কালিমাটি অনলাইন

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

শনিবার, ২২ জুলাই, ২০১৭

তমাল রায়

পার্ল হারবারে একা সুজন


ধ্রুপদী নৃত্যের যেমন আলো-ছায়া ঘোর, সেভাবেই আলো এসে পড়ে রেলিঙগুলো কেউ ভরতনাট্যম, কেউ উদ্বাহু মল্লিকা সারাভাই ট্রেন যাওয়া বা আসার মাঝে যা কিছু প্ল্যাটফর্ম অনন্ত শূন্যের অধিবাস যে প্ল্যাটফর্মগুলো ট্রেন পায় না, যে মানুষগুলো প্রেম পায় না, তাদেরই কেউ... যেমন সুজন 

তবু আনন্দও তো কিছু কম পড়ে নেই, যেভাবে স্পর্শ জমায় অন্ধ, নয়া পয়সা কুড়াও  কুড়াতে  কুড়াতে  ভিক্ষুক যেভাবে একদিন... একদিন গাছগুলো বৃক্ষ হয়ে ওঠে, অথবা ওঠে না, অপেক্ষা দীর্ঘতর... আকাশ অনেকটা চারিয়ে গেলে নীল হয়ে যায়, নীল মানে দু:! বিষাদবিন্দু ছুঁয়ে ঝরে পড়ছে রক্ত নীরব অশ্রুর গায়ে কখনও ডানা লাগে  কখনও মুক্তো হয়ে ওঠে সুজন মুক্তোকে চেনে  মুক্তোও সুজনকে চিনত, যেভাবে বোধ চেনে মন অথবা শরীর শরীরকে অথবা অন্যকিছুই... চেনা ব্যাপারটা আসলে আপেক্ষিক কিন্তু এখনমুক্তো চেনে সুজনকে! যখন মুক্তো খাবার সাজিয়ে দিত টেবিলে, তেমন কিছুই নয় রুটি আর আলুভাজা, সুজনের  গলায় গান আসতো গুনগুন খেতে দেওয়াও এক আত্মীয়তা ঈশ্বরের পৃথিবীতে যে খায়, যে খাওয়ায় এ দুইই ঈশ্বরের সেবা আত্মীয়তা যেভাবে গড়ে ওঠে...  নিয়তিই কি তবে নিয়ন্ত্রক! মুক্তো জলে ফিনাইল মিশিয়ে ধুয়ে দিত  মদের গন্ধ ভরা,বমি করে ভাসানো ঘর ঝাঁট দিত, জামা কাচা...  কাচাকাচিও  একটি সামাজিক সাফাই অভিযান নয় কিমা মারা যাবার পর আর কেউ আসে না বাউন্ডুলে, নেশাগ্রস্ত বালের কবির বাড়িতে সুজনবালের কবিনামেই তাচ্ছিল্য করে নিজেকে যার কবিতা কেউ পড়ে না, প্রকাশ্যের আলো দেখার আগেই ডিলিট হয়ে যায় এন্ড্রয়েডের  নোটস থেকে সে আবার কবি কি করে হয়! বাথরুমে মুক্তো জামা কাচলে কেমন যেন শিউরে উঠতো শুয়ে থাকা সুজন শরীরেরও কি আলাপ থেকে ঝালায় পৌঁছে কিছু রামধনু বিচ্ছুরণ!  রাত কেচে ভোর আসত, যেমন আসে আলো ফুটতো বেদানার মতো আলো ঠিকরে পড়ত বাইরের দুনিয়ায় আলো ফোটার কত রকম  মানে যেমন সুজনের কাছে  -  দরজা খট খট মুক্তোর ডাক ভেসে আসা -  ‘সুজোন ও সুজোওওওন...’  বছর পঁয়ত্রিশের মুক্তোর মুখে বসন্তের দাগ, কপালের পাশে কাটা দাগ একটা সারা মুখে ঘামতেল চকচক, আঁটো করে বাঁধা খোঁপা বয়সে মুক্তো হয়তো বছর তিনের বড়ই হবে সুজনের থেকে তবু তো নো ম্যানস  ল্যান্ডে মানুষের গন্ধ মুক্তো আসলে বারান্দার রেলিঙ ছুঁতো অলৌকিক আলোছায়া, সুজনের জাহাজ ভাসত মুক্তোর সাগরে... মুক্তো আসতো, ভাসত, ঢেউ সরে গেলে পড়ে থাকে ঝিনুক, ঝিনুকে মুক্তো, মুক্তোর মুখে হাসি, এবার ধেবড়ে যাওয়া সিঁদুর ঠিক করবে মুক্তো  সুজনের চুল আঁচড়ে দেবে, সুজন উদোম হয়ে বসে থাকবে, অবোধ শিশুর মতো  মুক্তো বিছানা থেকে উঠতে চাইলে সুজন টেনে ধরবে  শাড়ি মুক্তো আসতো, এখন আর আসে না

তাই হয়তো আলো-ছায়ামাখা লাইনে চড়ে সুজন রওয়ানা দেয় ক্যানিং... ভোরের ঝি লোকালে চড়ে যেভাবে রোজ মুক্তো আসতো সুজনের কাছে ওইদিকে, মুক্তোর বাড়ি ওইদিকেই... বাড়ি মানে একটা স্থান যেখানে সন্ধ্যের পর ফিরে আসে কেউ কেউ যেমন পাখি সুজন বাড়ি ফেরে না বাড়ি কই? ইঁট কাঠ পাথর - বাড়ি? হুঁ, বাড়ি বাসা নয় বাসায় ভালোর স্পর্শ মিশলে  ভালোবাসার বাতিসম্ভ, জাহাজের ভোঁ বাজছে সুজন একক যেমন স্টেশনের বড় ঘড়িটার ওপর বসা শালিখটা শালিখ এদিক ওদিক চায় সুজনও তাকায়... শালিখ কি কাউকে খোঁজে ? সুজন মিস করে  কাচাকুচির শব্দ, জল পড়ার শব্দ  কলঘরে ঝাঁট দেওয়ার শব্দ সাফাই অভিযানের যা অবশ্যম্ভাবী অঙ্গ কিন্তু মুক্তো কই?... ওই যে ওই দিকে মুক্তোর বাড়ি দুপুর যেখানে বিকেলের হাত ধরছে, কিছু ছায়া... কিন্তু  মুক্তো কই?  বাতাস হারানো উষ্ণতা... সময়ে শাম্মী কাপুরের মতো জ্বর আসে সুজনের 'কাহে  মুঝে কাহে জঙলী কাহে...' বিকেল  আসছে ক্যানভাসে... খালি প্ল্যাটফর্ম জুড়ে একটাই সুজন, একটাই বিকেল রাত্রি হয়ে যাবার আগে থমকে গেছে!  মা মারা যাবার পর, মুক্তোই... থালা, বাসন, ভাত ডাল, উচ্ছে তেঁতো দুপুরগুলো বিকেল ছোঁবার আগে  কী করে যেন আঁশটে, শরীরি অথচ আকাশ... মেলে দিত, পাখির মতো...
বিকেলের বারান্দা জানে হয়ত বা, মুক্তো কোথায়, অথবা একটা ক্যানিং লোকাল আতরগন্ধী ঘুম ছড়িয়ে দিচ্ছে, বিকেল, না'কি মুক্তো? 

মুক্তো ওই দিকে থাকে বিকেলের  নৃত্যশৈলীতে আপাতত ভরত নাট্যম খেলছে খালি কামরাগুলো জনে জনে প্রশ্ন করায় উত্তর এসেছে হাসিতে, অবজ্ঞায় - ওই দিকে মুক্তোর বাড়ি সন্ধ্যের আঁশফল জন্ম নিক তারপর...

একটা বোতাম, অথবা ঝিনুক পথ নির্মাণ করছে... ঝিনুক ফেটে যেভাবে মুক্তো মুক্তো কোথায়? অশ্রুর বিবর্তনবাদ হয়তো বা মুক্তো মেলায়...
আপাতত সুজন পা বাড়ালো, মুক্তোকে খুব, খুউব দরকার
কে জানে কেন চোখ বেয়ে জল নামছে
মুক্তো কি ওইদিকেই থাকে?


0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন