কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

শনিবার, ১৪ জানুয়ারী, ২০২৩

দেবাশিস সরকার

 

সমকালীন ছোটগল্প


হরে দরে কাশ্যপ গোত্র

 

-- না স্যার! এটা আমার উইকলি নিউজপেপার।

--অত টেকনিক্যাল পয়েন্ট ধরেন কেন? বেশ! তাই সই! আপনার মতটাই থাক! উইকলি বুলেটিনই বলুন না হয়!

-- সে কি কথা! রেজিস্ট্রেশন আছে বই কি! না হলে করপোরেশনের এড ছাপছি কিসের জোরে?

--না, ডেলি নয়। ছেচল্লিশ দিন বাদে করপোরেশন ইলেকশন। আমাদের শহরে এখন খবরের হেভি ডিমান্ড। আমার কাগজও তাই ডেলি বেরোচ্ছে। পাবলিক নিউজ খেতে চাইছে দুবেলা চায়ের সঙ্গে, আমিও সাপ্লাই দিচ্ছি! কিছু কামিয়ে নিই এই মওকায়! হ্যাঃ হ্যাঃ হ্যাঃ!  --আজ্ঞে হ্যাঁ! পাঁচজন রিপোর্টার আমার কাগজের। কী?

--না! বাব্বা ! সব টেম্পোরারি! পার্মানেন্ট রিপোর্টার রাখবো কোত্থেকে? তাহলে তো 'শিল্প-বার্তা' না হয়ে 'আনন্দবাজার' কিংবা 'আজকাল' নাম হতো কাগজের! হ্যাঃ! পার্মানেন্ট রিপোর্টার! 'একে মা রাঁধে না, তায় আবার পান্তা!'

--না না! ইলেকশন উপলক্ষে না, আমার কাগজ প্রথম থেকেই বারো পাতার। আপনি কি পড়েছেন কখনো? তবে এক কাজ করেন, ইলেকশনের দিন অব্দি এখানে আছেন যখন কিনুন রোজ। চার টাকা তো মোটে। রোজ পাঁচখানা করে ওয়ার্ডের হাল হকিকত নিয়ে লেখা থাকবে।

--বেশ বললেন যা হোক! করপোরেশন ইলেকশনে আমার কাগজের ভূমিকা নতুন করে কী আর থাকবে! সেই তো আদ্যিকালের পুরনো ট্র্যাডিশন! নাগরিক সুবিধা, সুযোগ ঠিকঠাক পেলাম বা পাচ্ছি কি না! এই তো? এরই হিসাব মতো রুলিং পার্টিই থাকবে নাকি বিদায় নেবে সেটা ঠিক করবে ভোটাররা। এই জনমতটুকু তৈরী করতে সাহায্য করে প্রিন্ট আর ইলেকট্রনিক মিডিয়া। নয় কি?

--হ্যাঁ! সেটাই তো স্বাভাবিক। কোলকাতা বেসড মিডিয়া আমাদের শহরের প্রতিটি ওয়ার্ড ধরে ধরে  রিপোর্ট ছাপবে কেন? তাদের পাঠকের কাছে এই বাংলার যে কোনো একটা শহরের মিউনিসিপ্যাল ইলেকশন মেইন ফুড আইটেম নয়। জাস্ট একটা তরকারি মাত্র! হাঃ!হাঃ! হাঃ!

--ওঃ! বারবার বলছি খাবার- ফুড আইটেম! বুঝতে চাইছেন না? সামান্য চার টাকার কাগজ বিক্রি করে খরচাপাতি বাদ দিয়ে ক'পয়সা থাকে আমাদের? সে ভরসায় মাইনে দিয়ে রিপোর্টার রাখা যায়!

-- কামাবো না কেন? সন্ধে থেকে বাংলা নিউজ চ্যানেলগুলো লক্ষ রাখুন! সবকটাই আমাদের শহরের কোনো না কোনো ওয়ার্ড নিয়ে আধঘন্টা ভ্যাজর ভ্যাজর করছে! এমনি এমনি? আবার, এখানে শুধু আমি নই, আরও দুখানা কাগজ গজিয়েছে! তারাও বাজারে নেমে পড়েছে!

-- বুঝলেন না! বোঝাই তাহলে! আমাদের শহরে এখন টাকা ওড়ানোর খেল শুরু হয়েছে! যে পারছে কুড়িয়ে নিয়ে পকেটে ভরছে। মাস দেড়েক পরেই এ খেলা শেষ। সুতরাং, এই ক'টা দিনই কামানোর  মরশুম। এরপর লোকসভা, কে পোঁছে আমাদের! দু বছর বাদে বিধানসভা ভোট, তখনও পাত্তা পাই না।

--কী? আরে হেজিটেট করছেন কেন! ঝেড়ে কাশুন না!

--ও! এই কথা! টাকা কিভাবে আসে? স্পনসর রা দেয়!

--হ্যাঃ! হ্যাঃ! হ্যাঃ! বোঝাচ্ছি! না দাদা! ক্রিকেটার বা ফুটবলারের জার্সিতে বা টিভি সিরিয়ালের আগে পিছে যেসব কোম্পানির নাম লেখা থাকে তারা কি আমার কাগজে বিজ্ঞাপন দেবে? এই করপোরেশন ইলেকশনে যে সমস্ত প্রার্থী লড়ছে তারাই আমাকে বিজ্ঞাপন দেয়।

--এক দুজন কেন? সব্বাই দেয়!

--এখানে বিয়াল্লিশখানা ওয়ার্ড আছে জানেন তো? চারটে পার্টির একশ আটষট্টি খানা ক্যান্ডিডেট। ফাউ হিসেবে আছে গোটা তিরিশেক নির্দল, বটে তো? হরেদরে দু'শো খানা স্পনসর আমাদের। কি বিশাল বাজার আমাদের ভেবেছেন এর আগে?

-- কোন লোকাল কাগজ পরপর কিছুদিন দেখেছেন এর আগে?

-- ও বাবা! ভালো করে খোঁজ খবর না নিয়েই স্টোরি করতে নেমে পড়েছেন? বেশ! আপনি আগে অন্তত দিন দশেক আমার কাগজটাই কিনুন! রোজ সকালে চকবাজারের  'নন্দী বুক স্টলে' পেয়ে যাবেন। লক্ষ থাকে, বারো পাতার কাগজটিতে যেন অন্তত তিন চারখানা ওয়ার্ডের কিছু না কিছু সমস্যা নিয়ে লেখা ছাপা থাকে। সঙ্গে যেন অন্তত চারটে কোয়ার্টার পেজে চারটে স্পনসরের এড ও ছাপা হয়।

--হাঃ!হাঃ! সব পাখিপড়া করে বোঝাতে হবে স্যার? দেখবেন, ছাপা আছে, 'আমরা 'শিল্পনগরী বার্তা'র সমৃদ্ধি কামনা করি। আমরা নিশ্চিন্দিপুরের সর্বাঙ্গীন উন্নতির জন্য দায়বদ্ধ।" পরের লাইনে শ্রী বা কম অমুক চন্দ্র তমুক, তমুক নং ওয়ার্ডের বিদায়ী কাউনসিলার বা প্রার্থী। আপনার শহরকে আরো উন্নততর করার জন্যে অমুক চিহ্নে ছাপ দিন!' এর সঙ্গে ক্যান্ডিডেটের দলীয় প্রতীক  চিহ্ন।

--হ্যাঁ! তাও থাকে একটা দুটো ।'রাধারানী বস্ত্রালয়' কি 'মামণি জুয়েলার্স'ও বিজ্ঞাপন দেয় মাঝে মাঝেই! তবে তাদের রেট ক'টাকাই বা আর! লোকাল জাগজের হাফ পেজ কাগজের রেট দু-তিন হাজার টাকা হলেই সেটা বেশ বেশি!

--হ্যাঁ! এটা তো অনুমান করাই যায়! এড পড়ে কোন কাস্টমার কোন দোকানে কিনতে এসেছিল আমি অন্তত শুনিনি। সিটিং কাউন্সিলার বলে দেয় তাই এড দেয় একখানা। এটাকে কি টাকা কামানো বলে?

--পাগল! ভোটের ময়দানে কব্জির জোর পরীক্ষা করতে নেমেছে যারা তারাই টাকা ওড়ায়।

--তাও জানতে হবে? অন্যসব কাগজ বা নিউজ চ্যানেলগুলো কে কত টাকা পায় বলতে পারি না, আমার কথা বলতে পারি। আপনি সিবিআই বা ইনকাম ট্যাক্সের লোক তো নন, হলেও আমার কিছু যায় আসে না, আমার তো দু-নম্বরি ইনকাম না, আমার শালীর আব্দার- আপনাকে হাঁড়ির খবরাখবর জানাতে হবে। যতটা পারি বলি-

--হ্যাঁ! ধরেছেন খানিকটা। নানান বদ্যি নানান দাওয়াই! সিটিং কাউনসিলাররা চল্লিশ থেকে পঞ্চাশ দেয়, বাদবাকী তিনটে পার্টির ক্যান্ডিডেটগুলো দশ-পনেরোর বেশি উঠতে চায় না। স্পেস ফাঁকা থাকলে নির্দলগুলোর এড ছাপি।

--ওরা ? বেশি না, দুই থেকে পাঁচ হাজার। তাও বারগেন করে করে যতটা ওঠে !

-- হাসালেন স্যার! আমি কি এই খোঁজ নিতে পারি? কোন কোন বিষয়ে নাক গলানো বারণ আমাদের। আমরা তো আর সিবিআই বা পুলিশ নই! টাকা কোত্থেকে আসছে কেউ বলে!আমার হাতে টাকা আসবে, তারপর ম্যাটার ডিটিপি হবে  ব্যস! আমার দৌড় এইটুকু!

--এটা যেমন আপনি আমি জানি, ওরাও কি জানে না? আমার ইয়ের কাগজে ওদের বিজ্ঞাপন ছাপা হল কি হল না তা দেখে কেউ ভোট দিতে আসে না। বিজ্ঞাপন দেয় এই ভয়ে পাছে ওদের বিরুদ্ধে কোন লেখা না ছাপা হয়। কে চেয়ারে বসবে সেটা যে একমাত্র মিডিয়াই ঠিক করে দেয় সেটা ওরা জানে!

--আপনার কথাটি খানিকটা মানছি। মানুষ তার চারপাশের জগৎ থেকে দেখেশুনে আর পত্র পত্রিকার রিপোর্ট পড়ে ভোট দেওয়ার ডিসিশন নেয়, এটা খানিকটা ঠিক--

--ইয়েস স্যার! খানিকটা, পুরোটা নয়।

--শুনুন! আপনি বা আপনারা ক'জন জানেন যে অমুক পার্টি যদি ভোটে জেতে ভালোই হবে। বেশ? এদিকে আমি বা আমরা বলব, না, অমুক না। তমুক পার্টিই ভালো।"তাই তো?

--বেশ! এবার, আমার বা আপনার মতের বাইরেও একটি মত আছে যা সমস্ত যুক্তিবাদী মানুষের মগজেও ফেনাতে থাকে একটানা, তার খোঁজ  রাখেন কি? মিডিয়ার জোরের জায়গাটা এখানেই!

--আপনারা লেখক মানুষ। মানুষের অন্তর্লোকের রহস্য নিয়ে মশগুল থাকেন!  আমাদের কারবার চাক্ষুষ ঘটনা নিয়ে। আপনারা বলেন," ব্রহ্ম সত্য, জগৎ মিথ্যা। এর বাইরে আর কিছু নেই।" "আমরা বলি ,''জগৎকে যে মিথ্যা বলা হচ্ছে তার স্বপক্ষে যে যুক্তিগুলি তুলে ধরা হচ্ছে সেগুলো এতোই দুর্বল ,যে জগৎ মিথ্যা নয় বলেই মনে হচ্ছে। জগৎ তো সত্যিও হতে পারে!'' মানুষের আবেগ এই খাতেই বয়ে চলে স্যার! প্রিন্ট মিডিয়ার জোরের জায়গাটা এটাই! মোদী থেকে দিদি সবাই এটা জানে! হ্যাঃ! হ্যাঃ! হ্যাঃ!

-- ইলেকট্রনিক মিডিয়া দুর্বল সেটা আবার কখন বললাম স্যার? সে বিষয়ে পরে আসছি-

--ও! শুধু কথার কচকচি চলছে বলছেন? তা হবে! বেশ! পুরনো পাড়ায় ফেরা যাক- আপনি খবরের কাগজের হেঁশেল নিয়ে একটা লেখা তৈরি করার আগে আমার কাছে সুলুক সন্ধান নিতে এসেছেন। তাই তো?

--বলব। আপনার লেখা আমি কখনও পড়িনি, আমার গিন্নীকে আপনি চেনেন না, সে কিন্তু পড়ে আপনার লেখা। খবরের কাগজের সঙ্গে আপনাদের পত্রিকাটিও বাড়িতে আসে যে! ওতেই তো আমার শালীর কবিতা ছাপা হল একবার। জানি না, আপনার সুপারিশেই কিনা, পড়েচেন সেটা?

--আমিও না! সময় কোথায়! বাঙালি ইয়াং জেনারেশন পুড়কি জাগলেই ওইসব কোবিতা-ফোবিতা, গল্প-ফল্প লেখে কিছুদিন-তারপর--

--কি? বেশ! থামা যাক! আমার শালী কিছুদিন আগে বলছিল, আপনি আসবেন আজ, খোঁজ খবর নেবার  জন্যে। ভালো কথা! তা, জেনে নিই আগে, আপনি কি ওই কাগজটার এমপ্লয়ী লেখক? নভেল লেখবার মালমশলার স্কুপ নিতে এসেছেন?

--জিজ্ঞেস কেন করছি তার কারণ আছে স্যার! কাগজের লোকেরা ভালোই জানে ভোটের বাজারে টাকা কেন ওড়ে, কারাই বা ওড়ায়, আর কারাই বা কুড়োয়! হ্যাঃ! হ্যাঃ! হ্যাঃ! সামান্য একটা করপোরেশন ইলেকশন জিততে পারবে না জেনেও একজন নির্দল ক্যান্ডিডেট দশ, বিশ হাজার উড়িয়ে দিচ্ছে!

--শুধু বিজ্ঞাপন কেন, কোনো কোনো পার্টির ক্যান্ডিডেট হয়ে দাঁড়াতে গেলেও  পার্টি ফান্ডে ছ' থেকে আট লাখ ডোনেশন লাগছে! জানেন?

--বিশ্বাস না হওয়ারই কথা! ভেঞ্চার ক্যাপিটালিজম টার্মটা শুনেছেন?

--আরে! আমি কি পন্ডিত নাকি! কোথায় যেন পড়েছিলাম! একজন নির্বাচন প্রার্থীর পেছনে যে পুঁজি লাগানো হয়, আগামী পাঁচ বছরে তার দশগুণ রিটার্ন আসবে হাতে। এই উদ্যেশ্যে ভোটের বাজারে যে টাকা ওড়ে তার পোশাকী নাম এটা।

--কে বলছে হচ্ছে না? রিটার্ন কত হল, তা চোখে দেখতে পাচ্ছি না বটে, তবে পুঁজি যে লাগানো হয় সে তো সবাই জানে!

--যা বাবা! এটাও জানেন না! মাল্টি ন্যাশনাল কোম্পানিগুলো নানান পার্টিফান্ডে টাকা দেয় না? অবশ্য আমাদের দেশের সব এমপি রাই একশ-দুশো কোটি টাকার মালিক। তারা নিজেরাই-

--ও! আপনি শুধু করপোরেশন ইলেকশনের খুঁটিনাটি জানতে চান? বেশ! পার্টি ফান্ডে ছ'লাখ, প্রচারের পেছনে লাখ দুই, ভোটের দিন বুথ জ্যাম, ছাপ্পা ভোট এসবের পেছনে দু লাখ ইত্যাদি প্রভৃতি মিলিয়ে লাখ দশেক লাগে একবার লড়তে--

--আরে বাবা! আগামী পাঁচ বছরে সত্তর আশি লাখের গ্যারান্টি যেখানে সেখানে এই  ইনভেস্টমেন্ট অনেকেই করতে চায়। দেখুন, অন্য সব কাগজ কে কত কামায় বলতে পারি না, ভোটের মরশুমে বিজ্ঞাপন ছেপে চারপাঁচ লাখ টাকা থাকে আমার! এই ইনকাম থেকেই তো আগামী পাঁচ বছর আমার কাগজ ছাপা হয়!

--এই তো মুশকিলে ফেললেন স্যার! আপনি জিজ্ঞাসা করতেও ছাড়ছেন না, আবার এককথায় বিশ্বাসও করতে চাইছেন না! কথার মাঝে এটা কি, ওটা কি, বলে লাইনের গাড়িকে বেলাইন করে দিচ্ছেন বারবার! বিশ্বাস করতে আপনার আটকাচ্ছে কোথায়! শুনুন তাহলে একটা সত্যি ঘটনা! দিন পাঁচেক আগে আমার কাগজের একজন রিপোর্টার এসে বলল, ''দাদা! অমুক ওয়ার্ডের কাউনসিলার বলল,'আমি কোনো কাগজে এড দেব না। গত পাঁচ বছরে আমার কাজ দেখে প্রচারে না বেরোলেও পাবলিক আমাকে এমনিই ভোট দেবে।' ভেবে দেখলাম, বেশ বিপদ! আমরা খাওয়াবো তবে তো পাবলিক খাবে! পাবলিক যদি নিজেরাই খেতে শিখে যায় আমরা কি ঘাস ছিঁড়বো! গেলাম পরদিন ওর বাড়িতে।

--আহা! আম খেতে এসেছেন, খান না যত খুশি! গাছ গোনার কি দরকার মশাই! কত নম্বর ওয়ার্ড, কি নাম জেনে লাভ নেই! মালটা তো দেখা করতেই চাইছিল না, পারলে গেট থেকেই ভাগিয়ে দেয়!

--হ্যাঁ! গেট মানে গেটই! দুটো লরি পাশাপাশি ঢুকে যাবে এতো চওড়া! একতলা বাড়ির সমান উঁচু ভারী লোহার গেট!

--হাসালেন স্যার! একতলা বাড়ির সামনে এ গেট মানায়! অট্টালিকা!

--নয় কেন? এ তো এখনও মার্সিডিজ কেনেনি! গ্যারেজে মাত্র গোটা পাঁচেক--

--না না! গেট কিপারের হাতে কার্ড পাঠালাম। নেহাত সামনে ইলেকশন তাই বোধহয় এল গেটে।

--না। ভেতরে যেতে বলল না।

--আমি আমার কাগজের নীতি বললাম। যেহেতু পাবলিক নিউজ খেতে পছন্দ করে তাই 'নিউজ মেকার' হতে চাইলে বা পাবলিসিটি পেতে চাইলে টাকা খরচ করতে হবে।

'ফ্যালো কড়ি, মাখো তেল! তুমি কি আমার পর!'

--অত সহজে হবে! উত্তরে একই বুলি আওড়াল যা আমার রিপোর্টারকে বলেছিল। উত্তরে, মালটাকে হতভম্ব করে দিয়ে ওর গেটে দাঁড়ানো অবস্থার ক'টা ফটো তুললাম। এরপর ওর গেটের বাইরে রাস্তায় নেমে সেখান থেকে ওর প্রাসাদের গোটা কতক ফটো নিলাম। ও তো বেশ ঘাবড়ে গিয়ে ''এই! এসব কি হচ্ছে? ফটো তুলছেন কেন?'' চিৎকার করছিল।

--না না! কিসের ব্ল্যাকমেল বা ভয় দেখাবো? রাজপ্রাসাদের মতন বাড়ি? সামান্য পঞ্চায়েত মেম্বারও আজকাল কলকাতায় বা দিল্লিতে তিন হাজার স্কোয়ার ফুটের ফ্ল্যাট বুক করছে! তোলা ছবিগুলো ক্যামেরার ভিউ ফাইন্ডারে এনে ওকে দেখালাম সব। এবার বললাম মোক্ষম কথাটা!

--ওর চোখমুখের ভাব দেখে বুঝলাম, ফটোগুলো ওর খুব পছন্দ হয়েছে। ওর কাছে জানতে চাইলাম, রাস্তা থেকে দাঁড়িয়ে বহুবার তো ও এই বাড়িটাকে বহুবার দেখেছে! এই গেটেও এরকম বহুবার দাঁড়িয়ে থেকেছে! এসব তো ওর কাছে নতুন কিছু নয়! অথচ এই ফটোতে অন্যরকম লাগছে কি না! মালটা ঘাড় নেড়ে সায় দিল। তখন ওকে বোঝালাম, 'একটা চিরপরিচিত বা বহুবার দেখা দৃশ্যপটকে যখন দেখি, তখন একটি পারিপার্শ্বিকের ভেতর দেখি।কিন্তু যেই--

--হাসালেন স্যার! ওর কাছে এত ভালো বাংলা বললে ও ঘোড়ার ডিম বুঝবে। আপনি লেখক মানুষ, তাই এভাবে বলছি। ওকে বললাম,"বহু পরিচিত একটি  লোক বা দৃশ্যকে যখন ভিড়ের মধ্যে দেখি, তখন সেটি একটি মামুলি দৃশ্য মাত্র। কিন্তু যখনই সেটিকে একটি ফ্রেমের ভিতরে রেখে দেখব, সেটি কিন্তু আর মামুলি বা সাধারণ দৃশ্য না হয়ে একটি চমৎকার দৃশ্য হয়ে উঠবে। ট্রেনের জানালার ফ্রেমের ভিতর দিয়ে একটি পুকুর আর পাড়ের দুটি তালগাছ চমৎকার লাগে দেখতে কিন্তু যেই ট্রেন থেকে নেমে কাছে গিয়ে দেখবো, এমন কিছু আহামরি লাগবে না। আপনি ফ্রেমবন্দি হতে না চাইলে কোনো দুঃখ নেই আমার, আপনার ওয়ার্ডেই তো আরো তিনজন ক্যান্ডিডেট লড়ছে! কেউ না কেউ দেবে বিজ্ঞাপন। আমার কাগজে সপ্তাহে চারদিন মানে তিন চারে বারো'শ শব্দের রেট ষাট হাজার টাকা।" মালটা গুম হয়ে ভাবতে শুরু করল। আমার কার্ডটা ওর সামনে মাটিতে ফেলে দিয়ে হাঁটা লাগলাম।

--হ্যাঁ! নাহলে আর এতো সাতকাহন করছি কেন? পরদিন দুপুরেই ফোন! আমি জানতাম, ফোনটা আসবে , দরাদরি করতে চাইছিল, স্রেফ না করে দিলাম।

--আরে দাদা! কলকাতার নিউজ চ্যানেলগুলো তো একটা পনের মিনিটের স্লটের জন্যে দেড় লক্ষ টাকা নিচ্ছে!

--শুনুন দাদা! আপনি মানুষের মগজের পুষ্টি বা বদহজম সাপ্লাই দেন, আমার কাজ মানুষের খবরের খিদে মেটানো। আমার রান্নাঘরের হাঁড়ি, কড়াই সবই উল্টে পাল্টে দেখালাম আপনাকে, তাই তো? আপনার হেঁশেল নিয়ে আমি কিন্তু কোন কৌতূহল দেখাইনি।

--ও! মরালিটি? হায় দাদা! আপনাদের বঙ্কিম, শরৎ চাটুজ্যেরা এসব মালমশলা দিয়ে তাঁদের নভেলের ভিত বানিয়েছেন। আপনিও কি ওই একই মাল দিয়ে--

--স্যরি! ঠিক আছে-ব্রেক কষলাম। আপনি চাইছেন, কাগজের রিপোর্টার, এডিটর, মালিকরা প্রফেশনাল এথিক্স মেনে চলবে। মন্দ না! অন্য সবাই মানছে তো? হাঃ হাঃ হাঃ!

--ইয়েস স্যার! পাঠকদের সাথে আমার সেলার-কাস্টমার, প্রোডিউসার - কনজিউমার সম্পর্ক। ওরা খায়, আমি বানাই। ভেবে দেখবেন, আপনিও তাই!

--নয় কেন? পাবলিকের চাহিদা আপনার কাগজের এডিটর বোঝেন। তাঁর রোলটা ঠিক রেস্টুরেন্টের ক্যাশে বসে থাকা মালিকের মতন! পাবলিক এসে যেমন যেমন অর্ডার দেয়, আপনারা তেমন তেমন বানিয়ে গরম গরম সার্ভ করেন । নয় কি? হাঃ হাঃ হাঃ!

--ওকি! মুখ গোমড়া হয়ে গেল! তুলনাটা পছন্দ হল না? আরে দাদা! আমরা সবাই হরে দরে সব এক গোত্রেরই! না হয় আপনার পছন্দসই অন্য একটা উপমা খুঁজতে হবে! ভেবে দেখি! আপনিও ভাবুন না হয়! ভাবুন! ভাবা প্র্যাকটিস করুন!


0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন