কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

শনিবার, ২২ জুলাই, ২০১৭

সুবীর সরকার

উত্তরকথা




(২২)


এত এত হাট। চারপাশে ছড়ানো। যেন হাটের ভুগোল পরিধিতে হাটগঞ্জ হয়েই মিশে যাওয়া। উত্তরের অনাবিল সব ধুলোমাখা মানুষের যাপনের কী যেন মাদকভরা এক গন্ধ আছে, যার টান চুম্বকের মতন! নাসিরুদ্দিন ব্যাপারী গজেন বর্মণ বান্ধে ওরাও হীরামতি নার্জিনারী আব্রাহাম রাভা সব কেমন মিলেমিশে এক মহাসম্মেলনের ধরতাইটা পোক্ত করে ফেলে। আর ভাঙ্গা হাটের ভিতর আপনমনে চলতে থাকে বুঝি আত্মপরিচয়ের শেকড় খোঁজার আপ্রাণ প্রয়াসআর তপ্ত দুপুরে,  হাটের জামাত থেকে কারা যেন গুনগুন গাইতে থাকে গান-

 ‘ওরে হাটের মধ্যে শামুকতলা
 হালুয়া গরুর নাগছে মেলা
 ছেউটি গরুর ও রে নেখায় জোকায় নাই
 মেচ গারো সাঁওতাল
 নাগেয়া দিল কাউটাল
 এগিলা কথা মোটেও বোঝে না’

এভাবেই তো কালখন্ডগুলিকে কালানুক্রমের ভেতরে কেবল ঢুকে পড়তে হয়। অথচ কোথাও জায়মানতা থাকে কি? নদী টপকে চলে যাওয়া থাকে কি?





(২৩)


উত্তরকথা শেষ হয়ে যাচ্ছে। আসলে শেষ বলে কিছু হয় না। গল্প কখনো ফুরোয় না। সমাপ্তি থেকে আবার জেগে ওঠে। এটাই আবহমানের ইতিহাস। তো আমরা দেখি, রাধাকান্ত ও কইকান্ত হন্তদন্ত মরিচহাটির দিকে হেঁটে যাচ্ছে। আকাশের মেঘ থরে থরে সাজানো এক বিভ্রম মেলে দিয়ে তাদের বুঝি গোপন এক ভুলভুলাইয়ার ফাঁদে ফেলে দিতে চাইছে। কোথাও হরিবাড়ি থাকে। কীর্তনের আসরে মনোশিক্ষার গানে গানে জীবন ভরিয়ে নেয়ার অবকাশ থাকে। জীবনের ফাঁকে ফাঁকে জীবনকেই জীবনযাপনের ব্যাপ্ততায় লীন করে দেয়াই বুঝি বা! এখানেই তো মানুষের জয়! মানুষ তো বুঝতে পারে, শেষাবোধি-

 ‘একবার হরি বল মন রসনা
 মানব দেহাটার গইরব কৈর না
 মানব দেহা ভাই মাটির ভান্ড
 পড়িলে হবে রে খন্ড খন্ড
 ভাঙ্গিলে দেহা আর জোড়া নেবে না’

রাধাকান্ত আর কইকান্তর চোখে জলের ধারা। কোথায় পড়ে থাকে টাকাপয়সা! ধান-পাট-তামাকের হিসাবকিতাব। তারা পরস্পরকে আমূল জড়িয়ে ধরে আর কান্নার  দমকে দমকে কাঁপতে থাকে। আর গানবাড়ির থেকে রাতের কালোর দিকে ছুটে চলে গান-

 ‘দিনে দিনে খসিয়া পড়িবে রঙ্গিলা দালানের মাটি
 ও গোসাইজি, কোন রঙ্গে’...





(২৪)


জীবন অনন্ত। জীবন বহমান। নদীটদি মেঘহাওয়া গাননাচের বহুস্বরিক ক্যানভাসে  সব আঁকা থাকে। সোমেশ্বরীর পাঁকঘর থেকে মুসুরির ডালের গন্ধ আর প্রাচীনা আবোর মজা গুয়ার মিশ্রণে উত্তরের বিলপুকুরের হাঁসগুলি তাদের চলাচলের ভেতর দিয়ে আবহমানের সব গল্পকথকতাগুলিকেই হাহাকারের মতন সাজিয়ে দিতে থাকে, একধরনের বাধ্যতায়ই হয়তো উত্তরকথার খুব খুব ভেতরেই। তখন খুব মনে পড়ে যায়, জলে গা ডোবানো সারি সারি মহিষদের কথা, মইষাল বন্ধুর গানের কথা-

 ‘মইষ চড়ান মোর মইষাল বন্ধুরে
 কোন বা চরের মাঝে
 এল্যা কেনে তোর ঘান্টির বাইজন
 না শোনং মুই কানে’

তখন উত্তরের হাওয়ায় হাওয়ায় নতুন করেই বুঝি উত্তরকথা রচিত হতে থাকে।
















0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন