ঊনবিংশতিপর্ব
আষাঢ়ের ভিজে বাতাসে বিড়ির আগুন
জ্বলে অনেক সময় ধরে। জোরে টানতে টানতে নেশা ছড়িয়ে যায় সব্বাঙ্গ জুড়ে। মৌতাতে শেষ
টান দিয়ে সুতো পর্যন্ত পুড়ে যাওয়া বিড়িটা খুব যত্ন করে টুসকি দিয়ে দামোদরের জলে ছুঁড়ে
দেয় যুধিষ্ঠির মাঝি। একমাস আগে এটাই ছিল
মরা খাল। আজ সে শুয়ে আছে চরের বালির শরীরে। লাফা-ঝাফা। কিছুক্ষণ থমকে দাঁড়িয়ে সে
কথা ভেবে বিড়ি ওড়ার পথটা দেখে নিয়ে হনহন করে হাঁটতে থাকে দামোদরের চর ধরে। ভাবখানা
যেন আকাশভাঙা কাজ পড়ে আছে! আর তাকে যেতে হবে তেপান্তরের মাঠ পেরিয়ে বহু দূর।
সন্ধ্যে হয়ে আসছে। বিকেলের আলো
গুটি মেরে নেমে আসছে শরবনের ঝোপে। বালির শরীরে এখনো সূর্যের তাপ। ঠিক ওই শরবনের পাশেই তার বউ শুয়েছিল। আর একটু এগোলে তিরতিরে
সাদা জল। ধুয়েমুছে এক্কেবারে সাফ।
সেদিন ভোরে চাঁদটা ছিল ঠিক এমনি
আধখানা। আকাশ ঘুরে আসতে চাঁদ কতটা সময় নেয় সে কথা ভাবতে থাকে। ভোরে পাশে না পেয়ে
সে খুঁজতে বেরিয়েছিল। শরবনের পাশে দোপদি মেঝেনের শুয়ে থাকা কালো শরীরটার অপর আছড়ে
পড়ে সে কাঁদতে থাকে।
মোড়ল কিষ্টো বলে, মিটমাট করে নে
বাপ! আবার এইসব ছোটোখাটো ঘটনা নিয়ে পুলিশ ডাক্তার করার দরকার কী! তেনাদের অনেক
কাজ। আমি বলে দেবো। তেরোদশির দিন পঞ্চায়েত
থেকে সারা গ্রামে খাসি খাওয়ানো হবে। মেইয়ে মানুষের শরীর চাইলে আরও কত পাবি, কিন্তু
এত টাকা তোর কোন্ বাপ দেবে। মেয়েমানুষের শরীর কখনো কারো একার সম্পত্তি হয় না। ভাগ
করে নিতে হয়। ভাগাভাগিতে কাটাছেঁড়া হয়ে গেছে।
যে জমির ওপর তার বসতবাটি সেটা তার
নিজের নয়। চরে যে ফসল সে ফলাতো তাও তার
নিজের নয়। পোড়া বিড়ির টুকরোটাকে কেমন আকাশ, বাতাস আর জল মিলে ভাগাভাগি করে নিল। এমন
কী মেয়েমানুষটাও আর পাঁচজনের।
চরের ওই বালির ওপর নিজের হাতে
বিছিয়ে দিয়ে ছিল শুকনো কাঠের বিছানা। কাঠের ধোঁয়া যখন আকাশময়, তার চোখ জ্বালা করে। কিষ্টো তার কাঁধে
হাত রেখে বলে, শোক করিস না। জীবন নদীর জলের পারা। এখন এখানে জল, বয়ে যাচ্ছে। আর
সমুদ্দুরে গেল তো ধোঁয়া।
ভাবতে ভাবতে সে থমকে দাঁড়ায়। একটা
পাখি উড়ে বেড়াচ্ছে তার মাথার ওপর। বাকি সব বাসায় ফিরে গেছে। পাখিটাকে সে তাড়া দেয়।
অন্ধকার নেমে আসছে। ভুল করে যদি পাখিটা শরবনে থমকে যায়! সে অপেক্ষা করে। পাখিটা
আগে বাসায় ফিরুক!
0 কমেন্টস্:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন