ফ্ল্যাশব্যাকে থিয়েটার পাঁচালি
প্রতি,
শীতের সঙ্গে উৎসবের যোগ রয়েছে। এবং শীতের সঙ্গে থিয়েটারের যোগও রয়েছে। থিয়েটার দেখতে হলে উত্তর কলকাতা ছেড়ে এগোলেই নন্দন চত্বর। কলকাতার একপাশে যে পেশাদার মঞ্চগুলো ছিল, অর্থাৎ, হাতিবাগানপাড়ায় – সেগুলো তো বন্ধ কবেই। তাই বছরের শুরুর সংস্কৃতি চর্চার জন্যে মুখর এক প্রাঙ্গন। যেখানে কেন্দ্র হয়ে থাকা সদন - শিশির মঞ্চ আর একাডেমি। মধ্যে জলাশয়ের কোলে নন্দন সিনেমা হল। নতুন বছরের দ্বিতীয় সপ্তাহে জমিয়ে চলছে থিয়েটার। যে থিয়েটারের নাম গ্রুপ থিয়েটার। বিড়লা প্ল্যানেটরিয়াম থেকে পায়ে চলা। বাঁয়ে ঘাড় ঘোরাতেই একাডেমি। মূল প্রাকারের গায়ে গায়ে থিয়েটারের হরেক পোস্টার। ছোটো বড় বৃহৎ কুঁজো সবকটা রয়েছে গায়ে গা লাগিয়ে। সবাই যেন একজোটে থিয়েটারের কথা বলছে। আবার সবাই পৃথক যেন। নজর না কেড়ে অতি উচ্চ সেই গাছটা যেন থিয়েটারের পোস্টারের মায়ের কোল। যেখানে শত শত ব্যানার ফেস্টুনের জায়গা হয়েই চলছে। থিয়েটারের বাজার কতটা? ঢং ঢং ঘণ্টা বাজতেই মনে পড়ল, এপাশে চার্চ। সাদা শরীর উত্থিত মাথাটা। একপাশে কবেকার বয়ে আনা থিয়েটারের ঐতিহ্য। কিইবা যায় এসে, তার কত বছর হল? বা হল না? বছর গুনে গুনে থিয়েটারের বাজার কোথায় এলো? জাতক- জাতিকাদের উৎসবমুখিতায় থিয়েটার কোথায়? হাতের মুঠোয় ফোন, যন্ত্রের ব্যবহার তার শতেক সুবিধা নিয়েও বাংলা থিয়েটারের বাজার … রমরমা কিনা বা কেন নয় – সেই তাত্ত্বিক বিচারের দায় সাধারণ দর্শকের তো নয়। একথা মানতেই হবে, কিভাবে লোক টানতে হবে, তা জানতে পারেনি বাংলা থিয়েটার। একসময়ের নাসিকা কুঞ্চিত করা বাঙালির থেটারে থেকে থিয়েটারের যাত্রা মধ্যে, উঠে এসেছে এক, সিনেমা শিল্প, দুই, যাত্রাপালা।
থিয়েটারের প্রতি অনীহা থেকে মেতে উঠে অভিনয় দেখতে ইচ্ছুকদের অগ্রিম টিকিট বুকিংয়ের জন্যে লাইন – এখন শহরে দেখা না পাওয়া চড়ুই পাখিদের মতনই অদৃশ্য। আরও বললে, রুচির খাতিরে থিয়েটারের টিকিট-কাটা দর্শকের ভূমিকাটি ম্রিয়মান। সংখ্যা গুনতে গুনতে বেশিদূর যেতেই হয় না। ভিড় যা, তা হল থিয়েটার করিয়েদের। থিয়েটার শিল্প বলে দায় এড়ানো সেই দায়, যার দায় দর্শকদের নয়। এবং সিনেমায় নায়ক-নায়িকার প্রধান কর্ম তথা অভিনয়ে বিশেষ টিপ্পনী, থিয়েটারের সঙ্গে তুলনা করে অভিনয়ের ব্যাখ্যা করা পর্যন্ত দায়িত্ব দর্শক পালন করে থাকেন। আর অভিনয়ের ত্রুটিগুলো দর্শক অবশ্যই ধরিয়ে দেন। এবং দর্শক একুশ শতকে ফের মেশিনে ফালাকাটা করে ভাজা আলু, মটর, ভুট্টা খেতে খেতে প্যাকেটের তীব্র শব্দে থিয়েটার-ভক্ষণ বা রক্ষণ করেন। থিয়েটার তাহলে কি? দুটো গেট পেরিয়ে থিয়েটার-চত্বরে ঢুকলেই এখন থিয়েটার-প্রেমীদের অসংখ্য কুর্ণিশ ও ধন্যবাদ। এভাবেই দেখতে হয়েছিল থিয়েটার। শোয়ের দিন ছিল উৎসব।
২৫ডিসেম্বর। জমিয়ে দিয়েছেন ততক্ষণে দুই পেশাদার আর্টিস্ট, ওরফে দুই রঙ্গকর্মী। একজন বর্ষীয়ান অভিনেত্রী চিত্রা সেন। আরেকজন সীমা মুখোপাধ্যায়। দুজনের মধ্যে চলছে সংলাপ। উফ … মেয়েটা তখন উত্তেজনায়। মায়ের বৃদ্ধ বয়সের অনুভূতি সঙ্গে নানান ফিকির। দুই অসম বয়সের অভিযোজন কি হয়? এমনই পরিবেশে মঞ্চের ডানদিকে চিত্রা সেন দর্শকের দিক করে সাজানো চেয়ারে। বলছেন …। নীল আলো তাঁকে ধরছে ছাড়ছে। সীমা মুখোপাধ্যায় তখন মঞ্চের ঠিক উঁচুতে দশভাগের এক ভাগ, অর্থাৎ বামহাতে সাজানো স্টোভ আর দুধের কৌটোর সেট সহ মেয়ের অভিনয়ে। হলদে আলো খেলছে। তফাৎ দূরে কানে কুরকুর। কুরকুরিয়ে উঠেছেন যুবতী এক। ব্যাগ থেকে অভিজাত রমণীয় কায়দায় বাজার দরের সঙ্গে পাল্লা-সংস্কৃতি মেনে ভেঙে শব্দ হেনে, খাচ্ছেন বিস্কুট থুড়ি কুকিজ। এমন সহাবস্থানে থিয়েটার তার বাজারে সেদিন মাত করেছিল। সেদিন বক্স আর্টিস্ট বা হিসেবে চিত্রা সেন-এর নাম জমিয়ে দিয়েছিল। বাজার উপেক্ষার নয়। একাডেমিতে সেবার মারিকালের মধ্যে থিয়েটার – উৎসব। দুদিন হলেও হচ্ছে, চলছে আর দুটো করে শো করছে নির্বাচিত থিয়েটার দল। প্রতিশব্দে বন্দী থিয়েটার বা নাট্যদল 'জলছবি' নাটকের চলমান শোয়ে। গতি ও সচল অভিনেতাদের মধ্যে একটি সময়-বন্ধন চলতেই থাকে। তাই তো রিহার্সাল দরকারি। কিন্তু বাজার-দর মেনে রঙ্গমঞ্চ কর্মীদের মধ্যে চেনামুখ হলেই, তাঁর অভিনয়ের কদর বেশি। যা দর্শক টানে, জানেন সব্বাই, মানে সব্বাইই, যে চিত্রা সেন অভিনয় শুরু করেছিলেন যতদিনে, ততদিনে তিনি নৃত্যশিল্পী হয়ে ওঠা দেশ-বিদেশ ঘুরে আসা। তারপরই তাঁর অভিনয়, মঞ্চে, সিনেমায়, পেশাদারিভাবে। পরে, ছোটপর্দায়। অর্থাৎ, টেলিভিশনে এবং বেসরকারি টেলি-জগতে। যেখানে এখন হামেশাই দেখা যায় -- থিয়েটার-কর্মীদের, থিয়েটার-করিয়েদের। কিন্তু থিয়েটারে অভিনয় – মানে মঞ্চে, মানে মঞ্চের একই জায়গায় বসে কম সংলাপে, শুধু অভিব্যক্তি দিয়ে, মুখের থেকে ছেটানো মুড়ির দৃশ্যায়ন – একটি সম্পদ, যা থিয়েটার দেখতে আসা দর্শকদের দেখা ক্রিয়া। প্রতিক্রিয়া এরকম হয়েছিল যে, দর্শক তখন বিবেচনার জন্যে মুচমুচ করে চিবানো অভ্যাস ভুলে – কি করছে দেখতে সম্মোহিত হয়েছিল। অমন তুলকালাম কিছুই নয়, বাদ্যির জোর নেই। নেই বাজনাওলাদের নাচানাচি। বেতালা চাটি নেই, নেই অদ্ভুত অপ্রয়োজনের আলোর ছটা। তবুও, নাট্য-দর্শক সম্পর্ক তৈরি হচ্ছিল। দুবছর মধ্যে গেল। তবুও মন্থন করে চোখ বুজলেই বাইরের সজ্জা থেকে যে দৃশ্য মনে ভাসে, সেও দেখা মেয়েদের বাণিজ্যিক এক শরীর-পরিবেশন। মেয়ের চরিত্রে সীমা মুখোপাধ্যায় , মঞ্চের সজ্জায় থাকা একটা দণ্ড ধরে শরীর দুলিয়ে চোখ ঘুরিয়ে বুঝিয়ে দিলেন – লালবাতির মেয়েদের সেই চেনা ভঙ্গিমাটা। ফের, দর্শক চুপ। বিস্কুট তখনও ব্যাগে ছিল জানি। জানি তখনও আলু, ভুট্টা ভাজার কিছু বাকি। কুরকুর শব্দে দর্শকবৃন্দ তৃপ্তি লাভযোগে রুচি ও বুদ্ধির পরিচয় দিতে দিতে তাক লেগে যায় ব্যোমকে। সচকিত তাই মনোরঞ্জন উত্তরকালের সাধারণ দর্শক বিষয় বনাম অভিনয় –ক্ষমতা। যুগ্ম রহস্যের কল্যাণকর ধর্মে যেখানে অভিনয় মাইনাস, শব্দ ব্রহ্ম প্লাস প্লাস প্লাস মোডে। বুঝলেন তো পাঠক, দর্শকদের সহাবস্থানে থেকে যাওয়া থিয়েটার + অভিনেতা = নাট্যচর্চা ও বাজার। এক কুশলী তাত্ত্বিকের দর্শক নিয়ে মত ছিল যে, আত্মরক্ষার তাগিদেই অন্তঃসারশূন্য নাট্য-পরিবেশনা যদি দর্শকের পছন্দের হয়, তবে তাকে চাহিদা বলে চালিয়ে সমাজের এবং দর্শকের আরও ক্ষতি করা। আরেক তাত্ত্বিকের মতে, থিয়েটার শিল্প। তার কাজ বাজারের চাহিদা মেটানো নয়। বরং থিয়েটারের কাজ এদেশের ক্ষেত্রে ছিল দর্শককে জাগিয়ে তোলা। তবে কি, মনোরঞ্জন থাকলে সেক্ষেত্রে জাগিয়ে তোলা যায় না? যায়, তবে যায়-ব্যাপারটা অত সোজা নয়। সেই 'যায়' ধরে আনতে শুধু অভিনয় লাগে নাকি আরও বিপণন মাধম্যের দ্বারা বিজ্ঞাপন। যেখানে 'বাজার' ধরে আনতে কেউ কেউ যখন পারেন তখন গ্রুপ থিয়েটারের রঙ্গমঞ্চকর্মী হয়েও হলশুদ্ধ দর্শকের হাততালি। হাততালি পড়ে। করতালির সেই জোগান তো দর্শকই দিয়ে থাকেন। কে না জানে, করতালির জোর মানে দর্শক আসন ভর্তি। ভর্তি মানে টিকিট বিক্রি। টিকিট মানে অর্থাগম। অর্থাৎ, ভালো নাটক, জমে গেছে বা হিট। কদিন আগের কথা, থিয়েটার দেখে বেরোনোর সময় এই আলোচনা চলছিল। যে, থিয়েটারের দর্শক কেন কমতির দিকে। তার বাজার না-এর দিকে কেন?
আবার, গ্রুপ থিয়েটার একটা আর্ট ফর্ম, যেখানে জমজমাট সেট-লাইট দিয়ে অ্যাকশন থাকবে কেন? থাকবে কেন জমকালো চটকের অ-দরকারি মেকআপ-পোশাক। সাধারণ রঙ্গালয় থেকে গ্রুপ থিয়েটার আলাদা। কেন – তার প্রধান কারণ হল, গুণমান, শৈল্পিক গুণমান। যেখানে বাজার ধরতে তিন তিনবার একই সংলাপ বলবেন না শিল্পী। যেখানে টিকিট বিক্রি না হলেও, প্রতিটি খালি আসনকে শুনিয়ে সংলাপ বলবেন শিল্পী, একই শৈল্পিক পারদে। কে না জানে, শূন্য দর্শক থিয়েটারের ইতিহাসে আরেকটি ইতিহাস ও বিতর্কের সূচনা করে দিয়েছে। বিবর্তিত ইতিহাসে কোথাও কোথাও শূন্য দর্শক বা খালি বেঞ্চ রয়েছে। তাও এখন-তখনে অনেক সময় পেরিয়েছে। কেউ বলছেন দেড়শো বছর। আবার, তারও আগে যে নাট্যচর্চা তার বয়স-সাল-তারিখ কি শুধুই ইতিহাস? তার তামাম বেত্তান্ত কি সুধীজনের 'থেটার' নয়। নয় নয় করে কলকাতার জন্ম, থিয়েটার নিয়ে আসা লেবেদফ, এদেশের লোকেদের থিয়েটারের হুজুগ, বাগানবাড়ির থিয়েটার – সবই তো থিয়েটার। ইতিহাস শুধুই বিশ শতকের বই ঝেড়েপুছে নিয়ে লেখা নয়। তারমধ্যে মেরু হয়ে রয়েছে ইচ্ছুকদের নাট্যশালার প্রথম ধাপ। যেখানে সব ইতিহাস সংরক্ষিত নয়। বিচ্ছিন্নভাবে। তাই, তারিখের সন্ধানে পেরেছে তুলসী লাহিড়ী থিয়েটার ভালবাসা বা থিয়েটার সেই স্থান, যেখানে অভিনেতা তৈরি হয়। পাকা-পোক্ত অভিনেতাদের স্থান হয় পর্দায়, যা ছোট এবং বড়।
_ ইতি
একুশ শতকের ফ্ল্যাশব্যাক সত্ত্বাধিকারী …
লেখাটি শুধু ভালো বললে গা ছাড়া কাজ করা হবে। কারন, লেখাটি বেশ যুক্তিযুক্ত এবং উপযোগী। এই রকম লেখা বারে বারে আসুক।
উত্তরমুছুনapnar porichoy jante icche ... suvechha afuran ...
মুছুন