কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

শনিবার, ১২ সেপ্টেম্বর, ২০২০

সুপর্ণা ভট্টাচার্য

কালিমাটির ঝুরোগল্প ৮৮


গহ্বর

 

গর্ত সব জলে ভরাট, ভরা বর্ষায়। ঘর-দুয়ারে উঠে পড়েছে সাপ, বিছে। জলাজমি বুজিয়ে সব  ফ্ল্যাটবাড়ি। নীচু বাড়িতে জল।

ফি-বছর নিরুপমদের উঠোনও জলে ভাসে। আমফানের ঝড়ে ওদের টিনের চালের অর্ধেক উড়ে গিয়ে পড়েছিলো ঘোষেদের বাগানে। দুমড়ে মুচড়ে যাওয়া সেসব টিন ঝড়ের সাক্ষী হয়ে ঘরের পিছনে। দু-তিনবার নিরুর মা পার্টিঅফিসে হত্যে দিয়ে চারহাত ত্রিপল পেয়েছিল।

আগে নিরুপমদের টালির চাল ছিলো। কালবৈশাখী ঝড়ে সেই টালির চালের ওপর পড়েছিলো পাশের জামরুল গাছ। আর সেই গাছশুদ্ধু টালির চাল নিরুর ঘুমন্ত বাপের মাথায়। নিরুপম তখন মায়ের পেটে। মা তখন নিশ্চিন্দিপুরে বাপের বাড়ি। তাই নিরুর মা গেলো বেঁচে আর মায়ের পেটের গহ্বরে সে। সেই ঝড়ের কিন্তু কোনো নামই ছিলো না।

মায়ের বাপ ধারদেনা করে নিরুদের চাল টালির বদলে টিনের করে দিয়েছিলো।

মায়ের মুখে এ ঘটনা অসংখ্যবার শুনেছে নিরু।

মায়ের হাত-পায়ের আঙুলের ফাঁকে হাজা ভর্তি। সাদা শাড়িতে বোঁটকা গন্ধ। চুলে জট। মা পাশে থাকলেই নিরুর গা ঘিন ঘিন করে ওঠে। হরেনদাদুর ডাক্তারখানা থেকে মলম নিয়ে এসে লাগালে আরাম পায় মা। সে মলম ফুরিয়েছে। এখন দাম বাড়ায় আর আনতে পারে না। সারারাত নিরুর মা উশখুশ করে। ঘুমোয় না। নিশপিশ করে আঙুল।

ভোর হলেই সবজি নিতে দৌড়ায় পাইকারি বাজারে, তারপর রাস্তার ধারে বসে বিক্রি করে।

বর মরতে নিরুর মা লোকের বাড়ি ঠিকে কাজ ধরেছিলো। নোংরা বলে, সে সব কাজ থাকেনি বেশীদিন।

নিরুপম খিচুড়ি স্কুলে যায়। সন্ধ্যায় অনিমেষ মাষ্টারের বিনি পয়সার কোচিং সেন্টারে। তার মাথায় পড়াশোনা একটুও ঢোকে না।

এখন লকডাউন। পড়াশোনা বন্ধ।

নিরু খুশী হবে কিনা, বুঝতে পারে না।

মিনিট দশ হাঁটলেই গঙ্গার পাড়ে কালীবাড়ি। তার পাশেই শ্মশান। এই বর্ষায় কালীমন্দির, শ্মশান সব টইটম্বুর। জেটিটা জেগে। ফেরিও বন্ধ এখন।

কোচিং সেন্টার থেকে ফেরার পথে রোজ একবার করে নিরু শ্মশানে যায় ভিখুদার কাছে।

ভিখুদা তখন কাজ না থাকলে চোলাই নিয়ে বসে গঙ্গার পাড়ে, না হলে গুমটিঘরে। অশ্রাব্য ভাষায় কথা বলে, সঙ্গী  থাকলে।

ভিখুদা আরো তিনজনের সঙ্গে ইলেকট্রিক চুল্লীতে মড়া ঢোকায়। এখন চিতা জ্বলে কম। খুব গরীব মড়া না হলে।

--বাবা, এই জল ঠেঙিয়ে এলি!

ভিখুর গলায় বিস্ময়।

নিরুপম চুপচাপ বসে ভিখুর পাশে। আজ ভিখুদা একা।

--তুই রোজ আসিস কেন রে নিরু?

--এমনি।

--চোলাই খাবি?

--না।

--আরে খা, খা! মেজাজ পুরো রাজার মতো হয়ে যাবে।

--না।

ভিখু রেগে তেড়ে ওঠে, তাহলে ফোট্ শালা। নেশা চটকে দিস না!

নিরুপম ওঠে। রাগটা সন্তর্পণে লুকিয়ে। একদিন ঠিক সুযোগ পেয়ে যাবে, মাতাল ভিখুকে ভরা গঙ্গায় ঠেলে ফেলে দিতে।

নিরুপম জেনে গেছে ভরদুপুরে ভিখুদার ঘরে তার মা যায় কেন!

নিরুর হাতের মুঠোয় কুড়িটাকা। ভিখুদার ঘর থেকে চুরি করেছে ।

হরেনদাদুর ডাক্তারখানা খোলা। হাজার মলম কেনে নিরুপম।

আজ মা আরামে ঘুমোবে রাতে। 




2 কমেন্টস্: