কালিমাটি অনলাইন

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

শনিবার, ১২ সেপ্টেম্বর, ২০২০

শ্রাবণী দাশগুপ্ত

 


ধারাবাহিক উপন্যাস

লাল-নীল-পেন্সিল 


                  


(৮)

এই অসময়ে কাউকে ফোন করা যায় না, হর্ষ ভাবল। অদিতি জেগে থাকলেও উচিত হবে কি না ভাবতে ভাবতে তার চোখ ঘুমে জড়িয়ে এল। অদিতিকে খুব সে বেশিদিন চেনে না, বছর দেড়েক আগে আলাপ। পরিচয় হয়েছিল একজন অফিস কলীগের এ্যানিভার্সারির উপহার কিনতে গিয়ে। সেদিন সে একা নয়, সঙ্গে আর দুজন ছিল। অদিতিদের আউটলেট-এর খোঁজ দিয়েছিল তাদের একজন। ব্যস্ত রাস্তা থেকে একটু দূরে দোতলা বাড়ির মেজেনাইন ফ্লোরে নতুন শপ্‌। না জানলে বাইরে থেকে সহজে চোখে পড়ার কথা নয়। দোকানে প্রবেশমুখে কয়েকধাপ সিঁড়ি সাইনবোর্ড টাঙানো ‘ড্রিম-হোমস্‌। নিচে ছোটো বাগান ও সিঁড়ির প্রতি ধাপে নানা রকমের লতাগুল্ম ও পাতাবাহারের গামলা রাখা। স্নিগ্ধ দোকানের অভ্যন্তর।

ঢোকামাত্র হাল্কা মিষ্টি হিপ্নোটিক এ্যারোমা বিভিন্ন কোণায় নানা সাইজের সুরভিত ক্যাণ্ডেল জ্বালিয়ে রাখা। মাঝারি-মাপের ফ্লোরটিকে সুদৃশ্য প্লাইউড পার্টিশনে ছোটো ছোটো তিনভাগ করা ওরিয়েন্টাল, ওয়েস্টার্ণ আর ট্রেণ্ডি। যেভাবে তিনটি অংশ আলাদা বৈশিষ্ট্য বজায় রেখে সাজানো, আর্ট বিষয়ে রীতিমতো পড়াশোনা না থাকলে সম্ভব নয়। বাইরে-রাখা গাছ এবং ওই তিনটি অংশের প্রায় সবই বিক্রয়যোগ্য। 

কেনাকাটায় ভূমিকা নেয়নি হর্ষ, সহকর্মীদের সঙ্গ দিতে এসেছিল। শিখা ধানুকা অদিতির বন্ধু ও স্টার্ট-আপ পার্টনার। হাসিখুশি খুবই সপ্রতিভ মেয়ে শিখা, প্রফেশন্যালও বটে। অনর্গল কথা বলতে পারে ওদের গাইড করে দিচ্ছিল। অদিতি চুপচাপ স্বভাবের বলে এই কাজটা শিখা করে থাকে। দোকানে একটিমাত্র কর্মচারী সোনী শিখাকে সাহায্য করছিল। জিনিস পছন্দ করে কেনা বেশ লম্বা পদ্ধতি। শিখা গিফটপ্যাক করে সুদৃশ্য ক্যাশমেমো দিয়েছিল। আর কাস্টমার ছিল না। পাঁচকাপ কফি আনিয়ে আপ্যায়ন করেছিল ওদের। কাছাকাছি বয়সী পাঁচজন জমে উঠেছিল। শিখা বলেছিল, ক্যাটালগ-এর বেশি দামী বা একটু দুষ্প্রাপ্য জিনিস আগে অর্ডার দিলে আনিয়ে দেওয়া হয়। শোরুমের ওপরে শিখাদের বাড়ি, গ্যারেজের ওপরের মেজেনাইন ফ্লোরটা বাবার কাছ থেকে চেয়ে নিয়েছে। ইন্টিরিয়রের লে-আউট সম্পূর্ণ অদিতির করা। ভবিষ্যতের আশা, পরিকল্পনা এসব নিয়েও কথাবার্তা হল। হর্ষ স্পষ্টত মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিল, এরকম ছিমছাম সুগন্ধময় দোকান আগে দেখেনি। সে অগোছ স্বভাবের ছেলে, শখ বলেও কিছু নেই। কেনাকাটাতে আগ্রহী নয়, যাহোক একটা হলেই চলে যায়। বাড়ি গেলে মা কিনে স্যুটকেসে ভরে দেয় বা সময় থাকলে জোর করে ধরে নিয়ে গিয়ে কেনায়। মা-বাবাকে গিফট দিতে হলে সে টাকা দিয়ে দেয়। সেদিন দোকানে দাঁড়িয়ে মায়ের জন্যে উপহার কিনতে ইচ্ছে করেছিল। শিখা ও নিজের কলীগদের ব্যস্ততার ফাঁকে সে একপাশে দাঁড়ানো অদিতিকে বলেছিল ইচ্ছেটা। অদিতি মনোযোগ দিয়ে খানিক ভেবে বলেছিল,

-তোমার মা কি খুব শৌখিন?

হর্ষ খুব লজ্জা পেয়ে জানিয়েছিল, এব্যাপারে আদৌ ধারণা নেই। অদিতি পরামর্শ দিয়েছিল মায়ের কাছ থেকে জেনে নিয়ে কেনা ভালো। হর্ষ ফিরে গিয়ে সেদিন অনেকক্ষণ মা’র কথা ভেবেছিল চাপা স্বভাব মা’র, কথা বলে আস্তে থেমে থেমে। মা কি শৌখিন?  চাকরি করলেও সংসারের কাজে ত্রুটি রাখেনি। অথচ জ্ঞান হওয়ার পর থেকে দেখছে পরিপাটি গোছানো ঘরদোর। হর্ষ বাবার মতো এলোমেলো, অগোছালো। বাবার শখের এ্যাকোয়ারিয়ামের দায়িত্বও ক্রমশঃ মা’র ওপরে এসে পড়েছে। মনে মনে কলকাতার ফ্ল্যাটে ঘুরে এসেছিল হর্ষ।

ড্রিম হোমস্‌’-এ সময়ের বড়ো বাঁধাবাঁধি দশটায় খুলে কাঁটায় কাঁটায় সাতটায় শোরুম বন্ধ করে দেয় মালকিনরা। শনি রবিবার পুরো বন্ধ। হর্ষর অফিস থেকে ফিরতে কম করে আটটা বাজে। দোকানটা টানছিল হর্ষকে, বিশেষ করে সুগন্ধিত মোমবাতি। সময় ম্যানেজ করে গেল একদিন। পৌঁছাল প্রায় পৌনে সাতটায়। হুড়মুড় করে সিঁড়ি দিয়ে উঠে দরজায় দাঁড়িয়ে দেখেছিল এরই মধ্যে সোনী ডিসপ্লে করা সামগ্রী ভাঁজ করে গুছিয়ে রাখছে। কাউন্টারে চেয়ারে ঝুঁকে বসে কাগজপত্র দেখছিল অদিতি, শুধু মাথা দেখা যাচ্ছিল। শিখা ছিল না। হর্ষ কুণ্ঠিতমুখে বলেছিল,

-গুড ইভনিং। দেরি হয়ে গেল আসতে। 

সোনী তাকে দেখতে পেয়ে ভদ্রভাবে বলেছিল,

-স্যর, অভী তো শোরুম বন্দ্‌ হো জাএগা

-স্যরি বাট্‌ যদি একটু কন্সিডার করা যায়!

হর্ষ সামান্য হতাশ হয়ে অনুরোধ করেছিল। গলা পেয়ে অদিতি চোখ তুলে তাকিয়েছিল। টকটকে লাল কুর্তির রঙ থেকেই সম্ভবত তার দুগালে লালচে আভা পড়ছিল। হর্ষ সরলভাবে জিজ্ঞেস করেছিল,

-স্যরি, লেট্‌ করে ফেলেছি। আমার অফিস অনেকটা দূর। আমাকে কি চিনতে পেরেছ?

-মাঁ কী গিফট হ্যায় না?

-ইয়েস ইয়েস, নেক্সট উইকে মা’র বার্থডে।

শুনে হেসেছিল অদিতি, কৃতজ্ঞবোধ করেছিল হর্ষ। অদিতি তাকে ফেরায় নি, নানাধরনের উপহারের জিনিস নামিয়েছিল। কয়েকটা ফোটো দেখিয়েছিল অর্ডার দিলে আনিয়ে দেওয়া হবে বা অনলাইনে পাঠিয়ে দেওয়া যেতে পারে। হর্ষ আরো সঙ্কটে পড়েছিল, কথা খুঁজে না পাচ্ছিল না। জানতে চাইল,

-শিখা ম্যাম নেই?

-একটা ফাংশন এ্যাটেণ্ড করতে রাজস্থান গেছে, সাতদিন পরে ফিরবে। কেন?

-থাকলে পছন্দ করে দিতে পারত।

অদিতি সহসা গম্ভীর হয়ে গিয়েছিল, নিজের দুর্বলতা ভালোমতো জানে। ক্রেতা-পছন্দ বুঝে সাহায্য করা, নিজের পছন্দে প্রভাবিত করা তার দ্বারা হয় না। হাতের জিনিস ঠেলে সরিয়ে ক্ষুব্ধ গলায় বলেছিল,

-তুমি সাতদিন পরে এস। এমনিতে এখন সাতটা কুড়ি বাজে, দেরি হয়ে গেছে। সোনী প্যাক্‌ আপ্‌ ফাস্ট, অলরেডি টু লেট!

বিপদে পড়েছিল হর্ষ, এরকম অভিমানী বিক্রেতা হলে ব্যবসা চলবে? কথা না বাড়িয়ে অদিতি ও সোনীর পেছন পেছন সিঁড়ি দিয়ে নেমে এল। অদিতি ঠাণ্ডা ভদ্রতা করেছিল,

-আমার গাড়ি আছে। চাইলে লিফট দিতে পারি।

-দরকার হবে না। আমার বাড়িও কাছে নয়, ক্যাব নিয়ে নেব। তোমরা চলে যাও, রাত হয়ে যাবে। গুড নাইট।

কয়েকদিন বাদে ‘ড্রিম-হোমস’-এ হর্ষ আবার গিয়েছিল। শিখা রাজস্থান থেকে আনা  অনেক নতুন আইটেম হর্ষকে দেখিয়েছিল সেলিং এন্‌ মার্কেটিং-এর কঠিন কাজটি যেন তার রক্তে ও মজ্জায়। শেষপর্যন্ত জয়সলমীরের সোনালি চূনাপাথরে বানানো গাছ-রাখার মাঝারি-সাইজ টব পছন্দ করে হর্ষ শিখাকে বলেছিল,

-হাও উইল বী দিস প্ল্যান্টার?

-টু গুড এন্‌ এক্সক্লুসিভ। অনেক খুঁজে এনেছি জানো? না হলে ঐ সোনার কিলার রেপ্লিকা বা ভগবানের মূর্তিই বেশি বিক্রি হচ্ছে। তোমার মা প্ল্যান্টস ভালোবাসেন? আমাদের কাছে অনেক ভেরাইটির সাক্যুলেন্ট আর ক্যাক্টাই পাবে, তুমি নিতে পার।

-প্ল্যান্টস? শো মী!

একটা ছোটো এ্যালবাম নামিয়ে সেডাম-গ্রুপের ছবি দেখাতে থাকে শিখা। জীবন্ত ছবিগুলো দেখতে দেখতে চোঁখ ধাঁধিয়ে যায় হর্ষর। শিখার পরামর্শমতো একটা বুক করে ফেলে। আড়চোখে দেখে অদিতি কী একটা বইয়ের মধ্যে মুখ গুঁজে বসা, তাদের দিকে তাকাচ্ছে না। শিখা বলে,

-সব আমরা পার্সল করে তোমার দেওয়া এ্যাড্রেসে ক্যুরিয়র করে দেব। শী’ল্‌ গেট্‌ উইদিন থ্রী-ফোর ডেজ্‌। এন্‌ এনিথিং মোর? পাপা, ব্রো, সিস্টার্স, গার্লফ্রেণ্ডস্‌ -- কারো জন্যে কিছু কিনতে চাও না?

হর্ষ বোঝে অদিতি বই থেকে মুখ তুলে তার দিকে তাকাল। হঠাৎ মনে পড়ে কবে যেন মা বলেছিল,

-এবারে এলে দিল্লী থেকে মাম্পির জন্যে কিছু কিনে আনিস তো খুশি হবে মেয়েটা। 

   

(ক্রমশঃ)    

 

 

 

 

 

 

 

 


0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন