সিনেমার পৃথিবী – ১
বহু বছর হল বিদেশি সিনেমা দেখি। এখন তো প্রায় প্রতিরাতে অভ্যেস হয়ে গেছে। হলিউড, ইউরোপিয়ান, লাতিন আমেরিকান, এশিয়ান – খুঁজে বের করার চেষ্টা করি কারা ভাল কাজ করছে। কাদের চিন্তাভাবনা আমাদের মনে ছাপ ফেলছে। এমনকি কোভিডের সময়ে এই হতাশা আর ধৈর্যচ্যুতির সময়েও প্রায় প্রতি মাঝরাতে চারপাশ নিস্তব্ধ হয়ে এলে আমার কম্পিউটারে রিল ঘুরতে থাকে। তো, সিনেমা নিয়ে বলতে শুরু করলে সাধারণ ভাবে ঠিক যেখানে শুরু করা উচিৎ, ‘গন উইথ দ্য উইন্ড’ (১৯৩৯), ‘সিটিজেন কেন’ (১৯৪১), ‘বাইসাইকল থিভস্’ (১৯৪৯)... এরকম কয়েকটা ছবি নিয়ে, যারা বিশ্ব সিনেমার ভাষা আর নির্মাণশৈলির পথ দেখিয়েছে, আমি আপাতত সেই রাস্তা দিয়ে যাব না। বরং এই করোনার আবহে সময় কাটানোর জন্য ভাইরাস বিষয়ক যে বেশ কিছু হলিউড সিনেমা দেখলাম, শুরুর লেখাতেই তার ভেতর দু্টো বেছে নেব এক বিশেষ কারণে। একটা ২৫ বছর, আরেকটা ৯ বছর আগের ছবি। কিন্তু দুটোই মনে আশা জাগায়। ভাইরাসকে পর্যুদস্ত করে সুস্থ সমাজের আশা।
প্রথম সিনেমার নাম ‘আউটব্রেক’। ১৯৯৫ সালের। পরিচালক ডব্লু পিটারসেন। মুখ্য চরিত্রে ডাস্টিন হফম্যান, মর্গ্যান ফ্রিম্যান, রেনি রুশো। ছায়াছবি শুরু হচ্ছে নোবেল পুরষ্কার প্রাপ্ত বিজ্ঞানী জোশুয়া লিডারবার্গের এক ভুলতে না পারার মত উক্তি দিয়ে – ‘যতদিন ভাইরাস থাকবে, ততদিন পৃথিবীতে মানুষের নিরঙ্কুশ আধিপত্য বজায় রাখা কঠিন’। এই ছবি ভাইরাস সংক্রমণের বিরুদ্ধে এক ডাক্তার দম্পতির প্রাণপণ লড়াইয়ের ছবি। ছবির প্লট এইরকমঃ ১৯৬৭ সালে যুদ্ধবিদ্ধস্ত আফ্রিকার এক সেনা ছাউনিতে মোটাবা নামক এক প্রাণঘাতী ভাইরাস পাওয়া যায় (এই ভাইরাসের চরিত্র অনেকটা বাস্তবের ইবোলা ভাইরাসের মত)। একে অন্য জায়গায় ছড়িয়ে পড়া থেকে রুখে দেওয়ার জন্য এবং এর অস্তিত্ব গোপন রাখার জন্য আমেরিকা সেই সেনা ছাউনি বোম ফেলে নিশ্চিহ্ন করে দেয়। কিন্তু ২৮ বছর পর, ১৯৯৫তে, আফ্রিকার অন্য এক গ্রামে আবার সেই একই রকম সংক্রমণ ও পরপর মৃত্যু। এই ভাইরাস হাওয়াবাহিত নয় কিন্তু একের সংস্পর্শে আরেকজন এলে সেও সংক্রমিত হয়। আমেরিকান সেনাবাহিনীর এক ডাক্তার-কর্নেল তার টিম নিয়ে সেখানে গিয়ে ভাইরাসের নমুনা এনে পরীক্ষা করলেন। এবং সেনাবাহিনীর উচ্চতম কর্তৃপক্ষ গোপনে দেখলেন, ২৮ বছর আগের ও পরের এই ভাইরাসের গঠন প্রায় এক। অর্থাৎ মোটাবা ভাইরাস কোনওভাবে ফিরে এসেছে। সেই ডাক্তার-কর্নেল কর্তৃপক্ষকে আরো সাবধান করলেন যে এই ভাইরাস কিন্তু আমেরিকাতেও ছড়াতে পারে। যদিও কেউ তার কথায় আমল দিল না। কিছুদিন পর হঠাৎ দেখা গেল, আমেরিকার প্রত্যন্ত এক শহরতলী সিডার ক্রিকে এই ভাইরাসের সংক্রমণ ঘটেছে। সেই ডাক্তার-কর্নেল পরীক্ষা করে দেখালেন যে আফ্রিকা আর সিডার ক্রিকের ভাইরাস গঠনগত ভাবে এক হলেও আমেরিকায় এসে এই ভাইরাস মিউটেশন করে নিজের প্রোটিন কোড বদল করে নিয়েছে। তার চারপাশে এখন অসংখ্য স্পাইক যার ফলে এই ভাইরাস এখন হাওয়ায় ভেসে থাকতে পারে, হাওয়ায় সংক্রমণ ঘটাতে পারে। সেনাবাহিনী এসে পুরো শহরতলী সিল করে দিল। আক্রান্তদের কোয়ারেন্টাইন করে দেওয়া হল। এবং সেই ডাক্তার-কর্নেল ও তার স্ত্রী খুঁজে বের করলেন যে আফ্রিকার এক বিশেষ প্রজাতির সাদা-কালো বাঁদর হচ্ছে এই মোটাবা ভাইরাসের হোস্ট। অর্থাৎ সেই বাঁদরদের থুথু থেকেই এই ভাইরাস ছড়ায় কিন্তু তাদের দেহে প্রতিরোধ ক্ষমতা বেশি বলে এই ভাইরাস তাদের কাবু করতে পারে না। এরপর এক টানটান নাটুকেপনার মাধ্যমে মুভি শেষ হয় সেই বাঁদরকে, যাকে আফ্রিকা থেকে আমেরিকা আনা হয়েছিল, খুঁজে পেয়ে তার রক্ত থেকে সিরাম থেরাপির মাধ্যমে এবং সেনাবাহিনীকে ঐ শহরের ওপর বোম ফেলতে না দিয়ে। সবশেষে দেখা যায়, সিরাম থেরাপির মাধ্যমে সিডার ক্রিকের বেশিরভাগ মানুষ আস্তে আস্তে ভাল হয়ে উঠছে।
যদিও এই ছবির শেষদিক অনেকটা বাজার-চলতি হিন্দি সিনেমার মত, তবুও সামগ্রিকভাবে দেখে মনে হল, এই সিনেমার সঙ্গে বর্তমানের করোনা ভাইরাস বা কোভিড-১৯ এর নিচের মিলগুলো পাচ্ছি-
১) করোনা
ভাইরাসের ইতিহাস বেশ পুরনো। ঘেঁটে দেখতে পেলাম, প্রথম এই ভাইরাস খুঁজে পাওয়া যায়
১৯৩১ সালে। মুরগির দেহে। মানুষের দেহে প্রথম করোনা ধরা পড়ে ১৯৬০ সালে। তারপর
বিভিন্ন সময়ে এর বিভিন্ন রূপ মানুষের দেহে ধরা পড়েছে। ২০০৩এ সার্স-কোভ, ২০০৫এ
এইচ-কোভ, ২০১২য় মার্স-কোভ। করোনা ভাইরাসের সর্বশেষ রূপ এই কোভিড-১৯। ২০১৯ সালে ধরা
পড়েছে বলে একে কোভিড-১৯ (COrona VIrus Disease-19) নাম দেওয়া হয়েছে। সুতরাং এই
কোভিড-১৯ বেশ কিছু বছর পর ফিরে আসা করোনার এক নতুন অবতার।
২) এই
ভাইরাসের গোল পৃষ্ঠতল জুড়ে প্রচুর প্রোটিন স্পাইক। এবং যা কিছুদিন আগেও হাওয়াবাহিত
ছিল না বলে ‘হু’ জানিয়েছিল, আজ তারাই বলছে কোভিড-১৯ হাওয়ায় ২৫ ফুট পর্যন্ত ছড়িয়ে যেতে
পারে। অর্থাৎ কোভিড-১৯ নিজেকে অনবরত মিউটেশন করে চলেছে।
৩) ‘হু’ বলছে, এই
ভাইরাস সংক্রমণের মুশকিল হল, এতে আক্রান্ত ৮০% মানুষের দেহে কোন উপসর্গ
বোঝা যায় না। তাদের প্রতিরোধ ক্ষমতা (অ্যান্টিবডি) ভাল বলে এই ভাইরাস তাদের দেহে
২-২১ দিন থেকে তাদের মাধ্যমে আরেক দেহে চলে যায়। বাকি ২০% মানুষের দেহে, যাদের
প্রতিরোধ ক্ষমতা ভাল নয়, তাদের দেহেই এর উপসর্গ ফুটে ওঠে। এবং সেখানেও এই ভাইরাস
৪৯ দিন পর্যন্ত জীবিত থাকতে পারে। বুঝুন
কান্ড! মানে আমার বা আপনার দেহে এই ভাইরাস এখন, এই মুহূর্তে, লুকিয়ে
আছে কিনা আমরা বুঝতেই পারব না, যদি আমাদের দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ভাল হয়। অথচ আমরা
দিব্বি অন্যদের সংক্রমিত করে চলব। ঠিক সিনেমার ঐ বাঁদরটার মত।
৪) ভাইরাস
বাহিত রোগের এক কার্যকরী চিকিৎসা ব্যবস্থার নাম প্লাজমা-থেরাপি বা সিরাম-থেরাপি
(বলে রাখা ভাল যে রক্তের প্লাজমা আর সিরামের ভেতর একটা ছোট পার্থক্য আছে)। এই
সিনেমার শেষ ভাগে সেটাই দেখানো হয়েছে। বেশির ভাগ দেশ ইতিমধ্যেই কোভিড-১৯ এর বিরুদ্ধে এই চিকিৎসা
শুরু করে দিয়েছে ও সফল হয়েছে। ভারতেও প্লাজমা-থেরাপি করে বেশ ভাল ফল পাওয়া যাচ্ছে।
এটাই এই ছবির সেরা পাওয়া।
আজ থেকে ২৫
বছর আগের এক কল্প-সিনেমা। কিন্তু ভাইরাস ঘটিত রোগের বিরুদ্ধে এত সংগঠিত চিত্রায়ন
দেখে একটু উৎসাহী হয়ে ছায়াছবির নামের লিস্টে দেখলাম কারা কারা আছেন। অবাক হয়ে
দেখি, একজন চিফ মেডিকেল অফিসার। পাঁচজন মেডিকেল পরামর্শদাতা। একজন টেকনিকাল গবেষক।
আরেকজন টেকনিকাল পরামর্শদাতা। সবার ওপরে একজন রিসার্চ হেড। এদের ভেতর তিনজন পি-এইচ-ডি
বা ডি-এস-সি, তিনজন এম-ডি। বোঝাই যাচ্ছে সেই সময় এই সিনেমা ঠিকঠাক ফুটিয়ে তোলার
জন্য এরা এত রিসার্চ করেছিলেন যে আজ করোনার আবহেও এই সিনেমা কত প্রাসঙ্গিক।
দ্বিতীয় ছবি
‘কন্টাজিয়ন’। ২০১১ সালের। পরিচালক স্টিভেন সোদারবার্গ। মুখ্য চরিত্রে লরেন্স
ফিশবার্ন, ম্যাট ডেমন, কেটি উইন্সলেট, মারিয়ন কোটিলার্ড (কেটি ও মারিয়ন
দুজনেই খুব সুন্দরী নায়িকা এবং অস্কার প্রাপ্ত, ফলে এই ছবি আরো আকর্ষক হয়ে উঠেছে)।
এই সিনেমা আউটব্রেক-এর তুলনায় অপেক্ষাকৃত সাম্প্রতিক। এবং তদ্দিনে সার্স-কোভ বা
এইচ-কোভ মানুষের দেহে সংক্রমণ ছড়িয়েছে। ফলে এই সিনেমা বানানোর সময় পরিচালকের হাতে ভাইরাস
সংক্রমণের অনেক তথ্য ছিল। তবুও অবাক হলাম, ন’বছর আগের এই ছায়াছবি যেন অবিকল
আজকের কোভিড-১৯এর অবস্থা। এমনকি নিজের ব্যর্থতা ঢাকার জন্য একটি প্রদেশ যেভাবে
প্রকৃত তথ্য লুকিয়ে রাখছে, সেটাও এখানে দেখানো হয়েছে। ভাইরাস সংক্রমণের পর সাসপেন্স
বজায় রেখে প্রতিদিনের হিসেবে এই ছবি এগিয়ে চলে যাতে প্রতিদিন কত সংক্রমণ হয় সেটা স্পষ্ট বোঝা যায়। ছবির প্লট অনেকটা
এইরকমঃ এক মাঝবয়েসি মহিলা, কোম্পানি এক্সিকিউটিভ, অফিসের কাজে হংকং থেকে আমেরিকায়
বাড়ি ফেরার দুদিন পর হঠাৎ খিঁচুনি সহ পড়ে গিয়ে হাসপাতালে ভর্ত্তি হন এবং কোন এক
অজানা রোগে সঙ্গে সঙ্গে মারা যান। ঐ মহিলার স্বামী হাসপাতাল থেকে ফেরার সময় খবর
পান যে বাড়িতে তাদের ছেলেও ঐ একই সময়ে মারা গেছে। মহিলার স্বামীকে কোয়ারেন্টাইন
করা হয় কিন্তু দেখা যায় যে তার দেহের ইমিউনিটি সিস্টেম ভাল থাকার জন্য এই অজানা
রোগ ওনাকে আক্রমণ করতে পারে নি। আমেরিকার বিভিন্ন প্রদেশে এবং পৃথিবীর
অন্যান্য জায়গায় এই অজানা রোগ দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। এই ভাইরাসকে ‘নোভেল ভাইরাস’ MEV-1 নাম দেওয়া হয়। এর উপসর্গ হিসেবে দেখা যায় প্রচন্ড জ্বর ও শ্বাসকষ্ট। এবং
আক্রান্ত ব্যক্তির স্পর্শ বা ছুঁয়ে দেওয়া কোন বস্তু থেকে এই রোগ ছড়াতে থাকে। আমেরিকার
অনেক প্রদেশে লক-ডাউন ঘোষণা করে দেওয়া হয়। ফলে সাধারণ মানুষ ক্ষিদে আর অভাবের
জ্বালায় লুঠপাট ও অরাজকতা শুরু করে। ‘হু’ সেই মাঝবয়েসি মহিলাকে এই ভাইরাসের প্রথম মৃত হিসেবে
ঘোষণা করার পর হংকং-এ
থাকাকালীন ম্যাকাউ–এর ক্যাসিনোয় উনি কাকে কাকে সংক্রমিত করেছেন সেটা খুঁজতে থাকে।
আমেরিকা এই নোভেল ভাইরাসের জিনোম ডিকোড করে দেখতে পায় এর ভেতর বাদুড় আর শুয়োরের
জিন মিশে আছে। আমেরিকার এক বিজ্ঞানী এক কৃত্তিম ভাইরাসের সাহায্যে এই ভাইরাসের
টীকা আবিষ্কার করেন। কিন্তু জীবজন্তুর ওপর প্রয়োগ শেষ করে তা মানুষের দেহে প্রয়োগ
করতে অনেক সময় লাগবে বলে এক ডাক্তার স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিজের দেহে এই টীকা প্রয়োগ
করে দেখেন তা কাজ করছে। অবশ্য ততদিনে আমেরিকায় ২৫ লাখ আর পৃথিবীতে আড়াই কোটি মানুষ
মারা গেছে। এরপর আমেরিকান সরকার এই টীকা লটারি করে জন্মদিন অনুযায়ী একে একে সমস্ত
নাগরিকদের দিতে শুরু করে। সবশেষে ফ্ল্যাশব্যাকে দেখায় যে ভাইরাস সংক্রমণের প্রথম দিন,
চিনের কোন এক জঙ্গলে এই
রোগের সংক্রমিত বাদুড় একটুকরো খাবার এক শুয়োরের ফার্মে ফেলছে, সেটা এক শুয়োর
খাচ্ছে ও সংক্রমিত হচ্ছে, সেই শুয়োর ম্যাকাউ-এর ক্যাসিনোয় রান্নার জন্য নিয়ে যাওয়া হচ্ছে এবং
শুয়োরের ভাইরাস আক্রান্ত শেফ সেই মহিলার সঙ্গে করমর্দনের জন্য এগিয়ে এলেন। তার
থেকেই সেই মহিলার দেহে সংক্রমণ ছড়াল। তারপর অন্যান্যদের।
ছবিতে নাটকীয়তার প্রয়োগ না করে পরিচালক ডিটেলিং-এর দিকে বেশি নজর দিয়েছেন। ফলে এই সিনেমা আজকের আবহে আরো বেশি বিশ্বাসযোগ্য হয়ে উঠেছে। এবং এর প্রতি ধাপ যেন বারবার কোভিড-১৯এর কথা মনে করিয়ে দেয়। বাদুড় থেকে সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ছে চিনের মাংস বাজারে, সেখান থেকে মানুষে। তারপর মাস্ক পরা থেকে শুরু করে ফিজিক্যাল ডিস্ট্যান্স, কোয়ারেন্টাইন, লক-ডাউন, জিন গবেষণা, কৃত্রিম ভাইরাস বানিয়ে এই ভাইরাসের ভ্যাকসিন তৈরি - আজকের করোনাকে থামানোর জন্য এই মুহূর্তে যা যা করা হচ্ছে, তার সব এই ছবিতে আছে।
এই ছবির টেকনিকাল পরামর্শদাতা ছিলেন অন্তত এক ডজন বিশেষজ্ঞ। সবার ওপরে রিসার্চ হেড ছিলেন কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর ইনফেকশন অ্যান্ড ইমিউনিটি-র অধ্যক্ষ প্রফেসর ইয়ান লিপকিন, যাকে আমেরিকার সেরা ভাইরাস রোগ বিশেষজ্ঞ বলা হয়। এরা সবাই চেয়েছিলেন এই সিনেমায় একুশ শতকের ভাইরাস সংক্রান্ত সম্ভাব্য মহামারী বা অতিমারীর চিত্র নিখুঁতভাবে ফুটিয়ে তুলতে, যাতে জনগণ ভবিষ্যতের কথা ভেবে সচেতন হয়। আমার মতে, করোনার আবহে এই ছবি একবার দেখলে মন্দ লাগবে না। অন্তত এই সময়ে দাঁড়িয়ে করোনার প্রভাব কী রকম হতে পারে সেটা বোঝা যাবে। এবং ভাইরাসের সাথে সাথে সমাজে কীভাবে রাজনীতি বা ব্যক্তিগত স্বার্থ ছড়িয়ে পড়ে, সেটাও একঝলক দেখে নেওয়া যাবে।
তবে আমি ব্যক্তিগত ভাবে এই সিনেমা দুটো দেখে খুশি হয়েছি এক অন্য কারণে। এই দুটো ছবি গল্পচ্ছলে দেখিয়ে দিয়েছে প্রকৃতি যদি কোন মারণ রোগ দেয়, তাহলে প্রকৃতির ভেতরেই তার নিরাময়ের বীজ লুকিয়ে থাকে। সেটা বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে খুঁজে নিতে হয়। এবং কোভিড-১৯এর মত ঘাতক ভাইরাসের বিরুদ্ধে প্রতিষেধক বা চিকিৎসার পদ্ধতি কী কী হতে পারে। ভাবলে অবাক হবেন, এই মুহূর্তে আমরা কিন্তু অনেকটা সেই দিকেই এগোচ্ছি। আসুন, একঝলক দেখে নিই এখন কোভিড-১৯এর বিরুদ্ধে গোটা পৃথিবীর কোন্ ধরনের চিকিৎসা ব্যবস্থা আমাদের মনে আশা জাগাচ্ছে। প্রতি ক্ষেত্রেই মূলত রোগির অ্যান্টিবডি আরো শক্তিশালী করার চেষ্টা করা হচ্ছে।
১) প্লাজমা থেরাপিঃ কোভিড-১৯ আক্রমণ থেকে সুস্থ হয়ে ওঠা ব্যক্তিদের রক্ত থেকে প্লাজমা নিয়ে সেটা ল্যাবে প্রসেস করে এখনকার আক্রান্তদের চিকিৎসা করা হচ্ছে। ঐ প্লাজমার ভেতর থাকে শক্তিশালী অ্যান্টিবডি যা কোভিড-১৯এর বিরুদ্ধে লড়ার ক্ষমতা দেয়। এই পদ্ধতিকে বলে প্লাজমা থেরাপি। ঠিক যেরকম ‘আউটব্রেক’-এ দেখানো হয়েছে। আগেই বলেছি যে পৃথিবীর বেশির ভাগ দেশ ইতিমধ্যেই কোভিড-১৯এর বিরুদ্ধে এই চিকিৎসা চালাচ্ছে ও সফল হয়েছে।
২) আর-এন-এ
থেকে করোনা প্রতিষেধকঃ যেহেতু কোভিড-১৯ একটি আর-এন-এ প্রধান ভাইরাস, তাই এর জিন
থেকে কিছু উপাদান নিয়ে যদি মানুষের দেহে ইঞ্জেকশন দেওয়া হয়, তাহলে এই ভাইরাসের
প্রোটিন স্পাইকের মত নতুন কিছু স্পাইক তৈরি হবে। এবং সেই নতুন প্রোটিন স্পাইক ইমিউনিটি
দেবে। কাঁটা দিয়ে কাঁটা তোলার মত কোভিড-১৯কে প্রতি পদে মেরে ফেলতে চাইবে। বেশ কিছু
দেশ এই রাস্তায় এগোচ্ছে।
৩) কৃত্রিম ভাইরাস থেকে
করোনা প্রতিষেধকঃ অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা এই নিয়ে কাজ করে প্রায় শেষ পর্যায়ে। এখন হিউম্যান ট্রায়াল
চলছে। এই পদ্ধতি একদম ‘কন্টাজিয়ন’ সিনেমার মত। শিম্পাঞ্জীর শরীরে থাকা
জ্বর-সর্দি-কাশির ভাইরাসকে জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং-এর সাহায্যে কোভিড-১৯ সাইজের প্রোটিন
স্পাইক-ওয়ালা ভাইরাসে পরিণত করা হয়েছে যা মানুষের শরীরে ইঞ্জেক্ট করলে কোভিড-১৯এর
বিরুদ্ধে ইমিউনিটি তৈরি করবে।
৪) স্টেম সেল
থেরাপিঃ শিশু জন্মের আগে সে মায়ের গর্ভে অমরা বা গর্ভপত্রের (প্লাসেন্টা) ভেতর থাকে। তার সঙ্গে মায়ের যোগাযোগ রক্ষা করে
তার নাভি থেকে মায়ের অমরা পর্যন্ত একটা নল (আমবিলিকাল কর্ড)। জন্মের সময় সেই অমরা প্রায় পুরোটাই
বাইরে বেরিয়ে আসে। অমরা আর এই নলের ভেতর থাকে কিছু আশ্চর্য কোষ, যার নাম স্টেম
সেল। সেইসব কোষ থেকে বিজ্ঞানীরা বানিয়ে ফেলেছেন এক ধরনের স্মার্ট কোষ যার প্রোটিন
প্রায় মৃত্যুমুখী করোনা রোগীকে আবার সুস্থ করে তুলেছে। ইজরায়েলে এই পদ্ধতি অবলম্বন
করে ইতিমধ্যেই ১০০% সাফল্য এসেছে। এবার এটা অনেকের জন্য কীভাবে কম সময়ে কম
খরচে করা যায়, সেটাই চ্যালেঞ্জ।
যাইহোক, কোভিড-১৯কে
হারাতেই হবে। বিজ্ঞানের হাত ধরে এক নতুন সূর্যোদয় দেখার আশায়। আর সেজন্যই এই
সিনেমা দুটোর কথা প্রথম লেখাতেই তুলে আনলাম। পরের বার আবার ভাইরাস নিয়েই আরো
কয়েকটা সিনেমার কথা লিখব, একটু অন্যরকম স্বাদের। দেখতে পাবেন, সেখানেও আজকের
পৃথিবীর সঙ্গে কীভাবে মিল উঠে আসছে।
0 কমেন্টস্:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন