কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

শনিবার, ১৪ জানুয়ারী, ২০২৩

রামশরণ শর্মা

 

প্রাচীন ভারতে শূদ্রেরা


(অনুবাদ: চন্দন দত্ত)




(নিম্নতর বর্গের আনুমানিক ৬০০ খৃষ্টাব্দের পূর্বেকার এক সামাজিক ইতিহাস। ভারতের প্রথম সারির ইতিহাসবিদদের মধ্যে অন্যতম, প্রয়াত শ্রদ্ধেয় রামশরণ শর্মা দ্বারা লিখিত ‘SUDRAS IN ANCIENT INDIA -- A Social history of the lower order down to circa AD 600’ নামক প্রসিদ্ধ গ্রন্থের বাংলা অনুবাদ।)

*অধ্যায় - ৩ / ৪*                                       

*উপজাতি বনাম বর্ণ: (আনুমানিক ১০০০ খৃষ্টপূর্বাব্দ থেকে ৫০০ খৃষ্টপূর্বাব্দ পর্যন্ত)*

ঐতরেও ব্রাহ্মণ-এর রচনাংশে ফিরে এলে, শূদ্রদের ক্ষেত্রে প্রযুক্ত দুটি বিশেষণের যে অর্থ প্রকাশ করা হয়েছিল, সেগুলি কেবলমাত্র বাকচাতুর্যে মনোহর ছিল। সমগ্র বৈদিক সাহিত্যে, এমন কোনো সমান্তরাল রচনাংশ নেই, যেটি শূদ্রদের এইভাবে বিবৃত করেছে যে তাদের অপসারিত করা বা হত্যা করা যেতে পারে, তাদের প্রভুর ইচ্ছা সাপেক্ষে। প্রকৃত অবস্থার প্রতিনিধিত্বকারী বিবরণ হিসেবে যা কিছু বিকল্প অর্থ এ যাবত নির্দেশিত করা হয়েছে, সেগুলি নির্ধারিত করা কষ্টকর। সেটি এইজন্যে যে, ঐতরেও ব্রাহ্মণ-এর গ্রন্থ : ৭-টি (Book - VII), যার মধ্যে বিচার্য রচনাংশটি রয়েছে, সেটি পরবর্তী পর্যায়ের একটি অংশ। এটি আশ্চর্যজনক হবে না, যদি বিভিন্ন বর্ণের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য অংশগুলির মধ্যে কোনো একটি বিশেষণ এক্ষেত্রে কোনো খারিজ হওয়া বা প্রত্যাখ্যাত হওয়া পুরোহিত দ্বারা ব্যবহার করা হয়ে থাকে, নিজেকে পৃষ্ঠপোষক রাজার অনুগ্রহ ভাজন করে তোলার উদ্দেশ্যে। এটি তাৎপর্যবিহীন নয় যে, এমনকি একজন ব্রাহ্মণকেও বিবৃত করা হয়েছে এইভাবে যে তাকে ইচ্ছানুসারে অপসারিত করা যেতে পারে। এমন একটি ক্ষেত্রে, অন্য বর্ণগুলির অবস্থান সুন্দর ভাবে অনুমান করা যেতে পারে।

এই সমস্ত বিবেচ্য বিষয়, যদিও, পরের দিকের বেদকীয় রাষ্ট্রশাসনব্যবস্থায় শূদ্রদের নিম্ন পদমর্যাদাকে কোনভাবেই খন্ডন করে না, আমাদের উদ্দেশ্য হচ্ছে সেটিকে সঠিক ভাবে বর্ণনা করা। এবং এটি ভীষণ ভাবে পরিষ্কার যে, শূদ্রেরা যখন বেশ কয়েকটি সমারোহ অনুষ্ঠানের সাথে সংযুক্ত ছিল, যার মধ্যে দুটি বলিদান অনুষ্ঠান ছিল গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক চরিত্র সম্পন্ন, অশ্বমেধ এবং রাজসূয়, তখন সেই সময়, সম্ভবত বেদকীয় পর্যায়ের শেষে, একটি নিশ্চিত প্রবণতার সূত্রপাত হয়ে গিয়েছিল, -- রাজনৈতিক জীবনের সাথে জড়িত সেই সমস্ত ধর্মানুষ্ঠানগুলি থেকে তাদের বিতাড়িত করার। কয়েকটি ক্ষেত্রে বৈশ্যরাও শূদ্রদের অনুরূপ ভাবে নিন্দিত হয়েছিল এবং বঞ্চিত হয়েছিল তাদের পূর্ব অধিকারসমূহ থেকে। কিন্ত আমরা যদি ঐতরেও ব্রাহ্মণ-এর রচনাংশের ওপর নির্ভর করি এবং এর কাল-নির্দেশ করি খৃষ্টপূর্বাব্দ প্রথম সহস্রাব্দে, সেক্ষেত্রে এটি প্রতীয়মান হবে যে, সেই সময় পর্যন্ত উপরি গঙ্গা অববাহিকার সমাজ শ্রেণী বিভক্ত হয়ে গিয়েছিল, এবং যদিও বৈশ্য ও শূদ্রেরা দুটি নিম্নতর বর্গের গঠন করেছিল, তাদের নিজ নিজ অবস্থান পরিষ্কার ভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছিল। বৈশ্যরা প্রতিনিধিত্ব করেছিল কৃষকদের, কারণ পি জি ডব্লিউ প্রান্তরগুলিতে (PGW Sites) ইতিমধ্যেই ধান ও অন্যান্য ভক্ষ্য শস্যের উৎপাদন অসংখ্য গ্রামীন বন্দোবস্ত-কে নির্দেশিত করেছিল। তারা নিয়মিত খাজনা প্রদান করবে এমনটাই প্রত্যাশিত ছিল এবং সেই কারণে তারা বর্ণিত হয়েছিল এমন মানুষ হিসেবে যারা ভুক্ত এবং লুন্ঠিত হওয়ার জন্য অভিপ্রেত ছিল, যাতে 'ক্ষাত্র'-দের (ksatra) দ্বারা রাজস্ব সংগৃহীত করা যায় ; অপরদিকে শূদ্রেরা উদিত হয়েছিল গার্হস্থ কাজের উপযোগী একটি শ্রেণী হিসেবে, উচ্চতর ও নিয়ন্ত্রণকারী শ্রেণীকে সেবার নিমিত্ত।

ধর্মানুষ্ঠান-মূলক সাহিত্যগুলিকেও শূদ্রদের সামাজিক অবস্থান সম্পর্কিত কিছু সংবাদ সংগ্রহের কাজে ব্যবহার করা যেতে পারে। যজু-সংকলনের একটি রচনাংশ বিবৃত করে যে, বৈশ্য এবং শূদ্রেরা একই সাথে সৃষ্ট হয়েছিল। এটি ধাবিত হয় পুরুষাসুক্ত সংস্করণের বিপরীতমুখে, যার মধ্যে সৃষ্টির অনুক্রমে বৈশ্যদের উপবিষ্ট করা হয়েছে শূদ্রদের পূর্ববর্তী স্থানে এবং যারফলে শূদ্রদের অবস্থান নির্ধারিত হয়েছে সমাজের একেবারে সর্বনিম্ন স্থানে। কিন্ত সামাজিক শ্রেণী-বিভাগে বৈশ্য ও শূদ্রদের একই বিভাগে রেখে দেওয়ার প্রবণতা লক্ষ্য করা গেছে কিছু আচার-অনুষ্ঠানে, যেটি দেখিয়েছে যে, একজন বৈশ্য কোনো শূদ্র নারীর স্বামী হতে পারে এবং একই ভাবে তার বিপরীতও হতে পারে। হাস্যকর ভাবে এটি বিবৃত করা হয়েছে যে, শূদ্র নারীর এক আর্য স্বামী সমৃদ্ধি চায় না, --  ধারণাটি এমন যে, এই বিবাহ উক্ত স্বামীকে তিরস্কার করেছে একটি দীর্খস্থায়ী দীনতার জীবন। ভাষ্যকারেরা আর্য শব্দটির অর্থ গ্রহণ করেছেন বৈশ্য হিসেবে, যেটি বৈশ্য ও শূদ্র নারীর মধ্যে বিবাহের প্রমাণ উপলব্ধ করেছে ; কিন্ত বৈদিক তর্জমা এই ধরনের উল্লেখসমূহকে বিবেচিত করে আর্য ও শূদ্রদের অবৈধ মিলন হিসেবে। পঠনের ক্ষেত্রে বেশিরভাগই যেহেতু আর্য শব্দটিই পড়তে হতো, সেইজন্য এক্ষেত্রে ভাষ্যকারের ব্যাখ্যা মনে হয় ঠিকই। জে এগেলিন (J. Eggeling) আর্য শব্দটির বারংবার পঠনের বিষয়টি মেনে নিয়েছেন, শতপথ-ব্রাহ্মণ অনুবাদ করতে গিয়ে, যেখানে তিনি সেটিকে সঠিক ভাবে বৈশ্য হিসেবে উপস্থাপিত করেছেন। কিন্ত এটিও সমস্ত সম্ভাবনার বাইরে নয় যে, রচনাগুলি ক্ষতিগ্রস্ত করা হয়েছে, নতুন পরিস্থিতির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ ভাবে, যখন উচ্চ বর্ণের সদস্য এবং শূদ্রদের মধ্যে বিবাহকে বিরূপতার নজরে দেখা হতে থাকে। এই ধরনের একটি ধারণার ভিত্তিতে, আর্য ও শূদ্র উপজাতির মধ্যে অথবা সেইসব মানুষ, যাদের শূদ্র বর্ণে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল, তাদের মধ্যে অবাধ বৈবাহিক সম্পর্কের কথা মনে আসা সম্ভব। পরবর্তীতে এই ধরনের সম্পর্ক সীমাবদ্ধ হয়ে গিয়েছিল দুটি নিম্নতর বর্গের মধ্যে।

ব্রাহ্মণগুলিতে, পুরোহিত এবং উচ্চবংশজাতরা মনে হয় শূদ্র-সহ অন্যান্য নিম্নতর শ্রেণীর সাথে পরিনয়সূত্রে আবদ্ধ হওয়ার ক্ষেত্রে অবাধ ছিল, যেমনটি ভাত্সা (Vatsa) এবং কাভাসা'র (Kavasa) ক্ষেত্রে দেখা গেছে। ভাত্সা-কে তার ভাই মেধাতিথি (Medhatithi) শূদ্র-পুত্র বলতো, যেটি বোঝায় যে, এটি সম্ভবত গালাগালি হিসেবে ব্যবহার করা হতো না। এটি বলা হয়েছে যে, ভাদসা আগুনের ওপর দিয়ে অক্ষত অবস্থায় হেঁটে, তার ব্রাহ্মণত্বের প্রমাণ দিয়েছিল এবং এইভাবে সেই অপবাদ মুছে ফেলেছিল। ঘটনাটি দেখিয়ে দিয়েছে যে, কোনো মানুষের সামাজিক পদমর্যাদা তার জন্ম দ্বারা নির্ধারিত হয়না বরং সেটি হয় তার যোগ্যতা দিয়ে। কাসাভা আইলুসা'র (Kasava Ailusa) দাসী হিসেবে জন্মগ্রহণ করার ঘটনাটি সন্দেহজনক বলে প্রতীয়মান হয়। যদিও দাস্যাহ পুত্রাহা (dasyah putrah) নামক যে বিশেষণটি তার ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা হয়েছিল, সেটি সায়ন দ্বারা একটি গালাগালি হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। পঞ্চবিংশ ব্রাহ্মণ উপলব্ধ  করেছে ক্রীতদাস-কন্যা উসিজ-এর (Usig) আইনী বিবাহের একটি ঘটনা, যিনি ছিলেন দীর্ঘতামস-এর মাতা, যেমনটি ব্রহদ্বেবতা'য় (brahaddebata) উল্লেখ করা হয়েছে। পৌরাণিক পরম্পরা আমাদের সূচিত করেছে যে, কক্সিভাত (Kaksivat) নামক এক ব্রাহ্মণ, যিনি দীর্ঘতামস এবং রাজা বালি'র (King Bali's) এক শূদ্র পরিচারিকা-জাত পুত্র ছিলেন, এবং মহাকাব্যে যাঁকে উল্লেখ করা হয়েছে শূদ্র-জাত (sudra-yoni) হিসেবে। এটি নির্দিষ্ট করে বলা হয়েছে যে, মহিদাস (Mahidasa), ঐতরেও ব্রাহ্মণ-এর লেখক, তিনি একজন শূদ্র ছিলেন। এই ধারণাকে সমর্থন করার মতো আর কোনো কিছুই ছিল না, একমাত্র এটি ছাড়া যে, তাঁর পদবি 'ঐতরেও'-কে ব্যাখ্যা করা হয়েছে 'ইতারা'র পুত্র (Itara's son) হিসেবে, যার অর্থ বাছুরের মাংস, নিম্ন অথবা প্রত্যাখ্যাত, কিন্ত এটি মনে হয় অত্যধিক কষ্টকল্পিত। একটি বিলম্বিত 'ব্রাহ্মণ সুদক্ষীনা জাইমী'-তে (Brahmana Sudaksina Ksaimi), একজন দর্শক ও পুরোহিত-কে উদ্দিষ্ট (addressed) করা হয়েছে শূদ্র হিসেবে, কিন্ত সেক্ষেত্রে তাদের বংশপরিচয় সম্পর্কিত কোনো বিবরণ দেওয়া হয়নি, একমাত্র এটি ছাড়া যে, তিনি সীমা'র (Ksema's) বংশধর ছিলেন, এবং সম্ভবত তার ক্ষেত্রে এই বিশেষণটিকে একটি অবমাননাকর শব্দ হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। প্রায় এক ডজন ঋষি, যাঁদের মায়েরা ছিলেন শূদ্র বর্ণের অধীন, তাঁরা তালিকাভুক্ত হয়েছেন ভবিষ্য পুরাণ-এ (Bhabhiswa Purana)। কিছু গৌণ পরিবর্তনসহ তালিকাটি পুনরাবৃত্ত হয়েছে অন্য বেশ কয়েকটি পুরাণে এবং মহাভারতে। এটি আমাদের অবহিত করেছে যে, ভ্যাসা (Vyasa) একজন মেছুনীর গর্ভে, পরাশর (Parasara) একজন স্বপাকা-রমনীর (svapaka woman) গর্ভে, কপিঞ্জালাড়া (Kapinjalada) একজন ক্যান্ডালা (candela woman) রমনীর গর্ভে, বশিষ্ঠ (Vasistha) একজন গণিকার (prostitute) গর্ভে এবং শ্রেষ্ঠতম ঋষি (munisrestha) মদনপালা (Madanapala) ছিলেন এক নৌকা-চালিকা'র সন্তান। এই ধরনের একটি তালিকার ন্যায্যতা-প্রতিপাদন করতে, একেবারে শেষে এটি বলা হয়েছে যে, ঋষি, নদী, ধার্মিক মানুষ, মহান আত্মা এবং খারাপ চরিত্রের নারীদের আবরণ-উদ্ঘাটন করা যায় না। এইসব ঋষিদের কালানুক্রমিক অবস্থা অথবা তাদের প্রকৃত অবস্থান সম্পর্কে নিশ্চিত ভাবে কিছু বলা সম্ভব না, কিন্ত এইরূপ একটি তালিকা ঋষি-পুরোহিতদের শূদ্র অথবা ক্রীতদাস নারীদের সাথে বিবাহের সাক্ষ্য বহন করেছে, সম্ভবত পরেরদিকের বেদকীয় পর্যায়ে। এটি মনে হয় যে, রাজা এবং প্রধানরাও শূদ্র নারীদের বিবাহ করেছিলেন। পালাগলি (palagali), যিনি রাজার চতুর্থ এবং সবচেয়ে কম সম্মানিত পত্নী ছিলেন, তিনি ছিলেন একজন শূদ্র।

উপরোল্লিখিত উদাহরণগুলি দেখিয়ে দিয়েছে যে, উচ্চ বর্ণের লোকেদের সাথে শূদ্র রমনীর বিবাহ অনুমোদনসাপেক্ষ ছিল না এমন নয়। সম্ভবত প্রথম দিকে, বৈদিক ভারতীয়রা এবং আদিম অধিবাসীরা বিবাহ করতো তাদের নিজ নিজ উপজাতির মধ্যে। এমনকি যখন উপজাতিগুলি ভেঙ্গে যেতো এবং তাদের সদস্যরা বিভাজিত হয়ে যেতো চারটি বর্ণের মধ্যে, তখন কিছুদিন হয়ত পুরনো রীতি-রেওয়াজ বজায় থাকতো। কিন্ত পরেরদিকের বেদকীয় পর্যায়ে, ইতিমধ্যেই বর্ণ-বৈষম্য এতটাই শক্তিশালী হয়ে উঠেছিল যে, নিম্ন-শ্রেণীর পুরুষ সদস্যদের সাথে উচ্চ-শ্রেণীর নারীদের বিবাহ অনুমোদনের অতীত হয়ে উঠেছিল। এমন একটি প্রবনতারও সৃষ্ট হয়েছিল যে, শূদ্র নারীদের, উচ্চ বর্ণের পুরুষ সদস্যদের কামনাতৃপ্তির সামগ্রী হিসেবে দেখা হত লাগল। এইভাবে, তুলনামূলক ভাবে পরেরদিকের ব্রাহ্মণ-এ, অনুস্তভ মন্ত্র-কে তুলনা করা হতে লাগল সান্নিধ্যের জন্য প্রস্তুত শূদ্র বেশ্যার সাথে।

এই সময়ই, আমরা দেখতে পাই নমশূদ্রদের (candala) প্রতি ঘৃণার চিহ্ণ। এটি বলা হয়েছে যে, যারা সদাচরণ সম্পন্ন, তারা ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় বা বৈশ্যদের মতো শ্রেয় পুনর্জন্ম লাভ করবে ; কিন্ত যারা অসৎ আচরণ সম্পন্ন, তারা প্রবেশ করবে কুকুর, শূকর বা নমশূদ্রদের পূতিগন্ধময় জঠরে। এটি লক্ষ্যনীয় যে, নমশূদ্রদের অসদৃশ ভাবে, শূদ্র বর্ণে জন্ম নেওয়াকে অপবিত্র রূপে (kapuyam) বর্ণনা করা হয়নি, যদিও মনে হয় সেটিকে অনভিপ্রেত হিসেবে দেখা হয়েছে। এটি পুনরায় প্রতীয়মান হয় যে, নমশূদ্রেরা, যারা ছিল বস্তুত আদাবাসী উপজাতি, তারা বিবেচিত হয়ে আসছিল নিন্দনীয় আচার-আচরণ সম্পন্ন হিসেবে। কিন্ত এই পর্যায়ের প্রাচীন সাহিত্যে, নমশূদ্রেরা প্রতীয়মান হয়েছে পুরুষমেধা বলিদানের এক শিকার হিসেবে, যা অস্পৃশ্য হওয়ার কোনো ঈঙ্গিত বহন করে না। পাউলকাস (Paulkasha) অবশ্য সংযুক্ত ছিল বিতৃষ্ণাজনক বিষয়ের সাথে।, যেটি অস্পৃশ্য হওয়ার কোনো ঈঙ্গিত বহন করে না। পাউলকাস (Paulkasha) অবশ্য সংযুক্ত ছিল বিতৃষ্ণা উদ্রেককারী বিষয়ের সাথে।

পর্যালোচনা-কালের অধীনে সামাজিক নীতিশাস্ত্রে, কিছু নিকৃষ্ট গুণাবলীসমূহ শূদ্রদের সাথে সম্পর্কযুক্ত হয়েছিল। অঙ্গিরা বংশের সুনাহসেপা দ্বারা তার (Sunahsepa)  পিতা অজিগার্তা-কে (Ajigarta) শূদ্র বলে তিরস্কার করতে দেখা গেছে, কারণ তিনি বরুণ-কে (Varuna) বলিদানের নিমিত্ত তিনশত গাভী বিক্রি করেছিলেন। যদিও ঈশ্বর, সন্তানকে নিষ্কৃতি প্রদান করেছিল এবং তার পিতা, কলঙ্ক মোচনের নিমিত্ত তাকে একশত গাভী  দিয়েছিল, কিন্ত সুনাহসেপা (Sunahsepa) তাকে কঠোর শব্দে তাড়িত করেছিল। সে বলেছিল --- "তুমি এখনও শূদ্র সুলভ পাশবিকতা থেকে সম্পূর্ণ ভাবে মুক্ত নও, কারণ তুমি এমন একটি অপকর্ম করেছো যার মিটমাটের কোনো উপায় নেই"। এটি নির্দেশিত করে যে, অজিগার্তা'র মতো ক্ষুধার্ত অবস্থায় শূদ্রেরা, তাদের সন্তানের সাথে বিভক্ত হতেও প্রস্তুত থাকে। এক্ষেত্রে এমন ধারণা করা হয়েছিল যে, কিছু বস্তুগত প্রাপ্তির জন্য, তারা তাদের আপনজনের প্রতিও নিষ্ঠুর হতে পারে।

এটি লক্ষ্য করা পুনরায় কৌতুহলোদ্দীপক যে, যখন বিশ্বামিত্র দ্বারা সুনাহসেপা-কে (Sunahsepa) সন্তান হিসেবে গ্রহণ (adopted) করা হয়েছিল এবং তার একশত পুত্রের মধ্যে তাকে প্রথম স্থান দিয়ে জ্যেষ্ঠত্ব প্রদান করা হয়েছিল, তখন তার পঞ্চাশজন পুরনো সন্তান সেই অবস্থান মেনে নিতে অস্বীকার করেছিল। এটি পিতাকে প্রকুপিত (infuriated) করেছিল, যিনি তাদের অভিশাপ দিয়েছিলেন উত্তরপুরুষ হিসেবে আন্ধ্রা, পান্ড্রা, সাবারা, পুলিন্দা, মুতিবাস, দস্যু, অন্তাস প্রভৃতি জাতিচ্যুত এবং  নিম্ন-বর্ণভুক্ত সন্তান-সন্ততি প্রাপ্তির। এই বিবরণ যখন অনার্য মানুষদের ব্রাহ্মণ্য সমাজের নিম্ন বর্গে অঙ্গীভূত করার উদ্দেশ্য নিয়ে তাদের বংশতালিকা উদ্ভাবনের ক্ষেত্রে যাজকীয় অকপটতার একটি প্রাচীন উদাহরণ উপলব্ধ করেছিল, তখন সেটি এও দেখিয়েছিল যে বিরূপ ও অবাধ্য সন্তানেরা দস্যু হিসেবে বিবেচিত হয়েছিল। এই রচনাংশের ওপর তাঁর টিপ্পনিতে সায়ন নমশূদ্রদের এবং অন্যান্য নিম্ন জাতির কথাও বলেছিলেন, কিন্ত সেগুলি রচনাংশে উল্লেখিত হয়নি।

ভজসানেয়ী সংহিতা'র (Vajasaneyi Samhita) নানান অনুপূরক সূত্র সমূহের একটিতে, যে সূত্রটি বিভিন্ন মরসুমী ও গার্হস্থ বলিদানের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হবে, তাতে কল্যাণীভাক (kalyanivak)-এর কাছে ইচ্ছা ব্যক্ত করা হয়েছে যাতে সকল বর্ণ-সমূহকে সদস্যভুক্ত করা হয়। তর্ক করা হয়েছে যে, বেদ-এ সকল বর্ণের সমান অধিকারের কথা উল্লেখিত আছে। কিন্ত কল্যাণীভাক শব্দটি বেদ-এর সমকক্ষ নয়। ভাষ্যকারেরা সঠিক, যখন তারা সেটিকে একটি সদয় ও  বিনীত ভাষণ হিসেবে গণ্য করে। এটি সূচিত করে যে, সকল বর্ণের সদস্যদের সাথে কথা বলার সময় চমৎকার শব্দের প্রয়োগ করতে হবে। শতপথ ব্রাহ্মণে অবশ্য একটি পার্থক্য নজরে আসে, যেখানে কিছু অনুষ্ঠান সম্পাদনের জন্য নির্দেশ প্রদান করার ক্ষেত্রে, অভিভাষণের রীতি, বর্ণ অনুসারে পরিবর্তিত করা হয়েছে। এইভাবে, 'এখানে এসো' (ehi), 'অভিমুখ' (agahi), 'দ্রুত এখানে' (adrava) এবং 'দৌড়ে এখানে' (adhaba) প্রভৃতি শব্দগুলি নৈবেদ্য অনুষ্ঠানের প্রস্তুতকর্তাদের (haviskrt) ডাকার জন্য যথাক্রমে ব্যবহৃত হয়েছে ব্রাহ্মণ, রাজন্যবন্ধু, বৈশ্য এবং শূদ্রদের দ্বারা। এই ধরনের বাছবিচার বারংবার লক্ষ্য করা গেছে বেদকীয় পর্যায় পরবর্তী কালে।

জীবনের চারটি পর্বের মধ্যে আশ্রম (asramas), যার আবির্ভাব ঘটেছিল বেদকীয় পর্যায়ের শেষে, সেই পর্বে শূদ্রদের ক্ষেত্রে কেবলমাত্র গৃহস্বামীদের ক্ষেত্রে জীবন যাপন প্রণালী বিহিত (prescribed) করা হয়েছিল পরেরদিকের পর্যায়ে, কিন্ত সেই পর্যায়ে এমন কোনো প্রভেদমূলক বৈশিষ্ট্যের উল্লেখ নেই। যদিও ছান্দোগ্য উপনিষদে (Chandogya Upanisad) চারটি আশ্রমের কথা উল্লেখিত হয়েছে, কিন্ত বর্ণের সাথে সেগুলির যোগসূত্রের বিষয়টির কোনো উল্লেখ নেই। এটি আমাদের টেনে আনে শূদ্রদের শিক্ষার বিষয়টির দিকে, কারণ পরেরদিকের সাহিত্য অনুযায়ী, ছাত্রাবস্থার পূর্বে তাদের ব্রহ্মচর্য আশ্রমে (brahmacharya asrama) ভর্তি করা যেতোনা, যার সূত্রপাত হতো উপনয়ন (upanayana) অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে। উপনয়ন সম্পর্কিত প্রাচীনতম উল্লেখটি পাওয়া যায় অথর্ববেদ-এ, যেখানে শিক্ষক দ্বারা যুবকদের নতুন জীবনে অভিষিক্ত (upa-ni) করা হতো, কারণ তারা অনুমিত ছিল উদর থেকে জন্ম নিতে। অভিষেক শুরু হতো ব্রহ্মচর্য দিয়ে, কিন্ত তাদের বর্ণের কোনো ঈঙ্গিত ছিল না। আরুনি (Aruni), তার সন্তান শ্বেতাকেতু-কে ব্রহ্মচর্যের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়া সম্পর্কিত যে সুদীর্ঘ পরামর্শ প্রদান করেছিলেন, তার ভিত্তিতে এটি প্রতীয়মান হয় যে, দীর্ঘ কাল পর্যন্ত উপনয়নের বিষয়টি সীমাবদ্ধ ছিল কেবলমাত্র যাজকীয় অথবা সাহিত্যানুগ (literary) পরিবারের মধ্যে, যার থেকে সেটি সম্প্রসারিত হতো সম্পূর্ন ব্রাহ্মণ শ্রেণীর মধ্যে এবং পরিশেষে সকল আর্যদের মধ্যে। এটি সত্য হতে পারে, কারণ প্রাচীন সমাজে, উপনয়ন ছিল সাহিত্য শিক্ষার আদ্যস্থল (starting point) এবং সাধারণ ভাবে শিক্ষা সীমাবদ্ধ থাকতো যাজকদের মধ্যে। ব্রহ্মচর্য যে সাধারণভাবে কেবল ব্রাহ্মণদের একটি বিষয় ছিল, সেটি বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা গিয়েছে। কিন্ত উপনয়ন এবং ব্রহ্মচর্য সম্পর্কিত এই ধারণা সত্য নয় বলেই মনে হয়, যদি ব্রহ্মচর্য-কে ধরে নেওয়া হয় কোনো ব্যক্তির পরিণত বয়সে উপজাতীয় সামাজের সদস্য রূপে নতুন জীবনে প্রবেশ করার একটি আনুষ্ঠানিক সূত্রপাত হিসেবে। এই ধরনের একটি বিষদ ব্যাখ্যাকে এই বংশ পরম্পরায় ফেলে দেখা যেতে পারে যে, -- ভগবানেরা, মানুষ ও অপদেবতারা তাদের ব্রহ্মচর্য পালন করেছিল, তাদের পিতা প্রজাপতি'র পথপ্রদর্শণের অধীনে। এটিকে এভাবে ধরে নেওয়া যেতে পারে না যে, সাহিত্য শিক্ষার বিষয়টি প্রাচীন মানুষের মধ্যে ব্যাপক হারে বিস্তৃত ছিল, বরং সেটি এটুকুই সুপারিশ করতে পারে যে, সম্প্রদায়গত জীবনে কিছু পরিমাণ দীক্ষার উন্মেষ হয়েছিল, যেটি বেদকীয় ভারতীয়দের অথবা তাদের পূর্বপুরুষদের একটি সার্বজনীন অনুশীলন ছিল -- একটি প্রকৃত ঘটনা, যেটি সমর্থিত হয় প্রাচীন মানুষের মধ্যে একই রকমের অনুশীলনের বিদ্যমানতা দ্বারা। অভিষেক বা দীক্ষার অধিকারকে আরও প্রসারিত করা হয়েছিল ব্রাত্য-দের মধ্যে (Vratyas), যাদের ব্রহ্মচর্য অর্জনের মধ্য দিয়ে আর্য-সমাজে গ্রহণ করা হয়েছিল।

(ক্রমশ)


0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন