খুশি আর সোনার-ডিমপাড়া হাঁস
বি এড
পাশ করে বসেছিলাম এমন সময় আমাদের পাড়ার ডাক্তারবাবু এসে বললেন – ভাই, তুমি তো
বাড়িতেই আছ, বস্তির ইস্কুলে ছেলেমেয়েদের একটু পড়িয়ে দাও না! রোজ ঘণ্টা দুই সময় দিলেই হবে।
এই
ডাক্তারটির নিজের মাথাতেই ভাইরাস আছে। বস্তির ক্লাব ঘরটায় ইস্কুল খুলেছেন, বইখাতা
নিজেই কিনে দেন। ছাব্বিশটি পড়ুয়া জুটেছে। কী ভেবে রাজি হয়ে
গেলাম। সিলেবাস খুব সরল – বাংলা,
এক-দুই-তিন আর এবিসিডি – পড়া এবং লেখা। এই অঞ্চলের সরকারি
স্কুল একটু দূরে। সেখানে বাচ্চাদের যারা পাঠিয়ে উঠতে পারে না তাদের জন্য হাতের
কাছে এই ব্যবস্থাটি করা। এদের মায়েরা বাসনমাজা ঘরমোছার কাজ
করে। বাবারা বেশিরভাগ দিন-মজুর – আজ এখানে
কাল সেখানে। অনেকের বাবা থেকেও নেই, মানে এ পরিবার ছেড়ে অন্য কোথাও ঘর বেঁধেছে।
এদের
বাড়িতে লেখাপড়ার কোনো আবহ নেই। প্রায় সকলেরই মা বাবা নিরক্ষর। তবু গোটা পাঁচেক ছেলেমেয়ের দেখলাম পড়ায় বেশ মন
আছে। নতুন জিনিস চটপট শিখতে পারে, আসেও নিয়মিত। রোজ অবশ্য ইস্কুল হত না –
অন্নপ্রাশন, শ্রাদ্ধ, শীতলাপুজো – এসবের জন্য ক্লাব ঘরটা লাগে, তাই স্কুল বন্ধ
করতে হয়। ঘর একটা, পড়ানোর মানুষও একজন। সবাইকে একসঙ্গে পড়াতে হত - কেউ প্রথম ভাগ, কেউ
এবিসিডি। কেউ খানিক খানিক এগিয়েছে, কেউ অ আ তে খাবি খাচ্ছে।
মাস
তিনেকের মত পড়িয়েছিলাম। তারপর বরাত খুলল, হাইস্কুলে চাকরি হয়ে গেল। ডাক্তারবাবু
এসে বললেন – বাঃ, খুব ভাল। তুমি যে উন্নতি করবে তা জানতাম।
কিন্তু
ডাক্তারবাবু যে বস্তির ইস্কুলে আমার ‘ফেয়ারওয়েল’ দেবেন তা আমি ভাবতেই পারিনি।
গেলাম। মিষ্টির প্যাকেট দেওয়া হবে শুনে সেদিন সবকটা বাচ্চা হাজির। মিনিট কুড়ি
এটাসেটা বলা-কওয়া হল, তারপর বাচ্চাদের লাইনে দাঁড় করানো হল প্যাকেট বিলির জন্য। এই
ফাঁকে ডাক্তারবাবু বললেন – ইস্কুল আপাতত ছুটি দিয়ে দিলাম। টীচার নেই যে! দেখো তো চেনাশোনা কেউ যদি থাকে। আমিও চেষ্টা করছি।
বাচ্চারা
প্যাকেট শেষ করে ফেলেছে। দু-একজন খোলেইনি, বাড়ি নিয়ে যাবে। কটা ছেলে নিমকির টুকরো
নিয়ে দুষ্টুমি করছে। এর মধ্যে দেখলাম মেয়েটাকে – এর নাম খুশি। বছর ছয়েকের হবে।
খেয়াল করেছিলাম, পড়াশোনোয় এর মন খুব। মিষ্টি
খাওয়া হয়ে গেছে, বাক্সটার ভাঁজ খুলে মেঝেতে সমান করে পেতেছে। বসে বসে পড়ছে কী লেখা আছে। -- ত এ আকার তা, র, ক –
তারক। ম এ হস্যি মি, তারপর...
লেখা
ছিল তারক মিষ্টান্ন ভাণ্ডার। খুশি প্রথম ভাগ শেষ করেছে তবে যুক্তাক্ষর শেখেনি,
শেখার কথা ছিল এবার। তাই ষএ টএ পড়তে পারছে না। এখন আর কে শেখাবে? আবার কবে টীচার
পাওয়া যাবে কে জানে!
হাই-স্কুলে
জয়েন করলাম। মাইনে ভাল। তার থেকেও ভাল সোনার-ডিম-পাড়া হাঁসগুলো। হাঁসের নাম টিউশন।
তেমন পার্টি পেলে প্রতি সাবজেক্ট দেড় হাজার অবধি দর ওঠে। উফ্, ভাবা যায়! হাঁসের ফোন আসা শুরু হল, টিউশনি ধরলাম
বেশ কয়েকটা। ইস্কুলের সময়ের আগে টিউশন, পরে টিউশন। পরিশ্রম খুব, ইস্কুলের ক্লাসে
অবশ্য একটু জিরিয়ে নিতাম।
একদিন
মনে হল একঘণ্টা আগে ঘুম থেকে উঠতে পারলে আর একটা দেড়-হাজারি ম্যানেজ করা যায়।
সঙ্গে সঙ্গে আমার পেটের ভেতর থেকে কে যেন খুশির কথাটা মনে করিয়ে দিল। বস্তির সামান্য ইস্কুলে যেটুকু পড়ানো হয়েছিল মেয়েটি
তা একটুও ভোলেনি। যুক্তাক্ষরগুলো দেখিয়ে দিলে বাংলাটা অন্তত পড়তে পারত... টীচার না
আসা পর্যন্ত যদি ওদের একটু পড়িয়ে দেওয়া যায়... মানে সকালে একঘণ্টা আগে ওঠার কথা
হচ্ছিল কি না...
এ নিয়ে
অবশ্য আর বেশি ভাবিনি। দেড়-হাজারি টিউশন ছেড়ে ওসব বস্তিফস্তির মধ্যে আবার কে
ঢুকবে, পাগল নাকি!
0 কমেন্টস্:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন