কালিমাটি অনলাইন

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

শনিবার, ২২ জুলাই, ২০১৭

সুমী সিকানদার

মম মন উপবনে  

সকাল থেকেই এই মেঘলা দিনে একলা অবস্থা পাতার সবুজ রঙ যেন ঘষে ঘষে তুলে ফেলবে এভাবে বৃষ্টি ঝরছেপাতার গায়ে যে কতবার সবুজ প্রলেপ দেয়া আছে তা তো আর নবধারা জলেরা জানে না একটানা চৌরাশিয়া বাঁশীর জলশব্দে, নতুন পাতাদের কোরাস কমে না। তারা  শরীর ঝাঁকিয়ে ঝঁকিয়ে মম চিত্ত করে

বাইরের এই রিমিকিঝিমিকি দেখে বাণী কিছু চিন্তিত। আজ সে কিছুতেই একলা  থাকবে না বলে বেড়িয়ে পরেছে। বৃষ্টির সাথে অশান্ত বাতাস তাকে পুরনো প্রণয়ের মতো জড়িয়ে থাকে। একাকার  ভিজে চুপসে নিভাদের বাড়ি পৌছতে পৌছতে প্রায় দুপুর  

কলিংবেল  বাজাতেই খুলে গেল স্কুলের বড় লোহার গেট, ক্লাসরুম আর যেন ডাস্টার হাতে দৌড়াতে দৌড়াতে এলো দুইবেণী  নিভা।
তুই এখনো দুই বেণী করিস নাকি রে?’  বাণী হাসছে।
নিভা সব ভঙ্গেচুরে দৌড়ে এসে জড়িয়ে ধরেছে বাণীকে।
আরে ছেড়ে  দে বাপ, আমি ভিজে শেষ 
নিভা তো আর বাণীকে ছাড়ে নাকুলুকুলু নদীর স্রোতের আছড়ে পড়া উচাটন দুজনের মন এক সময় শান্তশ্রী হয়ে যায়।

কাপড় বদলে আরামে বসলো বাণী এক দফা কফি পাকোড়া সাঁটানো শেষ।
সিগারেট টানতে টানতে সরু চোখে তাকাচ্ছে নিভা

‘কি রে
, কায়েসের সাথে কথা বলবি?
তুই যখন চাচ্ছিস চল বলি। তবে দয়া করে তুই সাথে থাক বাপ!’
হাসি মুখে নাক দিয়ে সুর সুর করে ধোঁয়া ছাড়ছে নিভা। চেইন স্মোকার সে এতকাল পর দেখা করতে এসে চমকেছে বাণী সিগারেট কেন ধরেছিস নিভা?  খুব স্মার্ট তাই না?

শান্ত মতো নিভা কারো সাতে পাঁচে ছিলো নাপড়া না পারাটাই তার নিয়ম হাইবেঞ্চের উপর নিজেই  সটান দাঁড়িয়ে যেতযেন এটা খেলা। নাকের ভিতরে পলিপ থাকাতে সে মুখ বেশিক্ষণ বন্ধ রাখতে পারতো নাআলগোছে হাঁ হয়ে  যেত। ক্লাসে সবাই তাকে  নিয়ে কী হাসাহাসি! নিভা অনেকদিন পর বলেছিলো   সবাই হাসলে তার মনে লাগতো না। আমি হাসলে খুব কান্না পেত তার।

দিনে
দিনে খুব ভাব জমে ক্ষীর। বিকেলে বৌচি গোল্লাছুট একসাথে কখনও বাইরের খেলা বাদ দিয়ে ঘরে লুডু নিয়ে হট্টগোলসাপগুলো খালি নিভাকে কামড়ে রেখে দিতো। বেচারা দু;খ পেতো। জগতের সবগুলো সাপ কেন যেন নিভাকেই গিলতে আসতো তখনই।

বারে বারে ফিরে ফিরে পুরনো দেখার মধ্যেও এক প্রেম আছে। নিভার সারা ঘরবাড়ি, মেয়ে, বইখাতা, কাপড় চোপড় সব গড়ানো মার্বেলের মতো  এলোমেলো আগোছালো। মনে হচ্ছে উঠে গিয়ে কিছু গুছিয়ে দিই। কিন্তু সব বাদ দিয়ে মুগ্ধ আমি নিভাকেই দেখছি

একঘন্টা ধরে হাঁ করে আমার দিকে তাকিয়ে আছিস কেন বাণী?’
আমি চোখ ফেরাতে পারছি না তো! তুই কীভাবে এত সুন্দর হয়ে গেলি! প্রেমে পড়লে মানুষ এত সুন্দর হয়?

হো
হো হাসতে থাকে আর মুখ দিয়ে ধোঁয়ার রিং ছাড়তে থাকে সে। ‘প্রেম না রে। সব আলগা। ইনবক্সে একসাথে কতজনের সাথে চালানো যায় জানিস?আমি চুপ। আমার চুল ঘেঁটে দিচ্ছে নিভা। সব বাদ দিয়ে তোকেই চিনেছি মনে হচ্ছে তোকেই পেসমেকার বানিয়ে বুকে চালান করে দিই!’   

খেরো খাতার হিসেব মেলেনি তার। স্টেশনে অপেক্ষা করে করে মাঝরাত। শেষ ট্রেনটাও ছেড়ে গেছে। সে কার এবং কিসের আশায় যেন মাঝরাত অব্দি এখানেই বসে আছে। পরে  ভাইরা খুঁজতে খুঁজতে নেশাধরা বোনকে পেয়ে বাসায় ফেরত নিয়ে গেছে।

বিকেলে দুজনে বারান্দায় বসে  ডুবন্ত সূর্যের গ্রাফিক্স দেখছি। আমার হাত নিজের হাতে নিয়ে আঙ্গুলের ভেতরে আঙ্গুলে গুঁজে দেয়া নিভার পুরনো অভ্যাস। সারাদিনের উচ্ছলতা ম্লান। সে আমার চোখে তাকিয়ে প্রশ্ন করে, আমি অন্য পাশে ফিরে থাকিকো প্রশ্নের জবাব খুঁজে ফিরি নিজেই জানি না।

ব্যাকুলতাই যে খসড়া প্রেম।  আমার কাঁধে মাথা রেখে সে অঝোরে কাঁদতে  থাকে। আমি থামাই না। সে রাতেই জোর করে বিয়ে দেয়া হয়েছিলো প্রেমিকের  সাথেই। সন্তানের কারণে নিভা এই বিয়ে করেছে। পুরনো প্রেম স্টেশনেই জং ধরে গেছেআর ফেরৎ আসেনি।

বাড়ি যাবার সময় সিড়ি দিয়ে নামতে নামতে ভেতর থেকে নিভার গলার আওয়াজ পায় বাণীনয় নয় এ মধুর খেলা, তোমার আমার সারাজীবন সকাল সন্ধ্যাবেলা
বাচ্চাদের গান শেখাচ্ছে সেআহা কী মিঠেল কোলাহল! এই গানেই তো শুরু  হওয়া চাই। এই সুযোগে বুকের বেসুরগুলো বিনা শর্তে মিলিয়ে যাক। প্রতারণা এক খারাপ সময়ের দলা মোচড়া কাগজ, যাকে সময়েই কুঁচি কুঁচি ছিঁড়ে ফেলা দরকার ছিলো।


4 কমেন্টস্:

  1. ভালোলাগা রেখে গেলাম, নিভার জন্যে।

    উত্তরমুছুন
  2. ঠিক, শেষের সেদিন অনেক আগেই শেষ করা যেত যদিও তা ভয়ঙ্কর বটেই

    উত্তরমুছুন
  3. আলো-আঁধারির ছবিকথা। খুব সুন্দর।
    শ্রাবণী দাশগুপ্ত।

    উত্তরমুছুন