কালিমাটি অনলাইন

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

শনিবার, ১৪ জানুয়ারী, ২০২৩

নীতা বিশ্বাস

 

সমকালীন ছোটগল্প


জানি না

 

তোর সাথে যে কথা হয়েছিল তার ফুটনোটে কোনও দ্বিধা-সংকোচ ছিল না! ছিল না কলমের কারুকৃতি! কথার নদীতে নুড়ি থাকলেও ছিল না শ্যাওলার বাধা দেওয়া কলতান! অথচ শ্যাওলারই মতো প্রাণবন্ত সবুজ ছিল সে কথার রঙ! কোনও লজ্জাসঙ্কোচের শিকড় ছিল না তাতে! ছিল না ছড়ি-ঘোরানো অযুক্তি! বড্ড সহজ ছিল সেই খোলাকথার আন্তরিকতা! তুই কি বুঝিসনি?

বলেছিলাম এবছর আমি চললাম, সামনের বছর তুই চলে আসিস অঙ্কিত! সবকিছু তোর জন্যে গুছিয়ে রাখার কাজটা নাহয় আমিই করলাম! তাতে কি? এক-কামরার এ্যাপার্টমেন্টে অনেক জায়গারে! বসার ঘরটাকেও বাসের ঘর করে নেবো! ‘বসবাস’ শব্দটা তো এখান থেকেই এসেছে। বল? বসার ড্রইংরুমটায় দিব্যি একটা ডিভান পাতাই যেতে পারে! এককামরার ফ্ল্যাট কেমন ব্যাবহারের গুনে দুকামরা হয়ে উঠবে দেখিস! তিল তিল জায়গাগুলো অনন্ত হয়ে ওঠে এভাবেই রে! অথচ তুই ভাবতেই পারিস না এসব কথা। আজ এত দূরে এসে বুঝতে পারছি তোর আমার ভাবনার মধ্যে বেশ এতবড় একটা ফাঁক এতদিন ধরে ঘাপটি মেরে বসেছিলো নিঃশব্দে।

তুই আর আমি যে দুজনে দুজনকে এক ইঞ্চি জায়গা ছাড়বো না, সে তো পরীক্ষার  রেজাল্টের ঘরে! আমি তো বুঝতেই পেরেছি, একটুও জায়গা ছাড়ার প্রিপারেসন ছিল না তোর,  আমাকে বঞ্চিত করবি না বলে তুই পরীক্ষায় বসিসনি। ফাইনালে ড্রপ দিলি এবছর। তোর না-বলা কথা যে আমি শুনে পেয়ে যাই অঙ্কিত! বুঝে ফেলি তার হৃদব্যাকরণ! অথচ একথা তুই কোনদিনই বুঝতে পারলি না। তুই পরীক্ষায় বসলে আমি ফার্স্ট প্লেস পাবো না, এই নিশ্চুপ কথা কেমন সহজ ভাবে নিশ্চুপে বললি! বিনা সংকোচে! আমাদের সমীকরণ তো সহজ-স্বাভাবিক! তুই নিতেও চাস না, দিতেও চাস না। তোর এই শব্দহীন ভালোবাসাকে আমি আমার গর্ব ভাববো, না নিজেকে অপমানিত মনে করবো, বুঝতে পারি না। আসলে সেরকম ভাবে ভাবতেই পারি না যে!

আজ আমার এই ফটফটে সাদা দ্বিধাহীন কথাগুলো তুই কেমন ভাবে নিবি, একথাও আমি  একবারও ভাবতেই পারবো না! আমাদের মধ্যে লড়াইটা শুধুমাত্র অ্যাকাডেমিক ক্ষেত্রেই। একথা তুইও জানিস, আমিও। এর বাইরে আমাদের হৃদ্যতার সম্পর্ক আমরা কোনদিনই ডিসকাস করিনি। সে কথাটি আমাদের মনে মনেই…। সহজ স্বাভাবিকতায় আমাদের চলাচল!

আমি তোর ঘরদোরের ঠিকানা গুছিয়ে রাখছি, যাতে এসবের জন্য তোর সময় নষ্ট না হয়। এই বিদেশ-বিভুঁইয়ে ঘর টর জোগাড় করা বড্ড মুশকিল দেখলাম। একে একেবারেই তোর প্রতি আমার কৃতজ্ঞতা দেখানো মনে করিস না। আগামী বছর আর কারোকে জিতিয়ে দেবার জন্য  তোকে পরীক্ষায় ড্রপ  দিতে হবে না! না, আমার জন্যই যে তুই পরীক্ষায় ড্রপ দিলি একথা  তুই আমাকে একদিনও বলিসনি! আমিও কিছু মনে করিনি রে অংকিত। ভাবতে চাইলে আমিও তো এটা মস্তবড় একটা অপমান ভাবতে পারতাম! তাই না! দুজনে পরীক্ষায় বসে আমিই যদি তোকে ছাড়িয়ে যেতাম, তুই বোধহয় সেটা সহ্য করতে পারতিস না কোনোদিন। পুরুষতান্ত্রিকতা তোদের মধ্যে চিরকালই শিকড় গেড়ে আছে। সেই আদ্যিকাল থেকে। যতই কাছের মানুষ হোক না কেন, একজন মেয়েকে তোর থেকে এগিয়ে যেতে দেখতে পারিস না তোরা পুরুষরা। তোদের আর দোষ কি বল! আমি ভেবেছিলাম আমাদের সমীকরণটা এর উর্দ্ধে থাকবে। এতখানি ভুল ভেবেছিলাম!

মাঝের এই অনন্ত দেওয়ালটা নিয়ে আর যাই হোক ভালোবাসা নিস্পাপ হয়ে ওঠে না। বড্ড কাঁটা বিছানো থাকে এইসব লুকোচুরিপনা তে। ভাগ্যিস আমি দূরে আসার সুযোগ আগে পেয়েছি! না হলে ভালোবাসার মধ্যে এইসব খোলামকুচি আবিস্কার করতে পারতাম না! বড় জোর বেঁচে গেছি আমি।

ঘাড়ে চাপানো মলিনতা নিয়ে বাস করতে করতে জীবনটাও ময়লা হয়ে ওঠে রে। একটাই তো জীবন, বল! জানলা দিয়ে দেখছি ঝরে পড়ার আগে ম্যাপল পাতাগুলো কেমন রক্তের মত লাল হয়ে উঠছে। ওদের মনের রক্তক্ষরণ দেখছি। আজ এত দূরে বসে কেমন  যেন মনে হচ্ছে, আর সবকিছু মনে মনে নিঃশব্দে হয়ে চললেও,   ভালোবাসার একটা নিভৃত কন্ঠস্বর থাকা উচিত।  একটা মর্মভেদী উচ্চারণ। যে উচ্চারণের পাশে ‘ইগো’ নামের কোনও ধৃষ্টতা ছায়া ফেলতে পারে না। ভালো থাকিস। ইতি…

 

 

 

 


0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন