কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

শুক্রবার, ১ জুন, ২০১৮

মেঘ অদিতি




খেলাঘর


ছড়িয়ে থাকা ভাঙা কাচের টুকরোতে যেভাবে হারিয়ে যায় সময়, তেমনই টুকরো হতে হতে ক্রমশ নিজেকে  হারিয়ে ফেলার বারান্দায় রোদ গলছিল একটু একটু করে। বেলফুলের পাতায় জড়ো হচ্ছিলো মেঘ আর আলো থেকে ছায়ার দিকে তখুনি ফেড আউট।

সদর দরজা বন্ধ। চাবি হারিয়ে তাই এ পথ থেকে সে পথ। অলিগলি ঘুরে অন্ধগলির শেষমাথায় যখন, একটা দিনের সমাপ্তিপর্বে সূর্য তার শেষ করুণাটুকুও সরিয়ে নিলো।

ঘর! সত্যি কি আর ঘরে ফেরার তাড়া আছে! দুটো ঘরের ফ্ল্যাটে যেটুকু আলোহাওয়া খেলতো কখনো সেখানে দেয়াল উঠেছে আগেই। তবু ফেরা ছিল। ওই যে ফুলটুসি। বছর দশের টুসি বাবাইয়ের জন্য অপেক্ষা করত যে! ফিরতে হতই। টুসি এখন কী করছে?  

মুখের ওপর এক এক করে দরজা বন্ধ হলে বাইরের আলোও নিভে আসে। আধো অন্ধকারে সে এক পা এগোয় আবার দাঁড়িয়ে থাকে। লাইটপোস্টের মরা আলোর নিচে দাঁড়িয়ে মনে পড়ে একটা সোয়েটারের নির্মাণপর্বে দুটো সচল হাতের ওঠানামা। উলের গোলাটা গড়িয়ে যাচ্ছিল বারবার। ছাদে তখন মৃদুমন্দ বাতাস। এক একবার দৌড়ে সেটা তুলে এনে মায়ের আঁচলে মুখ ঘষছিল সে, দেখছিল আসন্ন শীতের প্রস্তুতিপর্বে উল আর কাঁটার সখ্যতা। দেখতে দেখতে তার মনে হয়েছিল মা নামের পৃথিবীটাই সম্বল।

কেউ কি ডাকছে তাকে! কচি রিনরিনে আওয়াজে সচকিত হয়। মনে হয় ফুলটুসি বাবা ও বাবাই বলে ডাকছে। আর তখুনি তার ট্রাউজারে ফের টান পড়ে। সে ঘাড় ঘোরায় ডানদিকে। পথশিশু। খিদে পেয়েছে, দুটো টাকা দাও না বলে তার দৃষ্টি আকর্ষণে অক্ষম হয়ে ট্রাউজারের কোণ ধরে টানছে। পাশে একটা নেড়িকুকুর  কুণ্ডলী পাকিয়ে শুয়ে। সে পকেট থেকে মানিব্যাগ বের করে, কী ভেবে তা আবার পকেটে ঢুকিয়ে হনহন করে মোড়ের দোকানে যায়। ফিরে এসে পাউরুটি আর দুটো কলা মেয়েটার হাতে গুঁজে দিয়ে সিগারেট ধরায়। অল্পসময় পর আধখাওয়া সিগারেটটা  ফেলেও দেয়। পায়ে মাড়িয়ে ঘষে ঘষে আগুন নেভায়। তারপর আনমনে হাঁটতে থাকে।

খামারবাড়ির ফুটপাত। হাঁটতে হাঁটতে সে এখন বস্তুত ফিরে গেছে ষোলো বছর আগে। বাবা মা আর সেই যে নতুন শাড়ির খসখস আর মৃদু চুড়ির টুংটাং, সেও কী প্রবল টান! তখনও মনে হত বেঁচে থাকার জন্য আর কী চাই! পাঁচটা বছর তো  রমরমিয়ে চলেও গেল আর তারপর ফুলটুসি।

কিন্তু টুসি বড় হতে হতে বদলে গেল আবার অনেক কিছু। লাট্টুর মতো পাক খেয়ে অনেকটা সময় পেরিয়ে গেল, শেষে ফুলটুসিই হয়ে উঠলো তার বেঁচে থাকার আকর্ষণ। বাকি যা কিছু তা তো কেবল মেনে নেওয়া আর মানিয়ে নেওয়ার খেলা।

ফুলটুসি ছিল। সদর দরজা বন্ধ। ফুলটুসি নেই। চাবি হারিয়ে এ পথ থেকে সে পথ ঘুরতে ঘুরতে ক্লান্ত হয়ে সে ক্রমেই এক ছায়া হয়ে উঠতে চাইছে... ফুলটুসি আছে?   

মানিক মিয়া এভিনিউয়ের আকাশে এখন মস্ত গোলগাল এক চাঁদ।




1 কমেন্টস্: