কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

শনিবার, ১২ সেপ্টেম্বর, ২০২০

রঞ্জনা ব্যানার্জী

 

কালিমাটির ঝুরোগল্প ৮৮


কেয়ামত পাগল এবং…

সকল ঘটনারই নিজস্ব প্রস্তুতিপর্ব থাকে। কখনো পলক ফেলার মতো ক্ষুদ্রতম সময় আবার কখনো ধীরলয়ে চলে তৈয়ারি।

করোনাকালে যা ঘটেছিল তারও কিছু পূর্বচিহ্ন ছিলো। চিনেছিল একজন... আধখানা জামা পরা কেয়ামত পাগল; সঙ্গীসাথী : ফুটপাতেরই হাড়জিরজিরে শিশুগণ, নেড়ি-কুকুরের দল এবং ল্যাম্পপোস্টের তারে দোলখাওয়া বায়স-সকল। বৃষ্টি-রোদ মেখে এদের সঙ্গেই তার যাপিত-জীবন। কিন্তু রাস্তার অপরাপর দৃশ্যাবলীর মতোই শহরবাসীর চোখে একসময় অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিল সেই দৃশ্যও। পৃথিবী যেদিন সত্যিই পাল্টাল সেইদিন থেকে সেই শহরের সকল দৃশ্য মুছে সেই দৃশ্যটিই স্পষ্টতর শহরবাসীর চোখে: কেয়ামত পাগল এবং তার সঙ্গীসাথীগণ!

সকল কেন’র উত্তর নেই এ জগতে, আঙুরি বেগমের ভ্রুকুটিতে জেনেছিলাম তাও...

গল্পটি বলি, তবেই বোঝা যাবে এই উপক্রমণিকার কারণ।

শহরটি বিশেষ কোনো শহর নয়। চৌষট্টি জেলার গ্রাম-গেলা আমশহরেরই প্রতিলিপি! এখানেও মানুষ ছোটে, হাঁটে, রিক্সা কিংবা ট্যাক্সিতে মুখ ব্যাদানে যায়  রুটিরুজির দায়েএখানেও আছে আলাভোলা সহজ মানুষআছে মতলববাজ ফড়িয়া দালাল; ক্ষমতার হাওয়ায় যাদের পাল তেড়েফুঁড়ে ফোলে অকস্মাৎ

এই শহরেও গাছগাছালি উধাও উন্নয়নের করাতকলে। ছায়াহীন মানুষেরা অনিয়মকেই নিয়ম জেনে কাটিয়েছে দিন; আমাদের মতোই কারখানার বর্জ্যে ক্ষীণতর হচ্ছিল নদীদের স্রোত, এইখানেওগায়ে-গা ঘেঁষা সেইসব অনিয়ম-গাঁথা আজ অতীত-কথনএখন নির্ঘুম রাত কাটে তাদের বিরামহীন একক ভাবনায়, কীভাবে ফেরানো যায় সোনালি সময়? চোখে থাকে জেগে... আধখানা জামাপরা, কেয়ামত পাগল!

আমিও এসেছি তার খোঁজেই! কে সে? কিবা পরিচয়? আমার মতো আরও যারা আসে, তারাও দেখে না যা ওরা নিত্য দেখেআমাদের চোখ ভেঙে ঘুম নামে, আলো ফিকে হলেই স্বপ্ন দেখি না, ঘুম এমনই নিখাদ। অথচ এরা খোঁজে নিরাময়, প্রকৃতির রোষ কমাবার।

সেই ঘটনা ঘটেছিল দুমাস আগের এক গুরুবারেদেশজুড়ে সবখানে তখন  নিয়মের মহা কড়াকড়ি... ‘মুখ আঁটো’, ‘ঘরে থাকো’, সুরক্ষার প্রয়োজনেবিন্দুর চেয়েও ক্ষুদ্র, অদেখা সে প্রাণ, নির্বিচারে মানুষ মারছে অবিরাম।

সেদিনের  সূর্য ঢলেছিল বেশ আগেভাগে তারারা বকুল হয়ে ফুটছিল, ভারি সন্তর্পণেচারপাশে দমবদ্ধ ভয়ানক উৎকণ্ঠা। ঝিঁঝিঁদেরও মৃদুস্বর কী হয়! কী হয়!

সে রাতেই শহরবাসী দেখেছিল সেই দৃশ্য অভিনব! কে দেখেছে? কিংবা কীভাবে? এইসব প্রশ্ন অবান্তর। দেখেছে সকলে। সাক্ষ্যও দেয় সমস্বরে বিছানায় সেঁটে থাকা রোগক্লিষ্ট আঙুরি বেগম, ভ্রুকুটিতে তিরস্কার তুলে বলে, ‘আমিও দ্যাখসি। ক্যামনে? সেই ভাবনা তুমার’ 

হাল ছাড়ি। আগে যারা এসেছিল তাদেরও সেই মত, এ শহরে সবকিছু অন্যরকম।

তাও বলি সেই দৃশ্য তাদেরই বয়ানে :

সেইদিন সক্কলে দেখেছিল তাকে। মাথায় জড়ানো তার জোনাকিমুকুট। পায়ে-পা মিলিয়ে চলে দেবশিশুগণ। সারবেঁধে পিছনেতে কুকুরের দল; আকাশে চাঁদোয়া যেন বায়স-সকল। শহর ছাড়ছিল নিয়ে নীরব কাফেলা।

হঠাৎ থামল। অভয়মুদ্রা তুলে, আলো-আঁধারীতে,  ঈশ্বরের দূত যেন জলদ-স্বরে শুনাইছে বাণী,

'সৃষ্টির সাম্য মানো, শুধরাও ভুলচুক মা বসুধা ক্ষমাশীলা’।

এরপরেই উবে গেল ভোজবাজী যেন: কেয়ামত পাগল, শিশুগণ, এবং তার পিছে ঘোরা সেই কুকুরের দল।

সেই থেকে এই শহরে কাকও নিখোঁজ!



 


1 কমেন্টস্: