কালিমাটি অনলাইন

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

বুধবার, ১ নভেম্বর, ২০১৭

শুভলক্ষ্মী ঘোষ

মানুষ ও ঈশ্বর


হরিদেবপুর বাসস্ট্যান্ড থেকে কয়েক মাইল দূরে ইছামতী নদীর পূব ধার ঘেঁসে বহুকালের পুরনো মন্দির। লোকে বলে সেখানে ঈশ্বর বড় জাগ্রত... তিনি নাকি কাউকে ফেরান না!  
মন্দিরের উল্টোদিকে নদীর পাড়ে সারাদিন এক পাগল ভিখিরি বসে থাকেকিছু চায় না, কাউকে বিরক্ত করে না, চিৎকার করে না, শুধু মাঝে মধ্যে নিজের মনে কথা বলে, হাসে, আর গুন গুনিয়ে গান গায়। মানুষজন যেতে আসতে দু-দশ টাকা, ঠাকুরের ভোগ, ফল বাতাসা... যে যেমন পারে, রেখে দেয়। সে পাগল কোনোদিন খায়, কোনোদিন খায় না, কোনোদিন ফেলে ছড়িয়ে একসা করে, কোনোদিন কুকুর বেড়াল ডেকে বিলিয়ে দেয়, কখনো বা টাকা পয়সা কুড়িয়ে নদীর জলে ফেলে দিয়ে আসে... ঈশ্বর দূর থেকে দেখেন, আর বিস্মিত হন!  


সেদিন মধ্যরাত, অমাবস্যা। ঈশ্বর বিগ্রহ ছেড়ে নিঃশব্দে প্রকট হলেন। মন্দিরের সিঁড়িতে শুয়ে থাকা পাগল ভিখিরি চোখ মেলে উঠে বসল  
-         ঈশ্বর বললেন, “আমি তোমার আচরণে বড় বিস্মিত হে দরিদ্র মানব। এত দীর্ঘ বছর তুমি এ মন্দির প্রাঙ্গণে রয়েছ, কই, তোমাকে তো আমার কাছে কোনোদিন কিছু চাইতে দেখলাম না! তোমার কি কিছুরই প্রয়োজন নেই? কোন অভিলাষা নেই জীবনে? তুমি যা লাভ কর তা প্রায়শই অন্য জীবকে  দান কর অথবা পরিত্যাগ কর!... এ তোমার কেমন অভিপ্রায় ভিক্ষু?  
-         ভিক্ষু! কে রে ব্যাটা... আমাকে ভিখিরি বললি? পাগল তেড়েফুঁড়ে চোখ পাকিয়ে উঠল।
-         মৃদু হেসে ঈশ্বর বললেন, মূর্খ মানব, আমি সেই আদি অকৃত্রিম ঈশ্বর, যে এই বিশ্ব ব্রহ্মান্ডকে ধারণ ও পালন করে চলেছে যুগ যুগান্ত ধরে। আমিই  সেই সৃস্টি, স্থিতি, লয়, মানুষ চিরকাল যার স্তব করে এসেছে, যার কাছে নিজেকে উৎসর্গ করে এসেছে, যার দর্শন লাভের আশায় মানুষ হাজার হাজার বছর কঠিন তপস্যা, কঠিন সাধনা করে এসেছেআমিই শক্তি, আমিই সেই  ব্রহ্ম... বুঝেছ? এবার নিঃসংকোচে বল তুমি কী বর চাও? অমরত্ব ছাড়া  তোমায় অদেয় কিছুই নেই... বল, কী বর ভিক্ষা তোমার?  
-         বর ভিক্ষে করব? তোর কাছে? শালা, বলিস কী, হ্যাঁ! যে নিজে ভিখিরি সে আবার আমাকে ভিক্ষে দেবে কী রে? ... তোর গুমোর তো বড় কম না!  
ঈশ্বর বিস্মিত হলেন, কী বললে?... আমি?... আমি ভিক্ষুক!  
ভিখিরি হাসি সামলে বলে উঠল, ভিখিরি না তো কী! দুঃখ কষ্টে বিপদে  আপদে এত মানুষের আকুতি, তাদের চোখের জল, আর তার থকে মুক্তি চেয়ে মানুষের এই যে তোকে পুজো করা, তোকে ভক্তি করা, তোকে নিত্যি নৈবেদ্য চড়ানো... তোর এসবে লোভ নেই? এসবের ভিক্ষে চাস না তুই?
-         সংসারে এই যে এতসব না পাওয়া, এতসব ফাঁকি ঝুকি বানিয়ে রেখেছিস, এতে আমরা তোকে ভয় পাব, তোকে মানবো বলেই না!
ঈশ্বর থামলেন, কিছু অপেক্ষার পর ঈষৎ ভ্রু কুঞ্চন করে বললেন, তবু তুমি প্রার্থনা কর মানুষ, আমি তোমার কাছে অঙ্গীকারবদ্ধ।
সে পাগল তখন খানিক মাথা চুলকে বিড় বিড় করে বলে উঠল, এ তো বড়  জ্বালা দেখছি, বর না দিয়ে ছাড়বে না! আচ্ছা বেশ, তবে বর দে দিকি... হাজার দুঃখকষ্ট, হাজার রোগ জ্বালা, পেটের খিদে, ঝড়-জল, বন্যা, খরা, মহামারী, কোনো কিছুতেই মানুষ যেন তোর কাছে কিছু চাইতে না আসে,  তোর পায়ে মাথা না কোটে, মনেও যেন না আসে তোর কথা। মানুষ আজ থেকে যা করবে সব নিজের জোরে করবে, নিজের উপর বিশ্বাসে করবে, নিজের সৎ বিবেক-বুদ্ধিতে করবে... দে দিকি কেমন বর দিতে পারিস... দেখি তোর কত বড় মন... কত বড় খ্যামতা!
-         মুর্খ, তুচ্ছ মানব, আমি তোকে তোর নিজের জন্য বর প্রার্থনা করতে বলেছিলাম, গোটা মানব জাতীর জন্য নয়! অপগন্ড, অপদার্থ, অর্বাচীন... এই বর চেয়ে তুই তোর জীবনের শ্রেষ্ঠ সুযোগ হারালি! থাক তুই এমন ভিখিরি হয়ে। একরাশ অস্বস্তি নিয়ে ক্রুদ্ধ, বিরক্ত ঈশ্বর, অদৃশ্য হলেন।

পাগল ভিখিরি রাতের অন্ধকারে হো হো করে হেসে উঠল    

0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন