পাঁচফোড়ন
কথায় কথায় ফোড়ন কাটা বাঙালির অভ্যেস। আর রান্নায় ফোড়ন
দেওয়া একমাত্র বাঙালিই পারে। এখন অবধারিত ভাবে প্রশ্ন আসে, ফোড়ন কয় প্রকার ও কী কী?
আমি কিন্তু তত জানি না ফোড়নের গল্প। ঘটির
পাঁচফোড়ন আর বাঙালের ‘কালিজিরা’র বাইরের বৃত্তে পড়ে থাকে জিরে, সরষে আর কখনও কখনও
মেথি বা রাঁধুনি। তবে পাঁচফোড়ন আর কালোজিরের ব্যাপক ভূমিকার বাইরে বাদবাকিরা
নেহাতই স্ট্যাটাস সিম্বলহীন। আর তেজপাতা? তিনি তো এক মাইলস্টোন। তিনি বিনা কানু
নেই। আর দু’একটি শুকনো লঙ্কার ঝাঁজকে উপেক্ষা করলেও চলবে না।
ধরা যাক সামান্য এক আলুচচ্চরির কথা। একটু কালোজিরে আর
কাঁচালঙ্কা ফোড়ন দিয়ে অল্প তেলে হালকা ভেজে মশলা ছাড়া এই সাদা আলুচচ্চরির তুলনা
কারুর সাথেই হতে পারে না। সে রুটির সাথেই হোক বা লুচির সাথে। আবার এই আলুচচ্চরিতে
যদি পাঁচফোড়ন দেওয়া যায়, তার আবার অন্য স্বাদ। জিরে ফোড়ন দিলে আবার আর এক স্বাদ।
ফোড়নের মহিমা বুঝতে গেলে এই সামান্য পদটিকে চেখে দেখতে হবে দু’ তিন রকম ভাবে।
আলুচচ্চরি যেন আমাদের ঘরের মায়ের মত।
গ্ল্যামারহীন, তবু না থাকলে বিশ্ব অন্ধকার। আর মায়ের গায়ের যে আটপৌরে গয়না, সেগুলো
হল ফোড়ন। হাতের বালা, গলার চেন, কানের দুল - তিনজন তিনরকমের ফোড়ন। মায়ের হাতের
বালাটি ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখার মত একটা আরাম, একটা ঘুম আসার খেলা খেলে নি, কোন
সন্তান! মায়ের গলার হার যখন চকচক করে ওঠে, আলো এসে পড়ে অজান্তেই আমাদের মুখে। আর
কানের দুল যখন কাজের তালে তালে দুলতে থাকে, আমাদের মন যেন অন্য পৃথিবীর দোলনায় চড়ে
বসে! তবু যে কেন বাঙালির ফোড়ন কাটাতে এত দোষ ধরা হয়, বুঝি না। আমি তো ফোড়ন কাটতে
খুব ভালোবাসি। সে সাধারণ আলোচনা, গল্প, আড্ডাই হোক বা গুরুত্বপূর্ণ কোনো বিষয়। কী
যে মজা লাগে! আমি ফোড়ন দিলাম, আর এক্ষেত্রে
ফোড়ন চিড়বিড় করল না, অন্যদের গায়ে চিড়বিড়ানি ধরল। আর আমি ভালো মানুষের মত মুখ করে
তাড়িয়ে তাড়িয়ে সে সব উপভোগ করতে থাকলাম। এ ফোড়নের গল্প একেক জনের এক এক রকম। সেই
সব ভিন্নতাই আমাদের আলাদা আলাদা গোত্রের প্রমাণিত করেছে।
এবার ধরা যাক মালাইকারির কথা। এখানে অবধারিত ভাবে আসে
সরষে ফোড়নের গল্প। তেলে দিলে ফটফট কিছুটা ফেটে গিয়ে যেন জানান দেয় আমাদের, যতই
তেলে ভাজ না কেন, আমার ঝাঁজ মরে নি আজও। তাই প্রমাণ রেখে যাচ্ছি। সব মানুষ কিন্তু
প্রমাণ রেখে যেতে পারেন না নিজের বেঁচে থাকার, নিজের ঝাঁজের। যাঁরা
পারেন, তারাই সফল এই সরষের মত। অবশ্য এই সরষের ব্যবহার দক্ষিণ ভারতীয়রাও করেন
সর্বক্ষেত্রে। ওদের ওটাই সম্বল ঘটির পাঁচফোড়নের মত। আর জিরে হল একটু অন্য গোত্রের।
সবার সঙ্গে মেশে না, একটা দূরত্ব নিয়ে বসে থাকে, নিজেকে অনেক উঁচুতে রাখতে
ভালোবাসে। যেন এলিট ক্লাস। অথচ নিজের কৌলীন্য বজায় রাখতে গিয়ে ইনি ভেতরে ভেতরে
ভীষণ একা হয়ে যান, সেটা কেন যেন আমি অনুভব করি। বুঝতে পারি, তাঁর চারদিকে দেওয়াল
তোলা আছে, আর একটা ছোট্ট ঘুলঘুলি দিয়ে তিনি শ্বাস নিচ্ছেন। তিনি আসলে আভিজাত্যের
অহংকারে ক্ষয়ে যাওয়া একলা অসহায় একজন। সে যাই হোক, তেজপাতার সঙ্গে জিরে ফোড়নের
জোড়ি মৃত্যু পর্যন্ত ডেকে আনতে পারে! এ মৃত্যু অনেকটা হরিণীর কস্তুরী জনিত কাহিনীর
মত। আর সঙ্গে যদি একটু ঘি আর গরমমশলা পড়ে, তাহলে তো কথাই নেই। তখন সে এক অন্য
পৃথিবী, রূপকথার জগতে নিয়ে যাবে আপনাকে।
এবার যদি মেথির কথা ভাবেন, খুব অপ্রয়োজনীয় যদিও এই
ভাবনা। মেথি ছাড়া আমাদের দিব্যি চলে যায়। মেথিকে আমাদের কস্মিনকালেও মনে পড়ে না
তার তিতকুটে মেজাজের কারণে। তবুও যদি একটু বদল চান, একটু অন্যরকম দিন চান, সেদিন
মুসুর ডালে মেথি ফোড়নের জুড়ি নেই। কিম্বা মেথি শাকে। আর সামান্য বিন্দুর মত
ক্ষুদ্র রাঁধুনি? পরিমাণ মত হলে ঠিক আছে, বেশি হলে অতিরিক্ত লেবু চটকানোর মত
ব্যাপার খানিকটা। তেঁতো তেঁতো লাগবে। শুক্তো বা তিতের ডালে এ বস্তুটি না হলে আলুনি
লাগবে। তিতের ডাল বা তিতার ডাল একদমই বাঙাল গ্রুপের। কাঁচা মুগ ডালে লাউ আর উচ্ছে দিয়ে
সরষে-রাঁধুনির সোম্বার দিতে হয়। রেসিপির কথা না হয় থাক। জ্যান্ত মাছ পেলে রাঁধুনির
সাথে আদা-জিরে বাটার ঝোল গরম কালে অতি উপাদেয় শুধু এই রাঁধুনির গুণে। আর মৌরী? সে
যেমন মুখ শুদ্ধ করে চলেছে আমাদের, তেমনই মিষ্টি চাটনিতে এই ফোড়নের গন্ধ না থাকলে
জীবনটাই ব্যর্থ মনে হবে। আমি ভাবি, এই অপ্রয়োজনীয় মেথি, ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র রাঁধুনি,
যে কিনা এমন রাঁধুনি যে রাঁধতে জানে না – এরা যেন অনেকটা লোয়ার ডিভিশন ক্লার্ক বা
বেয়ারার মত। এরা কাজ করে, কিন্তু ওদের অস্তিত্ব যেন নেই! থেকেও কেমন নেই হয়ে যেতে
পারে এরা! মৌরী অবশ্য তেমন এলেবেলে টাইপের না, সে সিনেমার ডবল রোল করা নায়িকা।
সীতা অউর গীতা।
এবার ফিরে আসি পাঁচফোড়ন
প্রসঙ্গে। আসলে ফিরে আসতেই হয়। সাদামাটা কালোজিরে, এলিট ক্লাসের জিরে, সুগন্ধী
মৌরী, ক্ষুদ্র রাঁধুনি আর তেঁতো মেথি- একসাথে মেশানোর পদ্ধতি কে আবিষ্কার করল? কার
মাথা থেকে এমন ডেডলি কম্বিনেসন বেরলো ভাবলেই অবাক হতে হয়। ধরুন সাদামাটা আমি, কোনো
উচ্চবর্গীয় এলিটের পাশে বসতে পারি? পারি
না। আবার তথাকথিত নীচু জাতের এক ডোম এবং সুগন্ধী জড়ানো কোনো সুন্দরী কি পারে
প্রেমে হাবুডুবু খেতে? আর ওই তেঁতো মুখী খিটখিটে দজ্জাল বুড়িকে তো সবাই এড়িয়ে চলে। তার
সাথে আড্ডা! স্বপ্নেও জমবে না। অথচ আমরা বা আমাদেরই মত কেউ এই অসম্ভব কাজটি করে দেখিয়েছেন পাঁচফোড়ন আবিষ্কার করে। আর
এই অসম্ভব ফোড়নটিকে আমরা নিতান্তই কেজো মানুষের মত, শুধু প্রয়োজনে লাগে এমন
মানুষের মত হতচ্ছেদ্দা করে ফেলে রেখেছি!
গেঁয়ো জোগী কোনোদিনই ভিখ পায় না। আমার খুব ভয় হয় মাঝেমাঝে, যদি কেউ এই পাঁচফোড়নের
পেটেন্ট নিয়ে নেয় কেড়ে! আত্মহারা বাঙালি তখন সর্বহারা হবে। আর এই বোধ এখন জাগবে না
তাদের। দাঁত থাকতে দাঁতের মর্ম আর কে বুঝেছে! ভাবুন মশাই ভাবুন!
দারুণ লিখেছ। জিও তুষ্টি।
উত্তরমুছুনপড়ে ফেলেছ আগেই!
মুছুনতুষ্টি, যাবো একদিন তোর হাতের রান্না খেতে ।
উত্তরমুছুনএস। তোমাকে দিয়েই রান্না করাব।
মুছুনখুব ভালো লাগলো। পাঞ্চজন্য শঙ্খের মতো পঞ্চস্ফোটন। যোয়ান ও ফোড়ন। আমি অম্বল চাটনিতে দি।পাঁচফোড়নে ধনে সিড মেশাই কালোজিরার বদলে। কবিতার মতোই রান্না নিয়ে আমার অবিরাম পরীক্ষা নিরীক্ষা চলে।
উত্তরমুছুনহ্যাঁ এমন না চললে তো, থেমে যাবে সব।
মুছুনভাল লাগল বেশ--অনেকটা রম্য ব্যাপারটাও খুঁজে পেলাম--
উত্তরমুছুনথ্যাংকিউ
মুছুন