কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

শনিবার, ১৪ জানুয়ারী, ২০২৩

হৈমন্তী রায়

 

ইডিপাস - প্রতিনায়কের ভূমিকায়




‘প্রতিনায়ক’ এই শব্দে যে ‘নায়ক’ অংশের উল্লেখ, সেখানে নায়কোচিত  গুণাগুনের সমাবেশ থাকবেই, তাতে সন্দেহের অবকাশ নেই। তবু, নায়ক অপেক্ষা প্রতিনায়ক চরিত্রটি জটিল, বলা ভালো, এই দুইয়ের মধ্যে দ্বন্দ্ব, বিভেদ, অমিল কিছু কম নয়। গল্পে, সাহিত্যে, চলচ্চিত্রে, সমাজে সংসারে এই নায়ক হওয়ার সব সম্ভাবনা থাকা সত্বেও নায়ক না হয়ে ওঠা প্রতিনায়কের গুরুত্ব অপরিসীম। এই অন্ধকারময়, হতভাগ্য, নির্দয় চরিত্রগুলির দিকে দৃষ্টিপাত করলে একটি নামের কথা খুব মনে পড়ে। গ্রিক পৌরাণিক চরিত্র - ইডিপাস। সফোক্লিসের নাটকে এই চরিত্রের বিশদ বর্ণনা আমাদের ভাবতে বাধ্য করে,  নিয়তি কতটা নিষ্ঠুর, কতটা নির্মম হলে ইডিপাসের মতো চরিত্রের আবির্ভাব হয়।

কে এই ইডিপাস? প্রায় আড়াই হাজার বছর আগে রচিত ইডিপাসকে বলা হয় বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ ট্র্যাজিডির একটি। কিন্তু কেন?  

ইডিপাস-এর বিয়োগান্তক কাহিনীটি আবর্তিত হয়েছিল প্রাচীন গ্রিসের থিবস নগরীতে। কোথায় ছিল এই থিবস নামক নগরীটি? থিবস নগরী প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ফিনিসিয় রাজপুত্র ক্যাডমাস। ক্যাডমাসের বোন ইউরোপাকে হরণ করেছিল দেবতা জিউস। ক্যাডমাস তার হারিয়ে যাওয়া বোনকে খুঁজছিল। দেবতা অ্যাপোলোর উপাসনালয়টি রয়েছে ডেলফাইতে। সেখানে দৈববাণী শোনার জন্য ক্যাডমাস উপস্থিত হয়। দৈববাণীতে তাকে বলা হয়, ইউরোপার সন্ধান না করে বরং একটি নগর প্রতিষ্ঠা করতে হবে তাকে। উল্লেখ্য, একই নামে প্রাচীন মিশরেও একটি নগর ছিল।

এই ক্যাডমাসের বংশধর লেয়াস ছিলেন থিবস নগরের রাজা। রানীর নাম জোকাস্টা। রাজদম্পতি ছিলেন নিঃসন্তান। সেকালে দৈববাণী শোনার জন্য ডেলফাইতে অবস্থিত দেবতা অ্যাপোলোর উপাসনালয়ে যাওয়ার চল ছিল। দৈববাণী করতেন পুরুষ নয়, বরং নারী পুরোহিতরা - এদের বলা হতো ‘পিথিয়া’। সেই উপাসনালয়ে থিবস-এর রাজদম্পতির সন্তানহীনতার কথা বলা হল। তখন এভাবেই ভবিষ্যত জানার প্রচেষ্টার চল ছিল। পিথিয়ার মাধ্যমে ভয়ানক এক দৈববাণী হল: রাজা লেয়াসের পুত্রসন্তান হবে এবং সেই ছেলে লিয়াসকে হত্যা করবে, শুধু তাই নয়, জোকাস্টাকে সে বিয়ে করবে। এ কি সাংঘাতিক ভবিষ্যবাণী! পিতৃহন্তা হবার সাথে সাথে নিজের মাতাকে বিবাহ করার মতো অবিশ্বাস্য কদর্য কাজে লিপ্ত হবে সেই সন্তান?

জন্মের আগেই ইডিপাস আর তার দুর্ভাগ্য এই চরিত্রটিকে অনন্য করে তোলেনি  কি? প্রতিনায়ক হওয়ার বাইরে আর অন্য কিছু হওয়া তার ভাগ্যের লিখন তো নয়! রাজার ঘরে জন্মানোর পর, তার নামকরণের আগেই, জীবনের ভয়াবহ পরিণতির হাত থেকে বাঁচতে সদ্যজাত সন্তানের দুই পা ফুটো করে গ্রন্থিবিদ্ধ করে পাহাড়ে ফেলে দেওয়ার আদেশ দেন স্বয়ং পিতা! হায় রে ভাগ্য! এক বিশ্বস্ত দাসকে ডেকে রাজা লিয়াস বললেন, “এটাকে সাইথিরন পাহাড়ে ফেলে রেখে আয়”।

শিশু মাত্রই নিষ্পাপ, সরল, অসহায়! হৃদয়ে স্নেহের উদ্রেককারী সেই শিশুকে কি সহজেই মৃত্যুমুখে ফেলে আসা যায়! নবজাতককে কাপড়ে মুড়িয়ে সাইথিরন পাহাড়ে নিয়ে আসে সেই দাস, যে ছিল একজন মেষপালক। চারিদিকে ঘন অরণ্য, রুক্ষ প্রান্তর; নবজাতককে রুক্ষ প্রান্তরে ফেলে এবং কচি পায়ে শলাকা বিদ্ধ করে। নবজাতকের আর্ত চিৎকারে বনভূমি কেঁপে ওঠে। নবজাতককে ফেলে রেখে সে চলে যায়, বা বাধ্য হয়। অন্তত প্রাণে বেঁচে থাক, হয়ত এমন ইচ্ছেয় এই রাজাদেশ অবমাননা! পাঠকও বুঝবেন, নিয়তি বা ভাগ্য কতটা শক্তিশালী ভূমিকায় গ্রিক কাহিনীতে। ইডিপাসের মৃত্যু অমন ভয়ঙ্কর পরিণতির হাত থেকে তাকে রক্ষা করতেই পারত! কিন্তু তা আর হলো কই! প্রতিনায়ক হওয়ার জন্যই তো তার জন্ম। ভাগ্যের কী পরিহাস! ভেড়ারপাল নিয়ে করিন্থের এক মেষপালক ধারে কাছেই ছিল। শিশুর কান্না শুনে কৌতূহলী হয়ে ওঠে সে। রুক্ষ প্রান্তরের ওপর নবজাতককে কাঁদতে দেখে মায়া হয়েছিল নিশ্চয়ই। চকিতে মনে পড়ল করিন্থের রাজা পলিবিয়াস আর রানী মেরোপের কথা; তাঁরাও ছিলেন  পুত্রকন্যাহীন। রাজা-রানী কি এই ফুটফুটে শিশুকে দত্তক নেবেন? নবজাতককে কোলে তুলে নিতে নিতে মেষপালক  এমনই কিছু ভেবেছিল বোধহয়।

এক রাজার পুত্র মানুষ হয় আরেক রাজার ঘরে। করিন্থ রাজ্যের নিঃসন্তান রাজার হাতেই যে তাকে তুলে দিয়েছিল সেই মেষপালক! সুতরাং রাজসুখ, রাজঐশ্বর্য্যের সঙ্গে নিজেকে বীর, পরাক্রমযোগ্য রাজা হওয়ার সকল সুযোগ জীবন তাকে উজাড় করেদিয়েছিল। এখানেই সেই নায়কোচিত গুণের আধিক্য। একজন দক্ষ পুরুষ, যোগ্য বীর, একজন উপযুক্ত রাজা!

ইডিপাস নামের পিছনের গল্পটি হয়ত অনেকেরই জানা।

ফুটফুটে শিশুটিকে দেখেই রানী মেরোপ বুকে তুলে নিয়েছিলেন। রাজা পলিবিয়াসের মুখ চোখও উজ্জ্বল হয়ে উঠেছিল, বলাই বাহুল্য। শলাকা বিদ্ধ করায় শিশুটির পা ফুলে যায়, পা ফোলা বলে শিশুটির নাম রাখা হয় ...স্ফীতপদ বা Oedipus ।




সময় বা ভাগ্য যাই হোক না কেন, ইডিপাসের কানে এই কথা পৌঁছোয় যে সে পিতৃহন্তা হবে, বিবাহ করবে নিজের মাতাকে। ভবিতব্যের হাত থেকে বাঁচতে অবশেষে ইডিপাস নিজের রাজ্য করিন্থ ত্যাগ করে রওনা হয় থিবসের দিকে। নিয়তির হাতে বিবশ, পথে নিজের অজান্তেই তারই হাতে মৃত্যু ঘটে লেয়াসের! এখানে লক্ষণীয়, পথে বিবাদ আর মতবিরোধের কারণে ক্রোধের বশবর্তী হয়েই কিন্তু ইডিপাস হত্যা করেছিল অচেনা পথিককে। এইখানে ভাগ্য কি পুরোপুরি দায়ী? মানুষকে হত্যা করার অপরাধ তো সে করল! হ্যাঁ, যাকে সে হত্যা করল সেই ব্যক্তি যে তারই জন্মদাতা পিতা, এই চরম সত্য অজানা ছিল বটে, তবে হত্যার অপরাধ, রক্তের দাগ তার চরিত্রের দুর্বলতা, নির্মমতাকে কি দ্রষ্টায় না? যদিও হত্যার কারণ আত্মরক্ষাই ছিল, তবুও তর্ক, বিবাদ থেকে এই চরম পরিণতির কিছুটা দায় তো তারও রয়ে যায়!

থিবস নগরীর তোরণ দ্বারের বাইরে একটি স্ফিংকসের দেখা পেল সে। স্ফিংকসটি দেখতে অদ্ভূত! অর্ধেক নারী অর্ধেক সিংহর মতন, আবার পাখির মতো ডানাও আছে। সে প্রায়ই থিবস-এ এসে অত্যাচার করত। স্ফিংকসের জ্বালায় থিবসবাসী  অতিষ্ঠ। স্ফিংকস সবাইকে ধাঁধা জিজ্ঞাসা করে, সঠিক উত্তর দিতে না পারলে সেই ব্যক্তিকে সে খেয়ে ফেলে।

সেই ধাঁধার উত্তর দেওয়ার মতো বিচার বুদ্ধি ইপিপাসের ছিল। তীক্ষ্ণ বুদ্ধি আর বিচক্ষণতার পরিচয় দিয়ে সেই জটিল ধাঁধার সঠিক উত্তর দেওয়ার ফলে স্ফিংকস নিজেকেই হত্যা করে। এভাবেই নায়ক ইডিপাস থিবসের যোগ্য রাজা হয়ে উঠল। হ্যাঁ, আগেই বারবার আলোচনায় উঠে এসেছে প্রতিনায়কের ভিতর নায়কের ছায়ার উপস্থিতি। একটি রাজ্যের প্রজাদের শত্রুর হাত থেকে রক্ষা করার মধ্যে হিরোইজমের ছোঁয়া রয়ে যায় ইডিপাস নামক চরিত্রে।

জীবনের চরম মুহূর্তের দিকে নিয়তি তাকে এভাবেই নিয়ে গেল বলেই হয়ত থিবসের রাজমুকুট ইডিপাসের অভিশাপে পরিণত হলো।

থিবস বিপদমুক্ত, ইডিপাস থিবসের রাজা আর ফলতঃ সদ্য বিধবা রানী জোকাস্টাকে বিয়ে করল সে, যেমনটা প্রচলন ছিল। জনগণ ভাবল স্ফিংকসই রাজা লেয়াসকে হত্যা করেছে।

এরপর কিছুদিন সুখে কাটতে লাগল। ইডিপাসের ঔরসে জোকাস্টার গর্ভে দুই ছেলে, ইটিওক্লেস ও পলিনেইসিস এবং দুই মেয়ে, ইসমেন ও অ্যান্টিগনির জন্ম হয়। নিজের মায়ের সঙ্গে বৈবাহিক জীবনযাপন, সন্তানের জন্ম দেওয়ার মতো অস্বাভাবিক, অনৈতিক, ভয়ঙ্কর কাজটি তাকে তার ভাগ্য করিয়েই নিল। যে পাপ কার্যের হাত থেকে বাঁচতে সে ছেড়েছিল তার করিন্থ রাজ্য, তার পালিত পিতা মাতাকেও ছেড়ে এসেছিল নিয়তির হাত থেকে নিস্কৃতি পেতে, সেই পাঁকে তাকে ডুবতেই হলো, যদিও জ্ঞানতঃ নয়, অজান্তেই! যদি ওই সত্য চিরকাল গোপনই থাকত, ইডিপাস তো সুখেই থেকে যেতে পারত, কাটাতেই পারত আপাত স্বাভাবিক জীবন। কিন্তু এমনটা তো হওয়ার ছিল না!

এরপর থিবসে প্রাণঘাতী মরক দেখা দিল; সেই ভয়াবহ মহামারীতে জনপদ  উজাড় হতে লাগল। রাজহত্যা, পিতৃহত্যা, অজাচার নিজের অজান্তেই এই সমস্ত অপরাধ করে ইডিপাস। সেই অপরাধের যথাযথ শাস্তি না হওয়ার ফলে দায় নিতে হয়েছে সমগ্র থিবসনগরীকে।

থিবস নগরে বাস করতেন এক অন্ধ পয়গম্বর; নাম তাঁর টাইরেসিয়াস। টাইরেসিয়াস বললেন, মরকের হাত থেকে বাঁচতে হলে রাজা লেয়াস হত্যার বিচার করতে হবে। সম্ভবত যে দাস শিশু ইডিপাসকে সাইথিরন পাহাড়ে খোলা প্রান্তরে রেখে এসেছিল, সেই টাইরেসিয়াসকে সব ঘটনা খুলে বলেছিল। ওই দাস ইডিপাসের পায়ের ক্ষত দেখে চিনতে পারে তার আসল পরিচয়। অন্ধ পয়গম্বর টাইরেসিয়াস ইডিপাসকে সব ইতিবৃত্ত খুলে বলে। ইডিপাস জানতে পারে সে আপন পিতার ঘাতক ও আপন মায়ের সঙ্গে অজাচারী সম্পর্কে লিপ্ত। কী চরম আঘাত নেমে এসেছিল রাজা ইডিপাসের জীবনে! এখানেই শেষ নয়। আরও অনেক আঘাত অপেক্ষায়!

এহেন ভয়ানক সত্য জানবার পরে জোকাস্টা লজ্জা ও আত্মগ্লানিতে আত্মহত্যা  করেন। শোকে, ক্ষোভে কাতর ইডিপাস নিজেই নিজেকে আঘাত করে, নিজের চোখ অন্ধ করে দেয়। এরপর থিবস নগরীতে তার আর স্থান হওয়া সম্ভব নয়। নির্বাসন, যা কিনা মৃত্যুর থেকেও ভয়ানক, সেই হয় তার একমাত্র শাস্তি। সন্তানদের হাত ধরে থিবস ত্যাগ করে ইডিপাস। তার প্রস্থান ও যথোচিত শাস্তির পরেই মহামারি থেকে নিস্তার পায় থিবস নগরী।

‘ইডিপাস দি কিং’ নাটকে থিসব নগরীর অন্ধ পয়গম্বর টাইরেসিয়াসকে দিয়ে সফোক্লেস বলিয়েছিলেন:

How dreadful knowledge of the truth can be

When there’s no help in truth!

ইডিপাস চরিত্র দৈববাণী থেকে নিজেকে ও পিতামাতাকে রক্ষার জন্য সব রকমের চেষ্টা করেছে। করিন্থ থেকে পালিয়ে এসেছে, কিন্তু নিয়তির হাত থেকে পালাতে পারেনি।




ইডিপাস চরিত্রে সব ধরনের মানবিক গুণ আছে। ন্যায়পরায়ণতা, সত্যনিষ্ঠা, দায়িত্বশীলতাসহ সার্বিক মহৎগুণগুলো তার মধ্যে ছিল। নিয়তির কারণে ইডিপাস চরিত্রে গভীর ট্ট্যাজেডি নেমে আসে। যে কোন বিবেচনায়, বিশ্বসাহিত্যে ইডিপাসের মতো চরিত্র দ্বিতীয়টি আর নেই। তবু, এই চরিত্র নায়কের তকমা পায় না, পেতে পারে না, তার কর্মের জন্য। হ্যাঁ, দোষ গুণের বিচারের বাইরে দাঁড়িয়েও, সহানুভূতির হাত বাড়িয়েও আমরা তাকে মনে রাখব প্রতিনায়কের এক বিরল নিদর্শন রূপে।


1 কমেন্টস্:

  1. ইডিপাস চরিত্র চিরকাল এক এবং অদ্বিতীয়। গ্রীক পুরাণের এই কাহিনীটি বহু পুরোনো হয়েও চিরনতুন। তাই বারবার পড়তে ভালো লাগে। আরেকটি ইন্টারেস্টিং চরিত্র হল সিসিফাস। লেখাটা ভালো লাগল।

    উত্তরমুছুন