প্যাসেঞ্জার
এরকম প্রাসাদোপম এয়ারপোর্ট নন্দিনী তার এই আটত্রিশ বছরের
ইউরোপ–আমেরিকা বেড়ানো জীবনে খুব কমই দেখেছে। বিশাল আর্চের এন্ট্র্যান্স। ঢুকতেই
মার্বেলের ঝকঝকে পরিষ্কার ফ্লোর, বড় বড় গ্র্যানাইটের পিলার... আধুনিক স্কাল্পচার
আর পেইন্টিং দিয়ে মেইন লবি সাজানো... চতুর্দিকে প্লাসমা টিভির ছড়াছড়ি... স্পিকারে
নানা রকম অ্যানাউন্সমেন্ট চলছে... কোথাও ছিটেফোঁটা ধুলো-ময়লা নেই। প্যাসেঞ্জাররা
এদিক ওদিক বিভিন্ন কাউন্টার’এর সামনে দাঁড়িয়ে। প্রয়োজনের অতিরিক্ত কথা বলছেন না
কেউই। ব্যবস্থাপনা খুব’ই সুষ্ঠু।
ঢোকামাত্র একজন সুবেশা হাস্যমুখী তরুণী, নন্দিনীকে হাত ধরে
একটা ছোট লাইনে দাঁড় করিয়ে দিল। সিনিয়র সিটিজেন আর বাচ্চাদের জন্য ওদিকে দূরে আলাদা লাইন। নন্দিনী’র একটু অস্বস্তি হচ্ছিল। কী
ব্যাপার! বয়স অনুযায়ী যদি হয় তাহলে ওই বড় লাইনটায় নয় কেন?... ওখানেই তো মোটামুটি
মাঝবয়েসী প্যাসেঞ্জাররা সবাই দাঁড়িয়ে রয়েছেন...
-
আচ্ছা,
এক্সক্যিউজ মি... আপনাদের কোথাও ভুল হচ্ছে না তো? আমার মনে হয় আমার ওই বড় লাইনটায়
দাঁড়ানো উচিত ছিল। আপনারা তো এজ গ্রুপ ভাগ করে দিয়েছেন দেখছি...
-
না না
ম্যাডাম, আপনি ঠিক জায়গাতেই রয়েছেন, এটাই আপনার কিউ।
-
আর ইউ শিওর?
-
একদম। স্মিত
হেসে কাউণ্টারের ভদ্রমহিলা বললেন।
-
আপনাকে উইন্ডো
সীট দেব না আইল?
-
উইন্ডো প্লিজ!
আচ্ছা... এক মিনিট... আমি না একটু কনফ্যিউসড। আমি ঠিক কোথায় যাচ্ছি বলুন তো? কিছুই
বুঝতে পারছি না... আর আমার ফ্যামিলি কোথায়? আমার হাসবেন্ড, ছেলে?
-
আপনার
হাসবেন্ড আর ছেলে বাইরে রয়েছেন। ওনারা আপনার সাথে যাচ্ছেন না। আচ্ছা আপনার ভেজ মিল
অর নন-ভেজ?
-
দাঁড়ান
দাঁড়ান... যাচ্ছেন না মানে? আমি একা যাচ্ছি নাকি?... কী আশ্চর্য... কোথায়?
-
ম্যাডাম,
আমাদের কাছে থাকা ইনফরমেশন অনুযায়ী আপনি একার টিকিটই বুক করেছেন।
-
না, না...
বুঝলাম না!
-
ম্যাম, আপনি
গত সোমবার একটা ট্রিপ ফাইনালাইজ করেছেন। টিকিট, মোড অফ জার্নি, লাগেজ, স্টে এ সব কিছুতেই আপনি
স্পষ্ট জানিয়েছেন যে আপনি একাই ট্র্যাভেল করতে চান।
-
কিন্তু... কিন্তু
... আমি আমার ফ্যামিলি, আমার ছেলেকে ছেড়ে কোনোদিনও কোথাও যাই নি... এটা কীভাবে সম্ভব হলো... এটা
কীভাবে হতে পারে! আচ্ছা, আচ্ছা যাইহোক শুনুন, আমি আমার ফ্যামিলি’র সাথে দেখা করতে
চাই। ওনাদের ডাকুন... কোথায় আছেন? এয়ারপোর্টের বাইরে? আমি এক্ষুনি যাব। এক্সিট কোনদিকে?
-
সেটা সম্ভব নয়।
-
মানে?
-
ধৈর্য ধরুন, একটু পরেই বুঝতে
পারবেন... বাই দি ওয়ে, আপনি এবার সিক্যুরিটি চেক-এর জন্য ওই প্যাসেজ দিয়ে এগিয়ে
যেতে পারেন।
-
আমি কোত্থাও
যাচ্ছি না। আমার ফ্যামিলিকে ডাকুন। আমি ফিরে যাব।
-
আপনার
ফ্যামিলি কী করছেন আপনি স্ক্রীন নাম্বার ৭৭৮’এ দেখতে পাবেন... দেখে নিন... কিন্তু এই মুহূর্তে ওনাদের সাথে
আপনার কথা বলাতে পারব না। দুঃখিত।
-
কী অদ্ভুত
কথা? কই, কোথায় স্ক্রীন? ওহ, হ্যাঁ... ওই তো... ওই তো অনির্বাণ, চেয়ারে বসে আছে।
সাথে কে? ওর বন্ধু শুভজিত না? হ্যাঁ ওই তো সৌগত, দেবায়ন, অমিত সবাই আছে। বড়মাসি আর
মেসোও তো রয়েছেন দেখছি! আরে, মধুরা,
অনিন্দিতা... ওরাও এসেছে! গোগোল কই, গোগোল!
স্ক্রীন সরে গেল আপনা আপনি। দু’বছরের ঝাঁকড়া চুল, ফর্সা হলুদ ডাংরি পরা গোগোল মামা-দাদু’র সাথে একমনে চিপস আর ফ্রুটি
খাচ্ছে।
-
গোগোল!
গোগোওওল... এই যে সোনা... এই যে মা... তাকা... এদিকে তাকা... অনির্বাণ... অনির্বাআআণ...! মাসিমণি
তোমরা শুনতে পাচ্ছ?
-
আপনি অযথা
চ্যাঁচাচ্ছেন কেন? প্লীজ কোওপরেট।
-
শুনুন, আমি
আপনাকে শেষ বারের মতো সাবধান করছি। আমি বার বার জানিয়েছি আপনাকে, যে আমি ফিরে যাব,
আমার কোথাও যাওয়ার নেই। আমি আমার পরিবারের
কাছে ফিরতে চাই। এবং সেটা এক্ষুনি... এই মুহূর্তে... রাইট নাউ।
-
ম্যাডাম,
আপনার এটা আগে ভাবা উচিত ছিল তাহলে! এই ট্র্যাভেল প্ল্যান আপনি নিজে করেছেন। এখন আর
তো সেটা ক্যান্সেল করা যাবে না! তাছাড়া আপনার টিকিট ট্রান্সফারেবল’ও
নয়।
-
নাকি! আচ্ছা, আচ্ছা... ওকে... শুনুন... ধরে নিন
আমি ভুল করেছি। একটা মারাত্মক ভুল। একটা হঠাৎ করে নেওয়া সিদ্ধান্ত... ঠিক আছে? আমি
স্বীকার করছি সেটা। আপনারা টাকা কেটে নিন। আমার কোনো রিফান্ড চাই না। কিন্তু এখন
আমি বাড়ি ফিরব। প্লীজ! প্লীইইইজ আমাকে এক্সিটটা কোন দিকে দেখিয়ে দিন!
****
- বেড নাম্বার থার্টি এইট… নন্দিনী চ্যাটার্জি’র বাড়ির লোক কে আছেন?
- এই যে... এই যে ডক্টর... আমরা...
- হাতের শিরা কেটে মিসেস চ্যাটার্জির অনেকটা ব্লাড লস হয়ে
গিয়েছে... পেশেন্ট ক্রিটিক্যাল... চব্বিশ ঘণ্টা না গেলে কিছু বলা যাচ্ছে না...
0 কমেন্টস্:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন