কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

শনিবার, ১৪ জানুয়ারী, ২০২৩

শুভ্রনীল চক্রবর্তী

 

সুভাষচন্দ্র বসু, পরবর্তী ১৯৪৫




(৩)


১৯৫০ - ১৯৬০, চিন - ভিয়েতনাম ও কোরিয়ার স্বাধীনতা আন্দোলন:

অশ্বিনীকুমার গুপ্তা, হিন্দুস্তান স্ট্যান্ডার্ডের জয়েন্ট এডিটর জানান ১৯৫১ সালের মে মাসে তিনি যখন নাগা হিলসে ছিলেন সেখানে তিনি নাগা নেতা ফিজোর সঙ্গে দেখা করেন। ফিজো তাঁকে বলেন তিনি আগেই জানতে পেরেছিলেন যে   নেতাজির প্লেন ক্রাশের খবর প্রচারিত হবে কিন্তু সেই সময়ে তিনি এই কথায় বিশ্বাস করেননি। মি: গুপ্তা আরও জানান যে তিনি মিশমি জনজাতি নেতার সঙ্গে দেখা করে জানতে পারেন যে সেই নেতা নেতাজিকে দেখেন ১৯৫৩-৫৪ সাল নাগাদ এবং চিনা কমান্ডাররা তাঁকে বলেন একজন বিখ্যাত ভারতীয় নেতা তাঁদের সঙ্গে আছেন এবং তাঁকে দেখাতে সেই মিশমী লিডারকে এক প্রত্যন্ত  গ্রামে নিয়ে যাওয়া হয় এবং সেখানে গিয়ে তিনি নেতাজীকে দেখতে পান মিলিটারি ড্রেস পরিহিত অবস্থায় একটি টেন্টে বসে আছেন।

মাউ আগামি বলে আর একজন নাগা জনজাতি নেতা যিনি বহুকাল ফিজোর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন তিনি জানান যে ১৯৫৮ সালের এপ্রিল মাসে বার্মার পেনাংএ দেখা করেন নেতাজির সঙ্গে আই.এন. এ পার্সোনেল এর সহযোগী হয়ে।

আগেই বলেছি, শুধু চিন নয় ভিয়েতনামের স্বাধীনতা আন্দোলন নিয়ে সুভাষ বসু যথেষ্ট তৎপর ছিলেন এবং ১৯৪৫ সাল ও পরবর্তী সময়ে বেশ কয়েকবার তিনি হো চি মিনের সঙ্গে দেখা করেন। ১৯৫২ সালে প্রথমবার বেজিংয়ে তিনি আয়োজন করেন এশিয়া প্যাসিফিক কংগ্রেস এবং সেখানে উপস্থিত ছিলেন হো চি মিন, মাও সে তুং সহ অন্যান্য বড় মাপের নেতারা। সূত্র মারফত জানা যায় তিনি পরিকল্পিত ভাবে চিনকে একপ্রকার বাধ্য করেন ফ্রেঞ্চ কলোনিজিম থেকে ভিয়েতনামের সাধারণ মানুষকে রক্ষা করতে।

১৯৪৯-৫০ সালে মাও সে তুং চিনের ক্ষমতা গ্রহণ করেন এবং তারপর থেকে  ৫৫ - ৫৬ সাল পর্যন্ত নেতাজি মূলত চিনেই থাকেন লু ফাং চিং নামে।  বলাই বাহুল্য মাওএর নেতাজির উপর অপার শ্রদ্ধা ছিল এবং বেশ কয়েকটি সিক্রেট মিটিংএ তিনি এ কথা স্বীকারও করেন যে সুভাষ বসু ছাড়া চিনের স্বাধীনতা সম্ভব ছিল না। ১৯৪৬ সাল পর্যন্ত মাও মাত্র ৫০ হাজার সৈন্য নিয়ে যুদ্ধ করছিলেন এবং জেতার বিন্দুমাত্র আশাও ছিল না, ১৯৪৫ সালে জাপানের আত্মসমর্পণের  পর নেতাজি এশিয়ান লিবারেশন আর্মি বানান যেখানে ভারতীয়, জাপানিজ, ফিল্পাইন্স, বার্মার মানুষ ছিলেন এবং সেই আর্মি মাওকে সাহায্য করে চিনাং কাই শেকের সঙ্গে লড়তে এবং সফল হতে। শুধু লোকবলই নয় নেতাজি মাওকে আর্টিলারি, হেভি মর্টার্স, ক্যানন, ট্যাংক, মেশিনগান এসব সরঞ্জাম দিয়ে সাহায্য করেন।

১৯৫০-৫৩ সাল পর্যন্ত নেতাজি তাটর এশিয়ান লিবারেশন আর্মি নিয়ে নর্থ কোরিয়ার হয়ে যুদ্ধ করেন অ্যামেরিকান ট্রুপের সঙ্গে এবং এই সময় তিনি জেনারেল শিবা নাম নিয়ে যুদ্ধ পরিচালনা করেন।

শুধু স্বাধীনতা পেতেই সাহায্য করা নয়, নেতাজি মাওকে নতুন করে চিনকে সাজাতে সাহায্য করেন, বলা যায় যে তিনি মাওএর রাজনৈতিক পরামর্শদাতা হিসেবে বহু ক্ষেত্রে চিনকে সমাজতান্ত্রিক অগ্রসরের পথে সাহায্য করেন। ১৯৫৪  সালের ১৯ সে অক্টোবর নেহেরু চিন ভ্রমণে যায় এবং মাও সে তুং এর সঙ্গে দেখা করেন। তিনি মাও কে জিজ্ঞেস করেন চীনের এত কম দিনে এহেন উন্নতির কারণ কী? তখন মাও সে তুং হেসে বলেন চীনের এই উন্নতির পেছনে  এক মহান মানবের পরিকল্পনা কাজ করছে। কৌতূহলী নেহেরু সেই ব্যক্তিকে দেখতে চাইলে ঝোও এন লাই তাকে বলেন তিনি তাঁর সঙ্গে কিছুতেই দেখা করতে পারবেন না। যাইহোক যথেষ্ট অনুরোধের পর নেহেরু শেষ পর্যন্ত দেখা পান সেই মহামানবের এবং নেহেরু একটুও ভুল করেনি তাঁর বন্ধুকে চিনতে।

নর্শিমা রাও প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন তিনি কিছুটা চেষ্টা করেছিলেন নেতাজির প্রকৃত সত্য উদঘাটনের। তাঁর সঙ্গে প্রভা জগনাত্থন ভিয়েতনাম সফর থেকে  ফিরে এসে মিডিয়াকে জানান ভিয়েতনাম নেতাজি সম্পর্কে অনেক ডকুমেন্টস রেখে দিয়েছে যা প্রকাশিত হলে ভারতবাসীদের মাথা ঘুরে যাবে। এই বিষয়ে মিশন নেতাজির অন্যতম উদ্যোক্তা সায়ন্তন দাশগুপ্ত বিশদে রিসার্চ করেছেন এবং তাঁর ওয়েবসাইটে প্রকাশ করেছেন। তিনি জানান ভিয়েতনামের ওয়ার  রেমিনেন্ট মিউজিয়ামএ নেতাজির ছবিও তিনি দেখতে পান ভিয়েতনাম স্বাধীনতার আগে ও পরবর্তী সময়ের। হো চি মিনের সঙ্গে নেতাজির বন্ধুত্বের কথা আমরা আগেই আলোচনা করেছি এবং চিনের সাহায্যে তাঁর এশিয়ান লিবারেশন আর্মি নর্থ ও সাউথ ভিয়েতনামের যুদ্ধে হো চি মিনকে সবরকম সাহায্য করে।  এই বিষয়ে একটি কথা বলে রাখি বলরাজ তিরখে ১৯৭১ সালে সাইগনে মিলিটারি ড্রেসে নেতাজীকে দেখতে পান এবং খোসলা কমিশনকে সেটি জানানও।  সম্ভবত ভিয়েতনাম যুদ্ধ পরিচালনার জন্যেই তিনি সেইখানে উপস্থিত ছিলেন এবং পরবর্তী কালে অর্থাৎ ১৯৯১ সালে ভিয়েতনাম তাদের স্বাধীনতা সংক্রান্ত কিছু ফাইল প্রকাশ করলে জানা যায় ভিয়েতনামের ড্রাগ কূটনীতির মাধ্যমে অ্যমেরিকান সৈন্যদের পর্যদুস্ত করার কথা। কিন্তু এই কথাটি নেতাজি ১৯৬৬ সাল নাগাদ লীলা রায়কে জানিয়ে দেন এবং নেতাজির নাম গোপন রেখে এই তথ্য জয়শ্রী পত্রিকায় প্রকাশ পায়। নেতাজি বলেন - "War is not an emotional thing, it's a cold and calculated strategy"। নেতাজি এও জানান তিনিই হো চি মিনকে এই কূটনৈতিক পরামর্শ দেন। ভিয়েতনাম ডি ক্লাসিফাইড থেকেও আমরা জানতে পারি ১৯৬৬-৬৯ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন ধরনের ড্রাগ যেমন কোকেন, মারিজুয়ানা, এল এস ডি ও হেরোইন অ্যমেরিকান ট্রুপকে সরবরাহ করা হয় ও ধীরে ধীরে ৫২% সৈনিক মাদকাসক্ত হয়ে পড়ে এবং যার ফল স্বরূপ কয়েক বছরের মধ্যে হার স্বীকার করে ভিয়েতনাম থেকে অ্যমেরিকা সৈন্য প্রত্যাহার করে ও ভিয়েতনাম স্বাধীনতা লাভ করে। শুধু তাই নয় নেতাজি লীলা রয়কে এও জানান তিনি তাঁর বন্ধু হো চি মিনকে সর্বপ্রথম poet president উপাধি  দেন।

এই ১৯৫০-৬০ সালে উপরোক্ত বিষয় ছাড়াও নেতাজি তিব্বত বা টিবেটকে চিনা আগ্রাসন থেকেও রক্ষা করতে সাহায্য করেন। চিনের সাথে ভালো সম্পর্ক থাকা সত্ত্বেও চিনের বিপ্রতীপে গিয়ে তিব্বতের পাশে দাড়ানো থেকে আমরা এও বুঝি  তাঁর একমাত্র লক্ষ্য ছিল স্বাধীনতা এবং তিনি সমস্ত রকম সংকীর্ণ রাজনীতির  ঊর্ধ্বে ছিলেন। থমাস লয়েল এর "দ্যা দলাই লামা" বই থেকে জানা যায়, দলাই লামা জানান তিব্বতের চরম সংকটের সময় অর্থাৎ ১৯৫১ পরবর্তী সময়ে চিনারা তিব্বতের পাশে থাকার ভান করলেও আদতে তাদের আগ্রাসন নীতি চালিয়ে যাচ্ছিল। তৎকালীন সময়ে মিমাং ভেবেছিলেন গান্ধীজির অহিংস আন্দোলনের পথেই যাবেন কিন্তু তার ফলে বহু নিরীহ মানুষের প্রাণহানি হয় এবং সেই সময়ে দলাই লামা ক্ষমতায় আসেন এবং তাঁরা সহিংস পথেই আশ্রয় নেয়। লামা জানান খাম্বা ট্রাইবরা এক নেতার থেকে গেরিলা প্রশিক্ষণ নিতে থাকে এবং সেই নেতাই  সমস্ত রকম সাংগঠনিক ও যুদ্ধ পরিচালনার দায়িত্ব নেন। যদিও তাঁর পরিচয় পুরোপুরি গোপন ছিল এবং তিনি নিজেকে জেনারেল শিবা বলে পরিচয় দেন। জানা যায় চিনারা দলাই লামাকে অ্যরেস্ট করার গোপন প্ল্যান করলে হঠাৎই  ১৯৫৯ সালের ১৭ই মার্চ তিনি ভারতে পালিয়ে আসেন কোনো বডিগার্ড ছাড়া এবং তাঁকে সাহায্য করেন নেতাজি ওরফে জেনারেল শিবা। বলে রাখা ভালো,  দলাই লামা ৫৬ সাল থেকে নেহরুকে চিনা আগ্রাসনের বিরুদ্ধে হস্তক্ষেপ করতে বললেও নেহেরু কোনরকম সাহায্য তো করেনইনি বরং ৫৮ সালের শেষে পরিস্থিতি হাতের বাইরে যেতে থাকলেও দলাই লামাকে ভারতে আসতে কোনো রকম সাহায্য করতে সরাসরি নাকচ করেন।

সুতরাং এই পর্যায়ের আলোচনা থেকে আমরা বুঝতেই পারি নেতাজি কোনো নির্দিষ্ট রাজনৈতিক আদর্শের উর্দ্ধে ছিলেন এবং তাঁর মত জাতীয়তাবাদী ও স্বাধীনতা প্রিয় নেতা সমগ্র বিশ্বে বিরল। যে চিনের স্বাধীনতায় তিনি সরাসরি সাহায্য করেন সেই চিনের আগ্রাসনের বিরুদ্ধে তিনি তিব্বতে সোচ্চার হন আবার অতীতেও আমরা দেখি কূটনৈতিকভাবে হিটলারের সাহায্য নিলেও পরবর্তীকালে রাশিয়ার সাহায্য নিয়ে তিনি এশিয়ান লিবারেশন আর্মির কাজ চালিয়ে যান আবার জাপানের সঙ্গে এত ভালো সম্পর্ক রেখে ভারতের স্বাধীনতার কাজ চালিয়ে যাওয়ার পাশাপাশি তিনি জাপান অধিকৃত চিনের স্বাধীনতার জন্যও পরবর্তী কালে সরাসরি অংশগ্রহণ করেন। ১৯৬০ সাল পর্যন্ত নেতাজির কার্যকলাপ আমরা আলোচনা করলাম এবং ভিয়েতনাম যুদ্ধ প্রসঙ্গে কিছুটা ৬০ পরবর্তী ঘটনাও তুলে ধরলাম এবং পর্যায়ক্রমে বিভিন্ন ঘটনার উল্লেখ ও আলোচনা ক্রম বিকাশের মাধ্যমে আরও স্পষ্টত বুঝতে পারবো যুদ্ধ পরিচালনার ক্ষমতা, কূটনীতি ও দেশপ্রেমের এই অদ্ভুত মেলবন্ধন পৃথিবীর ইতিহাসে হয়ত আর আসেনি নেতাজির আগে।





0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন