কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

শনিবার, ১৪ জানুয়ারী, ২০২৩

শিবাংশু দে

 

‘কিছু’




বাহান্ন বছর আগের কথা। উনিশ শো সত্তর সালের এপ্রিল মাস। আমি ইশকুলে পড়ি। জামশেদপুরে কলকাতার আঁচ ভালোভাবেই এসে পৌঁছে গেছে। প্রতিদিন বেড়ে যাচ্ছে তার তাপ। চোদ্দো থেকে চুয়াল্লিশ বয়সের বাঙালি ছেলেরা ক্রমশ বিহারের কংগ্রেসি সরকারের টিকটিকিদের ফোকাসে এসে যাচ্ছে। রাতের দিকে বাঙালি ছেলেরা একাদোকা এদিক ওদিক ঘোরাফেরা ছেড়ে দিয়েছে। প্রতি থানার কোটা থাকে। কিতনা 'নকসলি' কো অন্দর কিয়া? বাড়ির লোক দৌড়াদৌড়ি না করতে পারলে সোজা হাজারিবাগ সেন্ট্রাল জেল। সেখানে শুনতুম সব ওয়ান ওয়ে। ঢোকাই যায়, বেরোনো যায় না। ঢাকায় শেখ মুজিব, কলকাতায় দেবদুলাল। একটা যুদ্ধ বাধবে কিছু দিনের মধ্যেই। এখন যেমন দুচারটে পলিটিক্যাল জন্তু ইচ্ছেমতো দেশের লোককে 'দেশদ্রোহী' বলে দাগিয়ে দেয়। তখন সেটা বিহারে শুরু হয়ে গিয়েছিলো। যে কোনও আরা-ছাপড়া ব্র্যান্ড বিহারি ইচ্ছেমতো যে কোনও বাঙালি ছেলেকে 'নকসলি' বলে দাগিয়ে দিতে পারতো। জামশেদপুর বাঙালিদের হাতছাড়া হতে শুরু করেছিলো। আমি তেরো প্লাস।

এরকম একটা সময়ে শোনা গেলো আমাদের শহরে টেগোর সোসাইটির আমন্ত্রণে শম্ভু মিত্র এবং বাদল সরকার আসছেন। তাঁদের সঙ্গে থাকবেন একজন নবীন নাট্য গবেষক শমীক বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁরা বাংলা নাটক নিয়ে আলোচনা করবেন টেগোর সোসাইটির কাঠের মেঝের সভাঘরে। সকালের অধিবেশনে। টেলকোতে রবীন্দ্র সংসদের আমন্ত্রণে আসবেন সন্ধেবেলা। নাটক নিয়ে আড্ডা দিতে। আমরা তো সন্ধেবেলার জন্যই প্রস্তুত। তবে আমি নেহাৎ বালক তখন। কৈশোরে পা দিতে যাচ্ছি। সব কিছু জানার অসম্ভব ক্ষুধা। শম্ভু মিত্র তো বটেই। তিনি তখনই কিংবদন্তি। বাদল সরকারও আমাদের বাড়িতে চর্চিত নাম।

বিকেল ছটা নাগাদ সান্ধ্য আড্ডার ঠিকানা টেলকোর শিশু বিদ্যালয়ের ঘরটিতে পৌঁছে গেলুম আমরা। কিছু লোকজন এসে গেছেন। কিন্তু একটা চাপা বিড়ম্বনার ছাপ চোখে মুখে। জানা গেলো সকালের আলোচনা সভায় কিছু অতিবামপন্থী ছেলেপুলে শম্ভু মিত্র এবং বাদল সরকারকে বেশ উদ্দণ্ডভাবে অভিযুক্ত করেছে 'পলায়নী' মনোবৃত্তির দায়ে। তাঁরা নিজস্ব যুক্তি দিতে গেলে ছেলেগুলি আরও অসহিষ্ণু বাক্যবাণে তাঁদের হতমান করারও চেষ্টা করেছে। প্রতিবাদের এমত অসম্ভ্রান্ত প্রকাশ জামশেদপুরের মানুষ গ্রহণ করতো না তখন। সত্যি কথা বলতে তাঁরা যা আলোচনা করতে এতো দূর এসেছিলেন, তার কিছুই সম্পন্ন হতে পারেনি। তিন জনেই, বিশেষত শম্ভু মিত্র, বেশ আহত বোধ করেছেন ছেলেগুলির অসঙ্গত ব্যবহারে। তারা প্রায় সবাই বহিরাগত। এ শহরের নয়। অতিথিদের সন্ধের অনুষ্ঠানে আসাটা একটু অনিশ্চিত হয়ে গেছে।

যাই হোক, শেষ পর্যন্ত ডাক্তার দেবল দাশগুপ্তের প্রযত্নে অতিথিরা আড্ডায় এসে পৌঁছোলেন। শম্ভু মিত্র এবং বাদল সরকার তখনও শ্মশ্রুহীন, মধ্যবয়স। বাবার উপর ভার ছিলো আলাপচারিতা শুরু করার। তাঁর সুললিত, অজাতশত্রু বাগভঙ্গির সুবাদে আড্ডায় বেশ একটা সহজ আবহাওয়া তৈরি হয়েছে। ঠিক সেই সময় হঠাৎ সকালের 'বিপ্লবী' বাঙালিদের একজন গেটক্র্যাশ করে ঢুকে পড়লেন সেখানে। সবার গলা ছাপিয়ে তাঁর অভিযোগ, সারা দেশ যখন আগুনে জ্বলছে, শম্ভু মিত্র তখন রক্তকরবী, ডাকঘর, অয়দিপাউস নিয়ে ব্যস্ত। বাদল সরকার ব্যস্ত 'এবং ইন্দ্রজিৎ, বাকি ইতিহাস, পাগলা ঘোড়া' নিয়ে। তাঁদের লজ্জা পাওয়া উচিৎ। এ সমস্ত বন্ধ করে তাঁদের 'নতুন দিন'-এর নাটক লেখা শুরু করা দরকার। পলকে আড্ডার আবহাওয়া আবার প্রদূষিত হয়ে পড়লো। বাবা'রা পরিস্থিতি সামলাবার চেষ্টা করতে লাগলেন। শম্ভু মিত্র'কে বলতে শুনলুম, 'আমরা এটুকুই পারি। তাই এসব নাটকই করি। বাজারে অনেক কালি-কলম পাওয়া যায়। যাঁরা পারবেন, তাঁরা নতুন নাটক কেন লিখছেন না?'

গোলযোগ, চাঞ্চল্য একটু থামলে শম্ভু মিত্র বললেন, কেউ একটু গান শোনাতে পারেন? শ্রীমতী এষা দাশগুপ্ত এবং অন্য কয়েকজন গান ধরলেন, 'আজি এ আনন্দসন্ধ্যা', পূরবী রাগিণীতে। পরিস্থিতি যখন একটু স্থিত হতে শুরু করেছে, হঠাৎ পাশের রাম মন্দির থেকে আকাশ ভেঙে পড়া ক্যাকোফোনি উজাড় করে শুরু হলো সন্ধের আরতি। ঝাঁজ, কত্তাল, ঢোল, চিৎকার সব কিছু নিয়ে দেবতার ভজনা। এখানে সবাই চমকে উঠে চুপ করে গেলো। কেউ কারো গলার আওয়াজ শুনতে পাচ্ছিলেন না। কোলাহল থামার পর দীর্ঘশ্বাস ফেলে শম্ভু মিত্র বললেন,  'হায়, এদের ঈশ্বর কতো দূরে!'

পরবর্তী ঘন্টাখানেক বেশ সহৃদয় আড্ডা চললো অতিথি ও স্থানীয় সুধীজনের মধ্যে। তেরো বছর বয়সে সব কিছু বুঝে ওঠার এলেম আমার হয়নি, তবু বিচ্ছিন্ন ভাবে মনে আছে। বাদল সরকার তখন প্রসেনিয়াম ভাঙা থিয়েটার নিয়ে তাঁর চিন্তা-ভাবনার কথা বললেন। সামাজিক অবিচারের প্রতিবাদ নাটকে কেমন ভাবে আসা উচিৎ, তা নিয়ে তাঁর ধারণাও বিনিময় করলেন আগ্রহী শ্রোতাদের সঙ্গে। শম্ভু মিত্র বলেছিলেন মূল রবীন্দ্রনাথ এবং বিশ্বসাহিত্যের ক্ল্যাসিকসের অনুবাদ বাংলা মঞ্চে তিনি কেন প্রাসঙ্গিক মনে করেন? শমীক বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁদের ধরতাই দিচ্ছিলেন বিভিন্ন রেফারেন্স দিয়ে। মেধাবী বাঙালির 'আড্ডা'য় যেমনটা সমীচীন ভাবা হয়।

সভা ভাঙার পর আমি চিরাচরিত উৎসাহে অটোগ্র্যাফের খাতা নিয়ে পৌঁছে যাই তাঁদের কাছে। শম্ভু মিত্র সবিনয়ে বললেন, 'বাবা, আমি অটোগ্র্যাফ দিই না। গুরুর বারণ আছে'। বাদল সরকার খাতাটা আমার থেকে নিতে অনুরোধ করলুম কিছু লিখে দেবেন। তিনি বললেন কিছু লিখতে বললে তিনি একটা কথাই লেখেন। এখানেও তাই লিখে দিয়েছেন।




শমীক বন্দ্যোপাধ্যায় লিখে দিয়েছিলেন 'সব কথা শুনো'। আমার জন্য এ এক শেষ কথা। আমি চিরকাল সব কথা, সবার কথা সযত্নে শুনি। শুনতে ভালোবাসি। অকারণ মুখরতা বড়ো ক্লান্তিকর লাগে। কেন এতো অকারণ কথা বলে মানুষ? বাহান্ন বছর হয়ে গেলো। 'কিছু' হয়তো অনেক কথাই বলে যায়। নিশ্চুপ...

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 


1 কমেন্টস্:

  1. ভালো লাগল।
    কলকাতা থেকে আগত তিনজন মান্য আলোচকের সভায় স্থানীয় অতিবিপ্লবীদের অনুপ্রবেশের এই খবর আমার জানা ছিল না, কারণ আমি তখন কলেজী পাঠ নেবার জন্য নকশালবাদীদের খাসতালুক কলকাতায় থাকি। কিন্তু সেই ঝোড়ো সময়ে জামসেদপুরের এমন ছবি এই লেখায় দেখে বিস্মিত হইনি, কারণ টাটাগ্রামেও যে বিপ্লবীরা তখন ছিলেন, সে বিষয়ে নিজের কিছু পুরানো স্মৃতিও সাক্ষ্য দিল। ওই সময় উৎপল দত্তের একটি যাত্রাপালায় গাঁধীবিরোধী একটি সংলাপ প্রসঙ্গে আমার একটি চিঠি দৈনিক বসুমতীতে ছাপা হয়েছিল, তার নিচে আমার জামশেদপুরের ঠিকানাও ছেপে দেওয়া হয়েছিল। এর জেরে আমাদের বাড়িতে কিছু বাঙালি যুবকের আগমন হয়েছিল। আমাকে না পেয়ে অবশ্য তারা বাড়ির লোকজনদের নানারকম জিজ্ঞাসাবাদ করে চলে যায়।

    -- অলক বসুচৌধুরী

    উত্তরমুছুন