  মাপকাঠি না থাকলেও দ্রুতগামী হবার সমূহতর সম্ভাবনা হেরম্বকে তাড়িত করে। একা হতে হতে একসময় সে একাকীত্ব সংশয় ঝড়জল ও ঘামের নোলকঝোলানো মদিরতায় মেদুর সত্যকথনের পাশে গলা ঝাড়ে। ফাঁকা ফাঁকা পাথারবাড়ির পথ ভাঙতে ভাঙতে কাশিয়াঝোপ ভাবনাবন আল আলি গলিপথ সরাতে সরাতে একসময় জাতীয় সড়কের মসৃণ ঝকঝকে পিচপথে উঠে পড়ে। এইভাবে ঘটনার কালপরিসীমা দ্রুততায় অতিক্রম করতে করতে হেরম্ব হাওয়ার বিরুদ্ধে নিজস্ব এক শোকসংগীত রচনা করতে চায়। যদিও জলাভূমির আবেষ্টনী তাকে আটকে রাখতে চায়। অথচ অবিচল নির্বিকার হেরম্ব  জলাভূমির পাশে পাশে, একদা মহিষেরা গা ডুবিয়ে থাকতো যেখানে, আশ্চর্যতায় হেঁটে  যেতে থাকে। হাটপর্ব অতিক্রান্ত না হলেও আগামীর কোনো আসন্ন ঝড়জলক্লান্ত হাটের  অভিমুখেই হয়তো অনির্দিষ্ট এই যাত্রাপথ। পথ পথের মতো, পথের টানেই এগিয়ে যাওয়া। সাবলীল হতে পারাটা অসম্ভব, তবু হেরম্ব মাদকতাময় হেঁটে যেতেই থাকে। হেঁটে যাবার ভঙ্গীতে আদ্যন্ত এক জীবন ধরা থাকে, তবু নদীতীরবর্তী অঞ্চলগাঁথায় সুরতাললয়হীন ব্যপ্ততায় কবেকার সব হাটবন্দরের প্রচ্ছায়া এসে জড়ো হয়। জমাট বাঁধে, যদিও নদীমাতৃকায় পলিমাটিপীড়িত এক সমাহার এসে, যাবতীয় অন্ত্যজ  উপকরণের ঢেউভাঙা আবিলতা এসে আবহমানতা লিখে রেখে যায় আর নকশাচাদরের অনবদ্যতা এড়িয়ে দিনের পিঠে দিন যায়, অতিক্রান্ত হয়। যদিও কাদামাটিলেপা জীবনের গভীরে স্পর্শযোগ্য বিভ্রম এসে যুক্ত হতে থাকে আর দ্বিধাদ্বন্দ্ব এড়িয়ে পুনর্বার  আকাশমাটিজলের তীব্র সহাবস্থান নিয়ে সংহত হতে থাকে কত রকমের সব হাট।


বর্মণটাড়ি



হেরম্ব কি উপকথা মিথ ভেঙে আসা মানুষ? তবে কেন সে হাটে হাটে নদী নালা মাঠে মাঠে ঝোপঝাড়ে ঘুরে বেড়াবে! আত্মপরিচয় খুঁজতে খুঁজতে ক্রমশ সে এক সংকটের আবর্তে জড়িয়ে যাবে। কত কত মানুষ, প্রান্তিক ধানপথ, রোদবৃষ্টির কোরাসের মধ্য দিয়ে তার ধারাবাহিকতা না থাকা ধারাবাহিক আত্মভ্রমণ। একটা পর্বে সে চরাঞ্চল পেরিয়ে যায়। মোল্লাবাড়ির দিকে এগোতে থাকে। চাষাবাদে ব্যস্ত সব মানুষজন তাকে চোখ তুলে দেখলেও দেখার ভিতর ব্যস্ততা বা বিভ্রম থাকে না, যেন চিরচেনা দৃশ্য যে রকমটা কাছেপিঠের সব হাটেই হয়। অভিজ্ঞতার ভিতর দাঁড়িয়ে থাকাটা বড় কথা নয়। অভিজ্ঞতার দিকে ভেসে যাওয়াটাই সারসত্য। ভিতরবাড়ির এগিনা হোক, বাহিরের খোলান হোক, সে সব মুখ্য নয়; মেয়ে বউরা ধান ঝাড়ে ঢেকি পাড় দেয় চিড়া কোটে, ধান সেদ্ধ করে গুনগু বা সমবেত গানও গাইতে থাকে  কখনো প্রান্তসীমায় আকাশ ভেঙে নেমে আসা বৃষ্টির মতো, এসবই চিরকালীন, প্রদীপ্ত। প্রদীপ্ততার আবেশটুকুও লুপ্ত হয়ে গেলে আর কিছুই ধারেকাছে থাকে না। হেরম্বের যাত্রাপথে কিছুই কি আলোড়ন তোলে না? দ্বিধাহীন নির্বিকার হেঁটে যাওয়াটুকু থাকে তার। মসজিদ, বনভূমি, হাইরোড, কবরখানা, চা-বলয়, আদিবাসীপাড়া, পূর্ববঙ্গ কলোনি, বর্মণটাড়ি, পর্যটক, কাঠের বাড়ি, জোড়া শিমুলগাছ -- সব, সবকিছু সে অতিক্রমণ করতে থাকে দু’দশ একশ দুশ বৎসরের কালখন্ডে সে তার সমগ্র   অতিক্রমণটুকু ধরে রাখতে চায়। হেরম্ব কি ক্লান্ত হয় না! খেজুরপাতার চাটাই বিছিয়ে তার কি জিরিয়ে নেবার সাধও জাগে না! বিষাদের বিষণ্নতার, অবসর থাকা না থাকার পৌনঃপুনিকতায় মেঘগর্জনসম বর্ষানদীর প্লাবনপর্ব স্মৃতিবিস্মৃতি হয়ে জেগে থাকতে চায়। উপকথা মিথ ভেঙে হেরম্ব কেবল হেঁটে যেতে থাকে বাঁশবাড়ি লাইন, কলাবাগান, পাইকারকুঠি, ধানকল, কামতাপুরের মিছিল ওঠা কোনো এক হাটগঞ্জের দিকে।

মেঠো ইঁদুর



সমস্ত কিছুর ভেতর হেরম্ব থাকে। থাকা না থাকবার উপকথার শূন্য এক বৃত্ত রচিত হয়। যেন বাস্তব থেকে পরাবাস্তবতার দিকে চলে যাওয়া। যাওয়া বলে কিছু হয় না, হতে পারে না। অনেক অনেক নদী অনেক অনেক মানুষজন মিলে এক ধরনের যাদুবাস্তবতা তৈরি করে। হেরম্বকে কিঞ্চি উঠে দাঁড়াতে হয়। দাঁড়াবার ভঙ্গিটা ঠিকঠাক হয় না, এটা সে বুঝতে পারে। আর অতিসত্বর হাঁটা শুরু করে। গন্তব্য ঠিক না থাকলেও আসলে সে কিন্তু এক ধরনের গন্তব্যই প্রত্যাশা করে। উপকথা ভেঙে ভেঙে মিথের ভিতর আত্মগোপন করা আর ইচ্ছে সত্বেও হয় না। কেবল মাঠঘাট, ঘরবাড়ি, গাছপালা, ঝোপঝাড় এসবের সম্মিলনে জীবন খোঁজবার চেষ্টা। জীবন আদতে কি? আদিঅন্তহীন এক ভ্রমণসংগীত! হেরম্ব হেঁটে যায়, হেঁটে যেতে থাকে। এটা কি আত্মভ্রমণ! জীবনের অর্থ খোঁজার আপ্রাণ প্রয়াস! পুরনো সময় থেকে ঘোড়াদল ছুটে আসে, বিরতিপর্ব শেষ হতেই বিস্তৃতি ফুরিয়ে বিস্তৃতির ঢালেই নেমে যাওয়া। গন্তব্যহীন অফুরান সময়যাত্রায় তালগোলপাকানো পরিপার্শ্বটুকু উজ্জ্বলতর হয়ে উঠতে পারে এমন সম্ভাবনা দুঃখকষ্ট ভাঙতে ভাঙতে এগিয়ে আসে। অগণন পাখি ওড়ে। গান ভাসে বাতাসের ভিতর। উপকথা দুমড়ে মুচড়ে খাবি খাওয়া মাছেদের মতো মৃতপ্রায় হয় আর আকাশ ভেঙে উপচানো আলো তার সময়যাত্রার প্রাথমিকটুকু সীমায়নে বাঁধা পড়ে; তবু মশামাছির দুর্গন্ধময় উপকথায় ধারালো অংশটুকু কখন যে ধারালো বল্লম হয়ে হত্যাকান্ডের মতো উদ্যত হতে চায়, সেকথা হেরম্ব জানে না। সে কেবল পারিপার্শ্বিকতায় হাতড়ে বেড়ায় মহামহিম এক জীবনগাথা। স্বপ্নবৃত্তান্তের পর্ব থেকে পর্বান্তরে বৃত্তান্তের হাঁসগুলি মেঠোপথে নেমে আসে, মেঠো ইঁদুরের সাথে এক আবশ্যিক সান্নিধ্যতায়। এরকমভাবে বৃত্ত ভাঙা, বৃত্তরচনার খেলা চলতে থাকে। সমস্ত কিছুর ভেতর হেরম্ব থাকে, তাকে থাকতেই হয়; সে থেকেই যায়।





0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন