কালিমাটি অনলাইন

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

শনিবার, ১৪ জানুয়ারী, ২০২৩

মৌসুমী মুখোপাধ্যায়

 

ধর্ষণ, প্রতিহিংসা ও মৌলবাদী হত্যা সমূহ




যে ছেলেরা জন্মাবধি বাড়িতে আত্মীয় পরিজনের বিশেষ সমাদর পেয়ে অভ্যস্ত, তারা নিজেদের অক্ষামতাজনিত কারণে অন্য একদল মেয়েদের কাছে হেরে গিয়ে স্রেফ আক্রোশে, প্রতিহিংসায় ছলে বলে কৌশলে তাদের ওপরে ঝাঁপিয়ে পড়ছে।  তাদের ধর্ষিত পৌরুষ দিয়ে একটা নারী শরীর পেয়ে কখন এককভাবে, কখন যৌথভাবে ধর্ষণ করছে, তারপর দেহটাকে খুন করে লোপাট করে দিচ্ছে। তারা ভাবছে তারা বিরাট কিছু করে ফেলল আর এভাবেই তারা তাদের হারানো জায়গা আবার ফিরে পাবে। বেচারা আহাম্মকের দল! জানে না যে ইতিহাসের রথের চাকা, প্রগতির রথের চাকা সবসময় সামনের দিকেই শেষ পর্যন্ত এগোয়, কখনও কোন অবস্থাতেই পেছনের দিকে নয়।

এই অব্দি পড়ে কেউ কেউ ভাবছেন, এত যে সব কথাবার্তা আমি বলছি তাতে লাভের লাভ কী হল? দলে দলে মেয়েরা ধর্ষণের শিকার হচ্ছে, গণধর্ষিত হচ্ছে। আর এদিকে আমাদের দেশ ভারতে ধর্ষণের জন্য কঠোর সাজা দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে। আর সর্বোচ্চ সাজা তো মৃত্যুদন্ডই ঘোষণা করা হয়েছে। তাহলে? কই? তাতেও তো কিছুতেই কিছু কমছে না! তবে? যারা এমনটা ভাবছেন, তাদের বলি, কমবে না। এখনই কমবার সময়  আসেনি।

গোটা পৃথিবী জুড়েই ধর্ষণ ও নারীনির্যাতন চরম আকার নিয়েছে।  বিশ্বের প্রথম শক্তিধর দেশ আমেরিকা ধর্ষণের নিরিখে প্রথম। ৯৯% ধর্ষকই পুরুষ, যারা শিকার তাদের মধ্যে ৯১% শতাংশই নারী এবং নয় শতাংশ পুরুষ। এখানে প্রতি ছজনের মধ্যে একজন ধর্ষণের শিকার। যেখানে কিনা প্রতি ৩৩ জনের মধ্যে ৩ জন পুরুষ। আমেরিকায় ঘরের বাইরের তুলনায় ঘরের ভেতরে ধর্ষণ বেশি হয়। এর পরেই দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে সাউথ আফ্রিকা।  দুহাজার বাইশ সালে ৬৫০০০ ধর্ষণ ও যৌন হয়রানির ঘটনা নথিভুক্ত হয়েছিল। এই দেশকে বলা হয় ধর্ষণের রাজধানী। শিশুধর্ষণে সাউথ আফ্রিকা প্রথম। এখানে পুরুষদের ২৫%এর বেশি ধর্ষণ করেছে যাদের মধ্যে টিন-এজার ধর্ষকের সংখ্যা  বেশি। অথচ ধর্ষণের  অপরাধে সাজা হয় মাত্র দু বছর কারাদন্ড! তৃতীয় স্থানে রয়েছে সুইডেন। গোটা ইউরোপের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ধর্ষণ হয় এখানে। প্রতি চারজন নারীর মধ্যে একজন ধর্ষণের শিকার হয় এখানে। ২০১০ সালের সুইডেন পুলিশের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী প্রতি এক লাখ অধিবাসীর মধ্যে ৬৬% ধর্ষিত হয়েছে। ২০০৯ সালে ১৫৭০০ রেপ-কেস নথিভুক্ত করা হয়েছিল যা কিনা ২০০৮ সালের  তুলনায় ৬৬ ভাগ বেশি। ধর্ষণের ঘটনায় চতুর্থ স্থানে রয়েছে ভারত। ২০১২ সালে ২৪৯২৩টি রেপ-কেস নথিভুক্ত হয়েছে। এর মধ্যে ২৪৮৭০টি ধর্ষণ হয়েছে অভিভাবক/পরিবার, আত্মীয়, প্রতিবেশী ও পরিচিত মানুষ দ্বারা। ৯৮% ধর্ষকই  ধর্ষিতার পরিচিত। ভারতে প্রতি ২২ মিনিটে একটি করে নতুন রেপ-কেস রিপোর্ট করা হয়। ধর্ষণে পঞ্চম স্থানে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। এখানে বিশেষ পরিসংখ্যানে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী প্রতি বছর গড়ে ৮৫০০০ নারী ধর্ষিত  হয়। প্রতি পাঁচজন  নারীর মধ্যে (১৬ – ৬৫ বছর বয়সী) নারীর মধ্যে একজন কোন না কোন যৌন হয়রানির শিকার হয়েছে জীবনে। জার্মানি আছে ছ নম্বরে। এখন পর্যন্ত ২ লাখ ৪০ হাজার নারীও শিশু ধর্ষণের ফলে মারা গেছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে কমবেশি ৬৫৭৩৯৪টি কেস নথিভুক্ত করা হয়েছে। জার্মান ক্যাথলিক সরকার ধর্ষিতাদের মর্নিং আফটার পিল খাওয়ার অনুমতি দিয়েছে। সপ্তম স্থানে আছে ফ্রান্স। অত্যন্ত আশ্চর্যের বিষয় ১৯৮০ সাল অব্দি ধর্ষণকে এখানে কোন অপরাধ হিসাবে ধরা হত না। যৌন হয়রানির বিরুদ্ধে একটি আইন অনুমোদন পায় ১৯৯২ সালে। সরকারি হিসেবে প্রতি বছরে এ দেশে ৭৫০০০ ধর্ষণ হয়। মাত্র ১০ ভাগ নির্যাতিতা অভিযোগ দাখিল করে। অষ্টম স্থানে আছে কানাডা যেখানে প্রতি তিনজন নারীর মধ্যে একজন যৌন হয়রানির শিকার হয়। বিশেষ পরিসংখ্যান অনুযায়ী প্রতি ১৭ জনের মধ্যে ১ জন ধর্ষিত হয়েছে, ৬২%  ধর্ষিতা শারীরিক ভাবে আহত হয়েছে ও ৯% মার খেয়েছে ও তাদেরকে বিকৃত করে দেওয়া হয়েছে। শ্রীলঙ্কা রয়েছে নবম স্থানে। এখানকার নিরাপত্তা বাহিনী যুদ্ধ শেষ হয়ে যাওয়ার ৪ বছর পরও ধর্ষণ ও নির্যাতন চালিয়ে যাচ্ছে। একটি বিশেষ পরিসংখ্যানে পাওয়া গেছে  শ্রীলঙ্কার ১৪.৫ শতাংশ পুরুষ জীবনে কোন না কোন সময়ে ধর্ষণ করেছে। ২.৭ শতাংশ পুরুষ অন্য পুরুষকে ধর্ষণ করেছে। ১.৬% পুরুষ কোন না কোন গণধর্ষণে অংশ নিয়েছে। ধর্ষকদের মধ্যে ৯৬.৫% পুরুষ কোন আইনি প্রশ্নের মুখে পড়েনি। ৬৫.৮ % কোন উদ্বেগ বোধ করেনি এবং ১১.১% ধর্ষক ৪ বা তার অধিক শিশু ও নারীকে ধর্ষণ করেছে। ধর্ষণে দশম স্থানে আছে ইথিওপিয়া। এ দেশে ৬০% নারী যৌন সহিংসতার শিকার। ধর্ষণ ও অপহরণ করে বিয়ে করার কারণে এই দেশটি কুখ্যাত। অনেক জায়গায়ই পুরুষরা বন্ধুবান্ধব নিয়ে কোন মেয়ে বা মহিলাকে উঠিয়ে নিয়ে যায়। এ দেশে  এটা খুব সাধারণ ঘটনা। অপহরণকারী এরপর তার কনেকে ধর্ষণ করে চলে যতদিন না সে অন্তঃসত্ত্বা হয়। ১১ বছরের কন্যা শিশুও ছাড়া পায় না তাদের হাত থেকে। এমনকি ইথিওপিয়ার মিলিটারিরাও এই অপরাধে  অভিযুক্ত।

পৃথিবীর তাবড় তাবড় দেশের ধর্ষণের সমীক্ষার পরিসংখ্যান দেখার পর এবং আলোচ্য প্রত্যেকটি দেশের বিশেষ বিশেষ বৈশিষ্ট দেখলে বোঝা যাবে এই সব দেশেই ধর্ষণ হচ্ছে, সেখানকার পুরুষদের সক্ষমতা বা অভ্যেসের মধ্যে পড়ে  বলেই তারা এই ধর্ষণগুলো করে থাকে। এটা তাদের চিরাচরিত এক ধরনের রীতি রেওয়াজ। যেন খানিকটা বাবার জমিদারি, তাই করছে। এ নিয়ে ভাবনা চিন্তা করাটা তাদের সময় নষ্ট করার মত একটা ব্যাপার। তাই তার কোন ভাবনা চিন্তা করার কোন প্রয়োজন বোধ করে না। এইখানে পিতৃতান্ত্রিক সমাজ পুরুষদের পৌরুষ প্রমাণ করবার যে ছাড়পত্র দিয়েছে, ওরা শুধু সেই সুযোগের ‘সদব্যবহার’ করছে। অর্থাৎ আমরা এটা বুঝতে পারছি এখনও পর্যন্ত পিতৃতান্ত্রিক  সমাজব্যবস্থা আমাদের গোটা পৃথিবীতেই একেবারে শক্ত ঘাঁটি গেড়ে বসে আছে।  নিজেদের পৌরুষ, অধিকার প্রমাণ করতে দরকার পড়লে তারা ধর্ষণ করে শাস্তি পেতেও দুবার ভাবে না। কেননা ধর্ষণ করাটা তাদের জন্মগত অধিকারের মধ্যে পড়ে। সমীক্ষা থেকে তো আমরা এটাও দেখতে পেলাম বহু দেশেই এর জন্য কোন শাস্তির বিধান পর্যন্ত নেই। ইথিওপিয়ার মত একটা দেশে মেয়েদের তুলে নিয়ে গিয়ে নিরন্তর ধর্ষণ করা চলতেই থাকে, যতক্ষণ না সে গর্ভবতী হয় এবং এ নিয়ে সে দেশে কেউ কিছু মনেও করে না। এটাই ওদের সংস্কৃতি।  শ্রীলঙ্কার মত রাষ্ট্রে ধর্ষণের পর কোন আইনি প্রশ্নের মুখেও পড়তে হয় না। আবার আধুনিক সভ্যতা ও সংস্কৃতির পীঠস্থান ফ্রান্সে এই সেদিন ১৯৮০ সাল অব্দি ধর্ষণকে কোন অপরাধ বলে ধরাই হত না। আর যুক্তরাষ্ট্রে প্রতি বছর গড়ে ৮৫০০০ নারী ধর্ষিত হয়। গোটা পৃথিবী এবং মানব সভ্যতা জুড়ে পিতৃতন্ত্র এখনও জমিয়ে জাঁকিয়ে বসে আছে। এমন কি ভারতেও। তবে ভারতের বিচারব্যবস্থা এ ক্ষেত্রে অনেক দৃঢ ও কঠোর যা পৃথিবীর অন্যান্য দেশের তুলনায় যথেষ্টই গর্ব করার মত একটা বিষয়, যদিও এই সরষেগুলোর মধ্যেই আসলে  ভূত লুকিয়ে রয়েছে। কিন্তু এত করেও যে আমাদের দেশে ধর্ষণ আটকানো যাচ্ছে  না বা অন্যান্য দেশের অবস্থা ভয়ঙ্কর থেকে ভয়ঙ্করতম তার একটাই কারণ পৃথিবীর  প্রায় প্রত্যেক দেশই এখনও পর্যন্ত পিতৃতন্ত্র নামক মৌলবাদের হাত থেকে কিছুতেই বেরিয়ে আসতে পারছে না। বেরিয়ে আসতে পারছে না ‘নারী নরকের দ্বার’ নামক ধর্মীয় ভাবাবেগ থেকে। মুক্ত করতে পারছে না নিজেদেরকে ‘নারী মাত্রেই ভোগের বস্তু’ এই ধরনের ঐহিক পারত্রিক জ্ঞানের অন্ধ্বত্ব থেকেও। অতএব ধর্ষণ করতে বাধা কোথায়? এ জীবনে ধর্ষণ করে যদি শাস্তি জোটেও, পরলোকে গিয়ে তো নিশ্চিত বিশেষ কোন রম্ভা-মেনকা-উর্বশী অবধারিত ভাবে অপেক্ষা করে থাকবে!

 

(ক্রমশ)


1 কমেন্টস্: