বোধ
ছাদটা এত ছোট চিত্ হয়ে শুলে তার মনে হয় সে যেন পৃথিবীতে
নেই, হা হা খোলা মহাকাশে নীহারিকা পুঞ্জে ভাসছে। চারতলায় একটি ওয়ান
বি এইচ কে বাসাবাড়ি। ছেলেদের ভবিষ্যত কেরিয়ারের আগ্রাসী ভূতাহা হাঁড়িতে টাকা
ঢালতে ঢালতে আর কিছুই ভাবা যাচ্ছে না। এখন যত খরচ তত নিরাশা গুনতে হচ্ছে। আর কিছু হবে বলে মনে
হচ্ছে না। দিনের মাথায় একটিমাত্র রুমে ওরা স্বামী-স্ত্রী অবাধ। রাতে দুই ছেলে ঘরে, আর মুক্ত স্বাধীন সে এই স্কাইস্ক্র্যাপারে ইউটোপিয়ায়। কিন্তু এখানেও চরম ক্ষোভ ভূতের মতোন হণ্ট করতে থাকে। চরম অশান্তি আর
উদ্বিগ্নতা। সবচেয়ে বেশি অন্তর্দ্বন্দ্ব। তা থাক। তবুও তো রাত্রি আটটা থেকে দশটা এই আকাশ তার
নিজস্ব! এখানে ভাষা বৈষম্যতা নেই শুধুআছে বোধ অনুভব আনন্দ বিস্ময়। খালিচোখেই নক্ষত্রের কন্সটিলেশন ভেদ করে সে
চলে যায় অসীমের পথে।
অসীমের বোধ এসেছে তার বোস্টকের ক্যালকুলাস বই থেকে। অংকবই ইংরাজীতে থাক ক্ষতি নেই। সেটা বাংলাতে বুঝতে হবে এই কথাটা বেঙ্গলের
টিচার পাবলিশার কোনোমতেই ভাবতে পারছে না। ইন্টিগ্রেশন টু দি লিমিট মাইনাস ইনফিনিটি টু প্লাস
ইনফিনিটি। এই হলো বোধের অংক বা অঙ্কের বোধ। সেটার উদ্ভট বাংলায় এমন অনুবাদ যে মানে আর বোধগম্য হয় না। কেমিস্ট্রি ফিজিক্স ইংরাজিতে থাকুক কিন্তু বুঝতে হবে
মাতৃভাষায় ব্যবহারিক ভাবে।
কিন্তু ভেবে কী লাভ? বড় ছেলের
ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার খুব ইচ্ছে ছিল। কিন্তু স্কুল মাস্টারের, টিউশনি
মাস্টারের পাঠ্যপুস্তকের এমনকি রেফারেন্স বইগুলোর জবরদস্তি সায়েন্টিফিক টার্মগুলোর
তত্সম বাংলা অনুধাবন করতে করতেই তার সময় গড়িয়ে গেল। কন্সট্যান্ট বোঝে না, কারণ ধ্রুবক বুঝতে সময় লাগে। কোচিংএর বন্ধুদের
আলোচনা বুঝতে দেরি হয়। অঙ্কের বই খোলার পরে বোঝে ইন্টিগ্রেশন হলো সমাকলন। ডিফারেন্সিয়াল ক্যালকুলাস বাংলায় অন্তরকলন আবার ডিফারেন্সিয়েশন বাংলায়
ব্যবকলন পড়তে হয়। এ তো হলো বিষয়ের বাংলা। তার চেয়ে অনেক জটিল ও
ভয়ংকর সেই বিষয়ের ব্যাখ্যা ও সজ্ঞা। বড়ছেলে বাংলায় ইহা উহা টার্ম বুঝতে বুঝতে
যখন জয়েন্ট দেবার সময় হলো তখন সাধু ভাষায় পদার্থবিদ্যা রসায়নশাস্ত্র ও গণিত মাথায়
ঢুকল না। মুখস্তবিদ্যায় পারদর্শী হয়ে পাস করে বাংলা মিডিয়ামের স্কুল ছাড়ল আর আর্টস
সাবজেক্ট নিয়ে এখন কলেজে।
একটা তারা পড়া দেখতে দেখতে তার কলেজের ফিজিক্স প্রফেসরের
কথা মনে পড়ল। ডপলার ইফেক্ট পড়াচ্ছিলেন। তিনি বলছিলেন বেঙ্গলের শহরতলীর ও গ্রামের ম্যাক্সিমাম
স্কুল মানব প্রজন্মের সাইলেণ্ট কিলার। একটি স্টুডেন্টের মাথায় বিজ্ঞানভীতি ঢুকিয়ে দিয়ে তার
প্রজন্ম অন্য খাতে বইয়ে দেয়। সে যদিও পাস করে কলেজে ভর্তি হয় সে বাংলা টার্মগুলি ভুলতে
পারে না আর ইংরেজি টার্মে কনফিউসড হয়ে যায়।
ও উঠে বসল। ছাদের কার্নিশ খুব নিচু। মনে হয় একটা চৌকো
ভেলাতে চেপে মহাকাশে পাড়ি দিয়েছে সে। তারা দেখতে দেখতে তার পুরনো পড়াশোনা
পরিষ্কার যেন চোখে ভাসে। ও পড়াতে তো পারেই কিন্তু কেন যে দ্বিধা! ছোট ছেলের সাথে বড়র আজ দু’দিন হলো রা
সা নেই। খুব কথা কাটাকাটি। মারপিট। শেষে ওদের মা শুদ্ধু তাকে কোণঠাসা করে ওদের কেরিয়ার নষ্টের
জন্য দায়ী করেছে। ছোটছেলে কোদনোমতেই তার দাদার ওই রাবিশ নোটস নেবে না। হয়
কোচিং নয় নতুন বই। উঠে দাঁড়াল সে। ছাদের এক কোণে স্তুপীকৃত জমা আছে এক বস্তা নোটখাতা আর
বাংলায় রেফারেন্স বইগুলো। হিসেব মতো দু’বছরে তার পেট কেটে দু’লাখ টাকার নিরাশা। সে যাক। প্রজন্ম যখন তার, তখন সেই
প্রজন্ম ভেলার দাঁড় তো তারই হাতে! অসীমের অনুভবে অসীমের দিকেই তো তার যাত্রা! আর
এখন হাতে রয়েছে দেশলাই।
0 কমেন্টস্:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন