কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

শনিবার, ১৪ জানুয়ারী, ২০২৩

শর্মিষ্ঠা বিশ্বাস

 

সমকালীন ছোটগল্প


রাজহাঁসেরা ফিরে গেলো

 

দুটো মানুষের লাশ। এতোদিন ধরে অন্ধকারে, কিম্বা দিনের আলোকেও নিভিয়ে দিয়ে লাশ দুটো এক বিছানায় শুয়েছে। তারা মানুষের জন্য সম্পূর্ণ আইনি  প্রক্রিয়ায় বিবাহ নামক প্রাতিষ্ঠানিকতাকে সম্মান দিয়ে এতোকাল ধরে একসাথে, একমনে হাঁটতে গিয়ে হোঁচট খেয়েছে। আগুন লাগেনি বলে ফায়ার সার্ভিসেরও প্রয়োজন হয়নি কখনও। আজ তারা লাশ।

ফেসবুক থেকে প্রাপ্ত লাশ দু'টোর ছবির পর্যবেক্ষক মেয়েটির নাম লীনা। ডঃ লীনাঙ্গিনী বনশাল, পিএইচডি ডিগ্রির বেশি সময়টায় নিজের গবেষণার কাজ করতে গিয়ে হেঁটেছেন নিজের শরীরের ভেতরে ভেতরে। উনি নিজে একা হাঁটেননি। বরং জাগতিক চোখে দেখা যায় ও ভাবনার ডানা মেলে উড়ে যাওয়া যায়, এমন একটি আকাশের নীচে যে কয়জন মুষ্টিমেয় মানুষ বাস করেন, উনি তাদেরকেও হাঁটিয়েছেন শরীরের ভেতরের আদিম গন্ধে ভরা অন্ধকারের আঁখরা সুন্দরবনে।

লীনাঙ্গিনী লীন হয়ে আছেন তার শরীরের সর্বাংশে। তার বাঁশবাত্তার শরীরটা এক আশ্চর্য  মন্দির। পুজো পাঠের প্রক্রিয়া প্রায়ই শেষের দিকে। ধূপকাঠির জ্বলন্ত অগ্নিমুখ নীচের দিকে। মানে, ধূপের মশলা বিহীন সরু কাঠির দিকে। আর একটু বাদেই মুখ অর্থাৎ জীবনের শুরুতে যেখানে অগ্নি প্রজ্জ্বলন করা হয়, সেটি পৌঁছে যাবে গোড়ায়। তখন শুরু ও শেষ বলে আর কিছুই থাকবে না।

লীনাঙ্গীনি বনশলের তৈরি সুন্দরবনের জন্তুরা তাদের মুক্ত ও স্বচ্ছন্দ চলাচলে অভ্যস্ত। প্রয়োজনে এরা একে অপরকে জড়িয়ে ধরে। রাগ হলে কামড়ায়  অপরকে। খুব বিপত্তি হলে, ফরেস্ট রেঞ্জার লোকদেখানো জঙ্গিবিরোধীতা বোঝাতে, ওদেরকে খাঁচায় বন্দী করে। এরা স্বজাতি বিরোধী তো বটেই! হিংসা এদের উপজীব্য। তাকেই পাথেয় করে এরা স্বজনদের প্রতি বদবুদ্ধি প্রয়োগ করে। আবার অরণ্যের নিয়মবহির্ভূত কাজের অপরাধে এদেরকে বরখাস্ত করা হলে বিমর্ষ বদনে আকাশের অদৃষ্টকে খোঁজে!

তবে কর্পোরেট ভোগবাদীবিশ্বে এইসব রোগের মেডিসিন হয় না, একথা বিশ্লেষক লীনা বোঝে। এসব খুবই ইনটেলেকচুয়াল ব্যাপার-স্যাপার! তবে লাশ বিষয়ক থিসিসটি সাবমিট করে - ওনার পরবর্তী পদক্ষেপ, আধুনিক বাঘে গরুতে এক ঘাটে জল খাওয়া সমাজবাদ - একথা লীনা দেবী ভেবে রেখেছেন।

এইমাত্র শরীরের মন্দির ত্যাগপূর্বক লীনাদেবী হিংস্র জন্তুদের ভেতর থেকে একজোড়া রাজহাঁসকে বেছে নিলেন। এই শ্বাপদসংকুল অরণ্যে রাজহাঁসেরা মানুষের জনারণ্যের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মতোই ক্রমহ্রাসমান। শ্রমবাজার যখন ভোটবাজারে পরিণত হয়, তখন এরা অত্যন্ত মহার্ঘ হয়ে ওঠে।

লীনাঙ্গিনী লীন হয়ে গেছেন মাধ্যাকর্ষণ বলের মতো রাজহাঁসের নারী শরীরটিতে।

এই, চা খাবে না?

লীনা রূপী রাজহংসী তার সারাজীবনের সঙ্গীকে বললেন। সঙ্গী হাঁস তার ভাষাতে যা বললো, তার মর্মার্থ বিশ্লেষণের মাধ্যমে লীনার গবেষণাগারের লাল বাতি জ্বলে উঠলো। সাথে কিছুটা ধোঁয়া বেরুচ্ছে। ধোঁয়া সরলে আলোর খেলা!

এই মুহূর্তে পরস্পরের সাথে পরস্পর রাজহাঁসেরা যুগলে গলা জড়াজড়ি করে  কাঁদতে কাঁদতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ মানুষের মতো বুকের কাছে হলুদ রং-এর ঠোঁট গুঁজে বললো - তারা এই পৃথিবীতে কোনোভাবেই আর সন্তানের জন্ম দেবে না। এরজন্য প্রয়োজনে যৌনসুখপ্রাপ্তি থেকে নিজেদেরকে দূরে সরিয়ে দিতেও এরা বদ্ধপরিকর। কী হবে! সুন্দরবনের মাতলা নদীর বুকে ভেসে বেড়াতে বেড়াতে  মৃত্যু আসবেই একদিন! তারা জীবনের অপরপ্রান্তে অপেক্ষারত মৃত্যুকে আলিঙ্গন করে নেবে তখন! তবুও,  রয়ালবেঙ্গল টাইগারদের পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার অন্যতম পদে নিজেদেরকে নিজেরা নিয়োগপত্র দেবে না।

সারাদিনের কর্মক্লান্ত শরীরের গবেষণাগার থেকে বের হলো লীনার লীনতা।

লীনাঙ্গিনী রাজহংসীর চরিত্র থেকে বেড়িয়ে পড়লেন। মাতলা নদীর পার ধরে হাঁটতে হাঁটতে এগোচ্ছেন নির্জনতায় ভরা পাখি দ্বীপের দিকে। এখন পাখিরালয়ের ওয়াচ টাওয়ার থেকে লীনাঙ্গিনী বনসাল দেখতে পেলেন -

একদল ডাঙার বাঘ আর জলের কুমির রাজহাঁসেদের ছায়ায় ফরাস পেতে গালে হাত দিয়ে বসে শুনছে, গাঁওবালীদের গানে গানে এ অঞ্চলের একদা রাজহাঁসেদের লোকসংগীতের করুণ কাহিনীর সঙ্গে হাঁস মার্কা ড্রামের বাজনার আওয়াজ আছাড়ি-বিছাড়ি করে কাঁদতে কাঁদতে গড়িয়ে যাচ্ছে অন্ধকার বাদা  বনের কান্ডের গায়ে।


0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন