প্রাচীন
যুগে রূপকথা
রূপচর্চার মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষষ হল নখ।
নখ বড় রাখার বিচিত্র এ চর্চা দেখা যেত মূলত ধনী সমাজের মাঝেই। তারা নিজেদের প্রভাব প্রতিপত্তি দেখাতে নখের পরিচর্যা করত। তারা এটা বোঝানোর চেষ্টা করত যে,
এত টাকা-পয়সা তাদের আছে যে নিজ হাতে কাজ না করলেও দাস-দাসীদের দ্বারা দৈনন্দিন কাজকর্ম সম্পন্ন হবে। দাস-দাসী দিয়েই জামা- কাপড় পরা ও খাওয়া-দাওয়ার কাজটা সেরে নিত তারা। নখের মধ্যে নানা রকম রঙের ব্যবহার হত। আর সেই রঙের মধ্যে ব্যবহার হত ভেষজ ও আয়ুর্বেদিক উপকরণ, যা রঙকে দীর্ঘস্থায়ী করত নখের উপর। যাকে পরবর্তীতে নেইলপালিশ বলা হয়। পালিশ কথাটা এই কারণে এসেছে বাড়ির রঙের মত নেইলকে রঙিন ভাবে পালিশ করা হত। আর সেই রঙের সাথে সাথে নানা প্রসাধনীর জিনিস হাতে বসানো হত। সেটি বিভিন্ন উপকরণ দিয়ে বানান হত।
মধ্যযুগে এবং রেনেসাঁর সময়ে ইউরোপের নারীদের সাজসজ্জা শুধু মাথার চুল তুলে কপাল বড় করার মাঝেই সীমাবদ্ধ ছিল না। চোখের পাতার লোমকে তখন অতিরিক্ত যৌনবেদনময়তার প্রতীক হিসেবে দেখা হত। তাই অনেক নারীই তাদের সেই লোমগুলো একেবারে তুলে ফেলতেন। এছাড়াও প্রাচীন গ্রীসে জোড়া লাগা ভ্রু ছিল নারীদের পবিত্রতা এবং বুদ্ধিমত্তার প্রতীক। এটা না থাকলে অনেকেই চোখের সুরমা ব্যবহার করে সেই ঘাটতিটা পূরণ করত। সুরমা এবং কাজল দুটি প্রাচীন এবং বর্তমানে রূপচর্চার সামগ্রী হিসাবে দেখা হত। “ওগো কাজল নয়না হরিণী...”, হ্যাঁ সবার হরিণের মত নয়ন বা চোখ ছিল না ঠিকই, কিন্তু তাকে কাজল দিয়ে আকর্ষণীয় করতে ক্ষতি কী!
আসলে রূপ শব্দটার মধ্যে এমনই এক মোহ জড়িয়ে আছে যার টানে যুগ যুগান্ত ধরে প্রকৃতির দুর্নিবার টানাপোড়েন চলে আসছে। রাধাকৃষ্ণ প্রেম কিংবা শিব দুর্গার প্রেম সব কিছুর মধ্যে লুকিয়ে আছে প্রকৃতির সেই আদি রহস্য। কাজল বা সুরমা লাগিয়ে নিজেকে মোহময়ী করা হত। সে যুগে পুরুষরাও সুরমা ব্যবহার করত। এখনও অনেকে করে থাকেন।
কাজল বা সুরমা উপকরণে থাকত ভেষজ উপাদান। চোখের উপরে ও নীচে সুরমা পরিমাণ নির্ভর করত চোখের গঠনের উপর। ছোট আকৃতির চোখে হালকা করে এবং বড় আকৃতির চোখে মোটা করে লাগানো হতো।
জাপানি নারীদের প্রতিদিন দাঁত ব্রাশ করার অভ্যাস একেবারেই ছিল না। আমাদের মধ্যে গড়ে ওঠে সেই ছোটবেলা থেকে দাঁতের সুরক্ষা রক্ষা নিশ্চিত করার পাশাপাশি দাঁতকে ঝকঝকে সাদা দেখানোও নিয়মিত এই ব্রাশ করার অন্যতম উদ্দেশ্য। তবে জাপানি নারীদের মাঝে প্রচলিত সৌন্দর্য চেতনা ছিল এর ঠিক উল্টো। হাজার বছর ধরে জাপানি নারীরা তাদের দাঁতকে কালো রঙে রাঙিয়ে নিত। উনিশ শতক পর্যন্তও তাদের মাঝে এ চর্চা দেখা গেছে। সৌন্দর্য বর্ধনের পাশাপাশি বিয়ের অঙ্গীকার রক্ষার একটা প্রতীকী রূপও ছিল কালো দাঁত। দাঁতে নানা রকমের তামাকজাত দ্রব্যের ব্যবহার পরবর্তীতে দেখা যায়। দাঁতের আকার ছোট-বড় হলে তাতে গার্ডের ব্যবহার দেখতে পাওয়া যেত।
আবার প্রাচীন ধনী রোমান সম্প্রদায়, আরো ভালো করে বলতে গেলে ধনী রোমান নারীরা তাদের দাঁতকে ঝকঝকে সাদা করার জন্য বেছে নিয়েছিল মানবমূত্রকে। সেই মূত্র দিয়ে ধুয়েই দাঁত পরিষ্কারের কাজটি তারা করত। তবে যেন তেন মানুষের মূত্রের উপর ভরসা করতে পারত না তারা। দাঁত পরিষ্কারের জন্য তারা শুধুমাত্র পর্তুগিজদের মূত্রই ব্যবহার করত। এজন্য জাহাজ ভর্তি করে জার পূর্ণ পর্তুগিজ মূত্র আসত রোমান নারীদের জন্য। মূত্রে থাকা অ্যামোনিয়া জীবাণুনাশক হিসেবে কাজ করত। শুনতে আশ্চর্য লাগলেও সত্য যে, আঠারো শতক পর্যন্ত মাউথওয়াশ হিসেবে মূত্র ব্যবহৃত হয়েছে।
আঠারো শতকে এসে ইউরোপীয় নারীদের সৌন্দর্য চর্চায় পরিবর্তনের হাওয়া লাগে। আগেকার সময়ের হালকা সাজসজ্জার বদলে তখন তারা বেশ ভারি সাজসজ্জার দিকে ঝুঁকতে শুরু করে। এরই একটা অংশ ছিল বিভিন্ন ধরনের বিউটি প্যাঁচ। চাঁদ, তারা, বর্গ, বৃত্ত ইত্যাদি নানা আকৃতির বিউটি প্যাঁচ পাওয়া যেত তখন। ছোট ছোট সেই ফেব্রিকগুলো মুখের বিভিন্ন জায়গায় লাগানো হত। আর একেক জায়গায় লাগানোর অর্থ ছিল একেক রকম। যেমন যদি কোনো নারী এমন বিউটি প্যাঁচ তার ডান গালে পরত তবে তার অর্থ হত যে, সে বিবাহিতা। এই রূপচর্চাগুলো পরবর্তী কালে বদলে যেতে থাকে। মুখের মধ্যে নানা রঙের ব্যবহার শুরু হয়। মুখের মাঝে অর্থাৎ গালে লুজের মত রঙ ব্যবহার হত। মুখের বাকি অংশে সাদা পাউডার জাতীয় জিনিস ব্যবহার করা হত।
প্রাচীনকালের চীনের রূপচর্চায় ঢু মারলে দেখা যাবে তৎকালীন নারীরা তাদের ভ্রু’কে কালো, নীল কিংবা সবুজ গ্রিজ দিয়ে রাঙাতে খুব পছন্দ করত। সেইসঙ্গে তখনকার ফ্যাশন অনুযায়ী ভ্রু’কে দিত নানা আকৃতি। হান রাজবংশের সময়ে কোনো দিক নির্দেশ করা ভ্রু’র স্টাইল বেশ জনপ্রিয় ছিল। আবার এককালে ‘দুঃখের ভ্রু’ নামক একপ্রকার স্টাইল বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। এই স্টাইল অনুসারে কারো ভ্রু’কে মাঝখানের জায়গায় বাঁকিয়ে কিছুটা উপরের দিকে তুলে দেওয়া হত। ভ্রু’তে অলংকারের ব্যবহার দেখা যেত। যাদের ভ্রু জোড়া ছিল তাদের খুব পবিত্র মানা হত। প্রাচীনকালে নারী পুরুষ উভয়ই ভ্রু’কে যত্ন নিয়ে পরিচর্যা করত।
প্রাচীনকাল থেকে আজও নারীরা ভিন্ন উপায়ে নিজেদের রঙিন রাখার চেষ্টা করে। তবে সর্বতোভাবে রূপের আড়ালে লুকিয়ে থাকে সজীব মন। তার পরিচর্যাই হল রূপচর্চার আসল চাবিকাঠি। রূপ নিয়ে পুরুষ কিংবা নারীর উন্মাদনা চিরকালই ছিল বা থাকবে।
আগে বাঙালি পুরুষদের স্টাইল বলতে ছিল ধুতি, কুর্তা, পাজামা, শার্ট। একসময় উত্তমবাবুর চুলের আদলে পুরুষরা চুল কাটা শুরু করল এবং তার সাথে সাথে শার্ট পরাও শুরু হল। তারপর সৌমিত্রবাবুর ছোট ছোট টিশার্টের মধ্যে রকমারি ছাপ দেওয়া দেখা যায়। আর মেয়েদের ক্ষেত্রে সুচিত্রা সেন, অপর্ণা সেন কিংবা তাঁদের পূর্ববর্তী নায়িকাদের নকল করে চুলের স্টাইল ও জামা কাপড় পড়তে দেখা যেত।
রূপকে নিয়ে মানুষের আগ্রহের শেষ নেই। এখন সে সব ছেড়ে বাঙালি মেতেছে জিন্স, টিশার্টে। তাই সেই রূপচর্চার মধ্যে রক্ষণশীলতা, সৃষ্টিশীলতা কমে যাচ্ছে। রূপচর্চা এখন বদলে গেছে অনেকটাই।
মূত্র দিয়ে দাঁত মাজার ব্যাপারটা মজার। ব্যাপারটা আর মজার থাকেনা যখন মূত্রপান করে শারীরিক চিকিৎসা চলে।
উত্তরমুছুন