কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

সোমবার, ৭ মে, ২০১৮

সুমী সিকানদার




তুমি সন্ধ্যার মেঘমালা

মিহিকে খুঁজে পেলাম বহুকাল বাদেই। তাকে দ্রুত ফোন করে ফেলেছি। বুক ঢিপ ঢিপ করছে। সে জানে না আমি অচেনা নাম্বারের চেনা মানুষ
অনেক কাল আগের ছি-বুড়ি খেলার ধুলোসাথি।

তো ফোন বাজছে বাজছে, সে আর ধরে না। আমি একত্রে কত কী বলব ভেবে  ফোনের এক একটা বাটন টিপেছিলাম। মিহি ফোন ধরলো না। আমার প্রাথমিক উচ্ছ্বাস ঝুপ করে ঠান্ডা মেরে গেলো

মন শান্ত করার জন্য রাঁধতে বসেছি। মাঠে আমি আর মিহি ড্রাম এবং কঙ্গো বাজাতাম। সাদা পোশাকে কটকটে রোদের মিশেলে আমাদের মুখ শ্যমলা থেকে কালচে হয়ে আসতো। ড্রিল আপা আমাদের খাবারের বিরতি দিলেন। আমরা সবাই বিরিয়ানি খেতে বসে গেছি। এক দুই গাল খেয়েই উঠে যাচ্ছে মিত্রা। কোথায় যাস?

তেলে পেঁয়াজ দিতেই ছ্যাঁৎ করে উঠেছে গরম তেলের অভিমান ঘোচাতে পেঁয়াজ দিয়েছি এক কাপ। গরম তেলে পেঁয়াজ নাড়তে খুব আনন্দ।

মিহি কেন ফোন ধরলো না বুঝতে পারছি না। রান্নায় মন দিই। প্রথমে মরিচ দিলাম মশলা বানাতে তাতে রঙ ভালো হয়। এরপর একেক একে হলুদ, ধনেগুড়া, আদা, রসুন, জিরা সামান্য পানি দিয়ে কষতে থাকলাম হাল্কা করে ঘ্রাণ ছড়াচ্ছে। মশলা দেয়া হয়ে গেলে হাড়ি ঢেকে দিয়ে ফের ফোন নিয়ে বসলাম। অনেকক্ষণ ধরে বেজে বেজে ফের থেমে গেল ফোন।


স্কুলে দুপুরের বিরতির পর আর মিহিকে সেদিন পাইনি। খুঁজে খুঁজে আমি হয়রান আমাদের আর কোনো এক্টিভিটিজ ছিলো না। শিল্পী শুভ্রদেব এসেছিলেন  কাজেই আধুনিক গান হচ্ছিল জমিয়ে পুরো মাত্রার বাজনায় নাচছিলো স্কুল প্রাঙ্গণ আমি বারবার পথের দিকে তাকাচ্ছি। স্টেজে শুভ্রদেব গাইছেন আমি হ্যমিলনের সেই বাঁশিওয়ালা। আমি বারবার লালনীল কাগজ দিয়ে সাজানো গেটের  দিকে তাকাচ্ছি। যেন সেই বাঁশি শুনে কোত্থেকে শুভ্রা চলে আসবে।
অনুষ্ঠান শেষে পুরস্কার বিতরণ হয়ে গেলে পুরস্কারসহ বাড়ির পথ ধরেছি। মিহি ফেরেনি। আমি খুবই বিষণ্ণ

মাংস কষিয়ে কষিয়ে তেল উঠিয়ে ফেলেছি। আধা সিদ্ধ হয়েই গেছে
কম পানিতে মাংস কষানো অভ্যাস ঝিরঝির করে কেটে রাখা পাতা কপি ছেড়ে দিলাম মাংসে।  এর মাঝেই সদ্য পাওয়া বন্ধুর নাম্বারে ডাকি সে আর  আমাকে  ধরে না। আমি মাংস কম জ্বালে রেখে চলে আসি।   

সেবার মিহি বাড়ি ফিরেছিলো পাক্কা এক সপ্তাহ পর একাই। মা, রাগ করেছো মা? ক্ষমা করে দাও। অন্যায় করেছি। চলে এসেছি আমি মা’। সেদিন তারা  পালিয়ে গেছিলো বিয়ে করবে বলে। কিন্তু বিয়েটা সেবার করেনি তার জন্য  নির্ধারিত পুরুষ। মিহির মা বাবা দুজনেরই বয়স হয়েছে। দুজনেই অসুস্থ। মেয়ে ছিলো না, সে এক রকমের দুশ্চিন্তা কিন্তু মেয়ে যখন একা ফিরলো এবং কোনো জবাব ঠিকঠাক দিলো না, তখন মিহির আম্মা বিছানা নিলেন   

পাড়ার বখাটে  রমিজ ভাইয়ের সাথে মিহির চিঠি চালাচালি অনেকেই জানতো। আমিও যে জানতাম না, তা  নয়। কিন্তু নিজে থেকে কিছু জানতে চাইতাম না কেন যেন! আমার ঠিক বিশ্বাস হতো না। এতটা বিতর্কিত মানুষের সাথে মিহি  এত সহজে জড়িয়ে যাবে বলে বিশ্বাস হত না। পড়াশোনাও বন্ধ হয়ে যায় তার।

একসময়  নিজেদের ছড়িয়ে যাওয়া, বিভিন্ন জায়গায় ভর্তিপরীক্ষা, ব্যস্ত  জীবনযাপন মিহিকে বেশ ভু্লিয়ে দিলো সেই ঘটনার পর মিহির বাসায় যাওয়া এক প্রকার বন্ধ হয়ে গেছিলো। জীবন কখনো খালি কলসি, কখনও কলসি ভরা নদী।

বাঁধাকপি দিয়ে মাংস ভুনা হয়ে গেছে ঘ্রাণ বাড়াতে তরকারীর উপরে টালা জিরে ছড়িয়ে দিলাম। মনে মনে  মিহিকে খুব মনে পড়েছে। যে হারিয়ে গেছে সে হারানোই থাকতো। এতটুকু ডিজিটের মধ্যে ফিরে আসার কোনো মানে হয় না। পুরনো বাসা ছেড়ে পরিচিত গন্ডি ছেড়ে, বন্ধু ছেড়ে, মিহি কোথায় হারিয়ে গেলো। কেউ হারিয়ে গেলে আমরা সবার আগে খুঁজি তার শেষ বলা কথা, দেয়া নেয়া। জীবন ফুরিয়ে যায় কিন্তু অদেখা একটা বিমর্ষ লেনদেন রয়ে যায়।

বিকেলে  একটু বের  হবো বলে শাড়ি বাছই করছি কানে সন্ধ্যার মেঘমালা  প্রতিদিন এই সময়ে শ্রাবণী সেনের ‘তুমি সন্ধ্যার মেঘমালা’ আমার চাই বিডস-এর গহনা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। কানের হেডফোন আমাকে মেঘের তালছাড়া সুরে তন্ময় করে রেখেছে। ভালোবাসা দূর থেকেই ভালো।

একাকী ডাইনিং টেবিলে একা পড়ে থাকা মোবাইল স্ক্রিনে ভেসে উঠেছে  একটা অচেনা নাম্বার মিহি ফোন করছে বারবার 


0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন