কালিমাটি অনলাইন

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

শুক্রবার, ২৭ মার্চ, ২০১৫

তুষ্টি ভট্টাচার্য্য

তাপসী  



নীতার ব্যাগে মাত্র একশোটা টাকা পড়ে আছে। এদিকে এত বড় একটা লিস্ট নিজেই করে এনেছে মুদির। কম করেও আড়াইশোর ধাক্কা। শুধু শুধু ওই মেয়েটার পাল্লায় পড়ে একগাদা বাজে পয়সা খরচ হয়ে গেল! এই মুহূর্তে কোনো দরকারই  ছিল না ওই বডিস্প্রের। আর এই সেল্‌সের মেয়েগুলোও হয়েছে মহা ধড়িবাজ, ঠিক গছিয়ে দেবেই! তবে নীতাকে বোকা বানানোর ক্ষমতা আজ অবধি কোনো সেলস্‌  গার্লের হয়নি। এই মেয়েটা যখন ওকে দিদি বলে ডাকলো, ওর গলা শুনে কেমন যেন চেনা মনে হলোওর দিকে তাকিয়ে কী অদ্ভুত ভাবে মনে পড়ে গেল নীতার  ছোটবেলার বন্ধু তাপসীর কথা। অবিকল তাপসীর মুখ!

কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে রইল মেয়েটির দিকে। কি যেন একনাগাড়ে বলে যাচ্ছিল মেয়েটা। নীতার সামনে তখন স্কুলে যাওয়ার রাস্তা, বিকেলের খেলার মাঠ দুলছিল। সম্বিত ফিরলে দেখল, ওর হাতে বডি স্প্রের বোতল। “তুমি কী তাপসী বলে  কাউকে চেনো?” - চুপচাপ দাম মিটিয়ে মেয়েটাকে জিজ্ঞেস না করে পারল না  নীতা। মেয়েটা কিছুটা যেন অবাক হলোসে তখন অন্য কাস্টমারের দিকে মন  দিয়েছে। তবু সৌজন্যের হাসি হেসে বলল – না তো! 

এদিকে বাড়ি ফেরার সময়ে নীতার শুধু মনে পড়ছে দুবিনুনী দুলিয়ে তড়বড়  করতে করতে এক কিশোরী কথা বলতে বলতে স্কুলে চলেছে। পাশে তার আরও দুই মেয়ে, তারা যেন নির্বাক শ্রোতা, অথবা কিছু বলতে গেলেও দুবিনুনীর কথার  তোড়ে তাদের চুপ করে যেতে হচ্ছে। নীতার চোখের সামনে এখন যেন নির্বাক  সিনেমা চলছে, সে শুধু ঠোঁট নাড়া দেখছে, হাত-পা নড়তে দেখছে, দুবিনুনীর দুলুনি দেখছেএকটা ঘোরের মধ্যে যেন হাঁটছে ও। বাড়ির সামনে এসে স্বাভাবিক হলো সেমুদির কয়েকটা জিনিস মাত্র কুলিয়েছে ওই টাকায়। যাক্‌, কাল আবার  কিনতে যেতে হবে।  

রাতে স্বপ্ন দেখল নীতা। একটা নাগরদোলার ঝুড়িতে পাশাপাশি বসে আছে নীতা আর তাপসী। নাগরদোলা ঘুরতে ঘুরতে হঠাৎ থেমে গেল দুম করে। কারেন্ট চলে গেছে, চারিদিকে ঘুটঘুট করছে অন্ধকার। নীতা আর তাপসী ঝুলে আছে একদম টঙের ঝুড়িতে। নীতা ভয় পেয়ে আঁকড়ে ধরেছে তাপসীর হাত। তাপসীর হাত ঘামে সব সময়। এখন ঠান্ডা কনকন করছে। ও নীতার হাতে একটু চাপ দিয়ে বলছে, ঘাবড়াস না, এখুনি লাইট এসে যাবে। পাঁচ মিনিটের মধ্যেই আমরা নেমে পড়তে  পারবএতক্ষণ চোখ বুজে বসেছিল নীতা। এবার ভরসা পেয়ে চোখ খুলে  তাকালোরাস্তার হালকা আলোয় মেলার ভেতরটা দেখা যাচ্ছিল। লোকজন সবাই  যেন থমকে গেছে। অল্প অল্প ঝুড়িটা দুলছে, যেন ঢেউয়ের আঘাতে দুলে উঠছে ঘাটে বাঁধা নৌকো এই মুহূর্তটা স্তব্ধ হয়ে যাচ্ছে একটা ফ্রিজ শটের মতো একটা পটে আঁকা ছবির মতো

দুতিনদিন পরে বাসস্ট্যান্ডে দেখা হয়ে গেল সেই সেলস্গার্লের সাথে নীতা ওকে  দেখে এবার আর কিছু কথা তোলেনি যেচে বরং মেয়েটিই এগিয়ে এসে বলল আপনি তাপসীকে চিনতেন? নীতা উত্তর দিল অবশ্যই, সে আমার  ছোটবেলার বন্ধু কিন্তু তুমি তো তাকে চেন না বললে আগের দিন, তাহলে আজ হঠাৎ তাপসীর কথা উঠছে কেন? মেয়েটি আবারও জিজ্ঞেস করল তাপসী কোথায় আছে, জানেন আপনি? নীতা জানালো, না, তার সাথে আমার দীর্ঘ পঁচিশ বছর কোনো যোগাযোগ নেই নীতা দেখল, মেয়েটার মুখটা কেমন যেন নিভে গেল দপ করে আর তার পরেই মেয়েটা আর কিছু না বলে হনহন করে অন্য দিকে হাঁটা দিল

শীত চলে যাচ্ছে আর সোয়েটার গায়ে রাখা যাচ্ছে না তাছাড়া নীতার এমনিতেই শীতবোধ কম যেদিন সেই সেলসের মেয়েটিকে দেখে তাপসীর কথা মনে এলো, সেদিনের পর থেকে প্রায়ই এখন ওর মনে তাপসীর কথা ঘুরঘুর করে অথচ এত বছরে তাপসীর কথা ভুলেই গেছিল প্রায় এই যে, শীতে সে গায়ে সোয়েটার রাখতে পারত না, তাই নিয়ে তাপসী প্রায়ই ওকে বলততুই রোজ গোটা গোটা   মোষ খাস্‌, আমি জানি! আজ মনে পড়ছে, আর একা একাই খুব হাসছে সে নিজেরই খুব অবাক লাগছে নীতার, এতদিন বাদে কীভাবে যেন আবার তাপসী তাকে দখল করেছে! আসলে বয়স হচ্ছে তো, তাই বুঝি স্মৃতি ফিরে ফিরে আসছে  বডিস্প্রের দিনও এসে গেল এমনিতে হিসেবী নীতার আর সেদিনের বাড়তি খরচের জন্য আপশোস লাগছে না, বরং বডিস্প্রের বোতলটা হাতে নিলে মনে এসে যাচ্ছে  সেই মেয়েটার মুখ, যার মধ্যে সে তাপসীকে দেখেছিল

যেভাবে হঠাৎ করে তাপসী ওকে পেয়ে বসেছিল, কালের নিয়মে সেভাবেই আস্তে আস্তে স্মৃতি ফের ফিকে হচ্ছে নীতার ওই দোকানে সেই মেয়েটাকেও আর দেখতে পায় না কোথায় হারিয়ে গেল কে জানে! মাস দুই-তিন পরে আবার একদিন সেই মেয়েটার সাথে দেখা এতদিনে নীতা প্রায় ভুলেই গেছিল ওকে বোঝা গেল নীতার সাথে দেখা করার জন্যই মেয়েটি বাসস্ট্যান্ডে এসে দাঁড়িয়ে আছে মেয়েটি যেন একটু রোগা হয়েছে এই কদিনে ওকে দেখে হালকা হাসল মেয়েটা নিজে থেকে বলা শুরু করলআপনার জন্যই ওয়েট করছি আমি চাকরি পেয়েছি, কাল চলে যাচ্ছি ব্যাঙ্গালোর আমাদের আর হয়তো দেখা হবে না কিন্তু আপনাকে কয়েকটি  কথা না বলে গেলে শান্তি পাব না তাপসী আমাকে জন্ম দিয়েছিলেন সেই সূত্রে উনি আমারমাহন্ কিন্তু আমি ওঁকে মা বলে মানি না আমাদের পরিবারেতাপসীনাম উচ্চারণ নিষিদ্ধ উনি আমাকে জন্ম দিয়েই আমাকে ছেড়ে কোথায় যেন চলে যান বহু খোঁজাখুঁজি করেও আর পাত্তা পাওয়া যায়নি সম্ভবত আমাকে জন্ম দিয়ে উনি খুশি হননি জানি না, তিনি বেঁচে আছেন কিনা...  আমার বাবা আবার একজনকে বিয়ে করেছেন। তিনিই আমার মা তিনিই আমার সব  

নীতা স্তব্ধ হয়ে শুনছিল ওর কথা কিছু বলতে পারেনি এতক্ষণ এবার মেয়েটি মুখ তুলে, একটু হেসে বললআসি ভালো থাকবেন মেয়েটি যখন একটু দূরে  চলে  গেছে, নীতা বিড়বিড় করে মনে মনে বললতুমিও খুব ভালো থেকো  মা অনেক বড় হয়ো ততক্ষণে একটা বাস চলে গেছে দ্বিতীয় বাসের অপেক্ষা  করতে করতে নীতার এতক্ষণে খেয়াল হলোএই যাঃ! মেয়েটার নাম জানা হলো না তো!        

                    

0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন