কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

শনিবার, ২২ জুলাই, ২০১৭

রঞ্জনা ব্যানার্জী

শ্যামা  


ড্রইংরুমের মেঝেতে উবু হয়ে বসে বমি করছে শ্যামাচরণবাবুয়া কিংবা ম্যাডাম কিছু বলছে। আকরামকে ডাকছে সম্ভবত। শ্যামাচরণ কিছুই শুনতে পাচ্ছে না। ওর পৃথিবীটা দুলছে অবিরাম। এতদিনের চুপকথারা বোলতা হয়ে হুল ফোটাচ্ছে। 

সেই কবে মাইটানা বয়েসে মায়ের কোলে চড়ে ঢুকেছিলো এ বাড়িতে! বড় বড় চোখের শ্যামাকে সবার তখন কৃষ্ণঠাকুরের মতোই লাগতোএকটু বড় হতেই  কৃষ্ণতে রাধার খোঁজ শুরু হয়ে গিয়েছিলোআর ওর জীবনটাও পাল্টাতে শুরু করেছিল    

বিশ মিনিট আগেও আজকের দিনটা রোজকার দিনের মতোই ছিলরান্নাঘরে বাবুয়া  আর বাবুয়ার সেই বন্ধুর জন্যে পাকোড়া ভাজছিল শ্যামাচরণ তারও আগে স্নান-সন্ধ্যা সেরে দোতলায় গৃহলক্ষ্মীকে ফুল দিতে গেলে ম্যাডাম জানিয়েছিল, বুয়ার জ্বর  বুয়া না এলে সকালের ব্রেকফাস্ট বানানোর ভার শ্যামাচরণের দুপুর-রাতের রান্না করে মিনতির মা। সে আসবে আরও বেলা করে। বাবুয়া অফিস যাবেটোস্ট আর ডিমের ওমলেট টেবিলে লাগাতে হবে পনেরো মিনিটের মধ্যেমনে মনে বুয়াকে শক্ত গাল পেড়েছিল শ্যামাচরণ কাল ছাদের কোণে আকরামের সাথে ফষ্টিনষ্টি করছিল আর আজ জ্বর!  

ম্যাডামের সাথে কথা বলেই জামা পাল্টাতে এসেছিল নিজের ঘরেগেটের আওয়াজে জানালার কাছে উঁকি দিয়েছিলআকরাম কথা বলছিল কারো সাথে। দেখতে পায়নি চেহারা। ওপরের টিভিতে তখন কেউ গাইছিল, ‘অপার হয়ে বসে আছি-ই’মিনিট খানেক পরেই জানালা জুড়ে আকরামের মুখ, ‘ম্যাডাম ডাকে’।  তারপরেই, ‘সাঁইয়া দিল মে আনা রে, আ কি ফির না যানা রে---’ গাইতে গাইতে চোখ টিপেছিলশুয়োর! মনে মনে খিস্তি করেছিল শ্যামা।  

রান্নাঘরে ঢুকেই জানলো অতিথি দুপুরে খেয়ে যাবেনপাবদা মাছ আর খাসীর মাংস ফ্রিজ থেকে বার করতে করতে ম্যাডাম বললেন, ‘টোস্ট আর ওমলেট সাথে ক’টা  ফুলকপির পাকোড়া ভেজে দাও’এই সক্কালে পাকোড়া? এদের কখন কী যে ইচ্ছে হয়! ‘টেবিলে নয় ট্রলিতে সাজিয়ে ড্রইংরুমে নিয়ে এসো’

মিনিট কুড়ি পরে ট্রলি ঠেলে ড্রইং রুমে পা দিতেই, ‘পল্লব চিনেছিস?’ নামটা শুনেই শ্যামাচরণ শক্ত হয়ে গিয়েছিল‘ও মাই গড হি ইজ স্টিল হিয়ার!’ এরপর ঘর কাঁপিয়ে সে কী হাসি! শ্যামাচরণের চোখের সামনে নিমেষে জেগে উঠেছিল পনের বছর আগের সেই দুপুর!  

বৌদিমণি আর দাদা পিকনিকে। কক্সবাজারেঘর ভর্তি বন্ধু নিয়ে এসেছিল বাবুয়া শ্যামাচরণকে হঠাৎ তলব। ঘরে ঢুকতেই আট ন’জন মিলে চেপে ধরেছিল। পল্লব সবার আগে চড়েছিল, ‘কাম অন শ্যামা কাকা বি এ স্পোর্ট!’ শ্যামাচরণ অবাক হয়ে দেখছিল বাবুয়াকে। এই বাবুয়াকে পিঠে নিয়ে কতবার ঘোড়া হয়ে হাঁটুর চামড়া খসিয়েছে শ্যামা! হাতের ওপরে লাটিম ঘোরানোর কায়দা শেখাতে দুপুর পার করেছে।  রামায়ণের গল্প শুনিয়েছে সিঁড়িঘরে ওর ছোট খাটটাতে বসে। সে বাবুয়া  কীভাবে নির্বিকার ভিডিও করছে ওর বন্ধুদের কামক্রিয়া!  

সাতদিন অসহ্য যন্ত্রণায় শ্যামাচরণ তলিয়েছে, জেগেছেবাবুয়া পালিয়েছিল বন্ধুর বাড়িতে। সাতদিন পরে চোখ খুলে দেখে বৌদিমণি হাত জোড় করে দাঁড়িয়ে, ‘মাফ করে দে শ্যামা!’ চোখ ভরে গিয়েছিল জলেছি ছি বৌদিমণি! বাবুয়ার বাবা থোক টাকা দিয়ে হুকুম করেছিলেন, ‘খবরদার কাউকে বলবি না’ ঠিক বড়বাবুর মতো!  ন’বছর বয়সে বড়বাবু একটাকা পঁচিশ পয়সায় কিনেছিলেন চুপকথা আর চব্বিশে তাঁর ছেলে নোটের বান্ডিলেবাবুয়াকে দার্জিলিঙে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল 

দু’হাতে মাথা চেপে মেঝেতে ধপ্‌ করে বসে পড়ে শ্যামাপৃথিবী দুলছেবুড়ো বড়বাবুর ডাক কানের ভেতরে আছড়ে পড়ছে, ‘শ্যামা কোমরটা একটু মেজে দিয়ে যা তো!’  উঠোনে মার্বেল ছড়িয়ে একা একাই খেলছিল ন’বছরের শ্যামাভরদুপুর।  সারা বাড়ি ঝিমিয়েকেবল বড়বাবু বারান্দায় গড়গড়া টানছেন। মার্বেল ঠুকে গর্তে ফেলে একা একাই উল্লাসে মাতছিল শ্যামাহঠাৎ ডাক! কোমর থেকে ক্রমশ কুচকির কাছে তারপরে আরও গহীনে বড়বাবু নিজেই হাতে হাত রেখে ওকে শরীরের গলি ঘুপচিতে ঘোরাচ্ছিলেন ভয়ে ওর গলা শুকিয়ে গিয়েছিলমিনিট পনেরো পরে যখন ছাড়লেন, একটাকা পঁচিশ পয়সা গুঁজে দিয়েছিলেন হাতে, ‘খবরদার  কাউকে বলবি না!’ একটাকা পঁচিশ পয়সা! গলির মোড়ে খয়েরি হিমহিম  কাঠিতে গাঁথা আইসক্রিম! মুখে পুরলেই স্বর্গ! কাউকে বলেনি শ্যামা।  

বৌদিমণি ক্যান্সারে ভুগে দেহ রাখলেন। আর বাবুয়ার বাবা হঠাৎ এক ভোরে বুকে ব্যথা নিয়ে চলে গেলেন ওপারে। বাবাকে পুড়িয়ে শ্মশান থেকে ফিরে বাবুয়া শ্যামাচরণের কাঁধে মাথা রেখে বুক ভেঙে কেঁদেছিল। আর সাথে সাথেই বাবুয়ার ওপর থেকে সব ক্ষোভ উবে গিয়েছিল শ্যামার

ম্যাডামের সাত মাস চলছেদু’মাস পরেই নতুন মালিক আসবে পৃথিবীতেপেট ঘেঁটে সব বেরিয়ে আসে শ্যামারম্যাডাম আঁতকে ওঠেন ‘ডিসগাস্টিং’! শ্যামাচরণ উবু হয়ে বমি করতেই থাকে।  
   



6 কমেন্টস্: