হেরম্বচরিত
হেলাপাকড়ি
সময়ের গর্ভে নিজেকে উন্মুক্ত করে দিয়ে ছড়ানো রোদের কলতানের ভিতর দিয়ে যেতে
যেতে সে তার প্রাপ্তি অপ্রাপ্তির চুলচেরা - সবই যেন বুঝে নিতে থাকে নিজের প্রকৃত
অধিকারে। অধিকারবোধ তাকে সচেতন সন্ত্রস্ত করলেও সে স্বভাবজ নির্জনতায় সেটা
উপেক্ষাই করে। অতিক্রমণের বাঁকে তাকে একটা সময় সানিয়াজান নদী পেরিয়ে এসে পড়তে হয়
হেলাপাকড়ির বর্ধিষ্ণুতায়। বর্ধিষ্ণুতার নিজস্ব গন্ধ তাকে মোহিত করে। সে নিজের
মুখের গর্তে গন্ধ টেনে নিয়ে স্বাদকোরকগুলিকেই যেন উদ্দীপ্ত করতে থাকে। উদ্দীপনা
তার সর্বাঙ্গেও ছড়িয়ে পড়ে। সে হেলাপাকড়ির বর্ধিষ্ণুতাকে শেষাবধি গ্রহণ করে
স্বীকৃতি দেয় আর কচুপাতের মাথাল মাথায় চাপিয়ে আরো আরো বর্ধিষ্ণুতার দিকেই চলে যেতে
থাকে। জলাশয়ের উড়ে যাওয়া পাখিদের ডানার ছায়ায় ছায়ায় হয়তো সে ঘুমোতে চায়
জন্মজন্মান্তরের সব ঘুম যার পরবর্তীপর্বে সে পুনরায় তার নবীকরণের আলোয় আলোয় দুলে
উঠবে, ভেসে যেতে থাকবে। সে কি দেখে নেবে, দেখে নেবার অবকাশ পাবে খাটাসের চর হাতিডোবা বিল
সীমান্তপিলার নুরুদ্দিন শেখের দাওয়াখানা হেটোকবির বাস্তুভিটা কচুপাতের টলমল করে
ওঠা জলবিন্দুর এতসব ভ্রম ও বিভ্রম। বিভ্রমের খাঁজকাটা খোপে খোপে সে হয়তো স্নায়ুবাহিত নিঃসঙ্গতার দিনলিপি লিখে রাখতে থাকবে যার অন্তিমপর্বে তার
অস্তিত্বের ভারবাহিতায় সে নিজেই এক দৈনন্দিন হয়ে উঠবে। হেলাপাকড়ির প্রান্ত থেকে
প্রান্তিক মানুষেরা পায়ে পায়ে ধুলো উড়িয়ে তার চারপাশ দিয়ে বহমানতার দৃশ্যই নির্মাণ
বিনির্মাণ করতে থাকবে অস্তিত্বকে গ্রাহ্য না করেই। লোকজনবৃত্তান্তের জটিলতায়
দীর্ঘ এক জীবন নিয়ে হয়তো তার বেঁচে থাকাকে সে আপ্রাণ মহামান্য করে তুলবে যেন বেঁচে
থাকবার মধ্য দিয়েই সে বেঁচে থাকাটাকে ভিন্নতর কোনো মাত্রা দিতে চায়, কালখন্ডের জ্যামিতিক নকশায় চুর্ণ বিচুর্ণ অনুভূতির সম্মিলনে তার বেঁচে থাকবার
ধরতাইটুকু আরো দীর্ঘ জীবন বেঁচে থাকবার সম্ভাবনার কাছেই তাকে নিয়ে যায়। নিজের পুনরাবৃত্তিকেই কি সে
ফিরিয়ে আনতে চায়! শোক ও শোলকের গানের সাথে বাদ্যবাজনার সাথে মহাসমারোহে সে নদীপুকুরে ভাসিয়ে
দেওয়া মনসাভাসানের আঞ্চলিক গাথাটিকে জীবন্ত হয়ে উঠতে দেখে। পুনরাবৃত্তি পুনরাবর্তনের
চিরচেনা পথ থেকে সে কিন্তু নেমে আসে ঝাড়ঝোপমদির আঞ্চলিক পথপ্রান্তরের ধুলোধোঁয়ার
ভিতর। এইভাবে সে বুঝি তার প্রাপ্তি আপ্রাপ্তির চুলচেরা বুঝতে চায় সারি গান, নাচের মুদ্রায় ঘুরে মরা গাঙশালিখ
ঢেকিয়ার আগাল ছেড়ে আসমাননপানে উড়ে যাওয়া লাল টিয়া সবেরই যুথবদ্ধতায়। এতসব ঘটতে থাকলে এত কিছুর অস্তউদয়ে সে কি ধরে
রাখতে পারবে তার মহার্ঘ্য নির্জনতাকে! নির্জনতার আবির্ভাব তিরোভাবের ভিন্নতর ভূমিকায় সে বুঝি সংযুক্তই
করে ফেলতে নির্জনতার শূন্যতা মহাশূন্যতাকেই। সে তার সমস্ত জীবন নিয়ে সকালসন্ধ্যা নিয়ে নদী পাহাড় খালবিল কুড়া দহ নিয়ে
ভুল ভুলাইয়ায় যেন পথ হাতড়ায় নিজের লুপ্তি বিলুপ্তির অপ্রাসঙ্গিকতায়। চিরদিনের গানগুলির ঝাপটে
ঝামরে সে তার প্রতিদিনকে স্বাভাবিকভাবেই চিরকালীন চিরদিনে রূপান্তরিতই করতে থাকে।
নেচার
পরাগত নির্জনতার আলো আঁধারিতে সে নিজের ব্যক্তিগতের দিকে ব্যক্তিগত
প্রশ্নসংশয় নিক্ষেপ করতে থাকে এক ধরনের বিহ্বলতায়। সে তার দিন প্রতিদিন নিয়ে কেবলই ব্যক্তিগতে ঢুকে
পড়ে। সে এমন এক মানুষ মেবল অন্তহীন
ঘুরে বেড়ায়, পরিক্রমণ করে লোকপৃথিবীর সকল
প্রান্ত উপপ্রান্ত। নিজস্ব প্রান্তিকতার বোধ তার
থাকলেও সে কিন্তু
প্রান্তিকতাতেই আবদ্ধ থাকতে চায় না; আকাশমাটির
মধ্যবর্তী খোলানে সে যথাযথ সংস্থাপন করে তার জীবনদর্শন ও প্রান্তিকতাকে। সে কিন্তু বোবাকান্না দিয়ে শূন্যতাকে ঢাকতে পারে না, বড়জোর ছোট ছোট ঘটনাপুঞ্জকে শূন্যতায় লীন করে দিতে পারে। শূন্যপুরাণের
সহজ জমিনের ওপর দিয়ে কথকঠাকুরেরা যায়। নিসর্গের
শক্ত ফ্রেমে সে আঁকতে শুরু করে মহাশূন্যতারই
পুরাণ। নিজের পরাজয়কে মেনে নিয়ে সে
সুসমাচারের মতো হেসে ওঠা চারপাশের নেচারের ভিতর
ডুবে যায়, নেচারের মধ্য থেকেই তুলে আনে সুর
তাল লয় যা এই কেন্দ্রবিন্দুতে সমবেত বংশীধ্বনি মেষপালকের মন্থরতাময়
গমনচলনের নৈকট্য ঘেঁষা সহজতা হয়ে তাকে পরাজয় থেকে
টেনে তোলে জীবনের চিরসত্যের মতো। সে অবশ্য এইরকম বিহ্বলতার বশবর্তী না থেকেও
বিহ্বলতার ভরকেন্দ্র থেকে সযত্নে টেনে এনে সাজিয়ে রাখতে তৎপর হয়ে ওঠে দৃশ্যমান
অদৃশ্য সব চরাচর,
ফিসফিস করে কথা বলতে থাকা মানুষজনের সারল্যতাময় অবস্থিতি
নদী পেরিয়ে চলে যেতে থাকা জঙ্গলীয়া হাতির পাল সমস্তটুকুই। এইভাবে বৃত্তান্তের সহজিয়া ঢঙে আবডাল আড়ালের বাইরে চিরকালীন বৃত্তান্তেরই
হয়তো জন্ম হয়; কিংবা বৃত্তান্তগুলিই যেন জন্মান্তর সাঁতরে চলে আসা
কথান্তরের মতো। এত কিছু ঘটে যায়, পলকহীন দেখে যাওয়া ছাড়া আর কিছুই করার থাকে না। অপারগতার ব্যর্থতাবোধে নিজেকে বিদ্ধ করতে করতে সে
কিন্তু নিজেরই ব্যক্তিগতের দিকে আত্মস্থ হতে শুরু করে। এই রহস্য টাড়িবাড়ির ঘুমন্ত পার্থিবতায় শিশির কুয়াশার মতো নিজস্ব ব্যক্তিগতই হয়ে ওঠে। সে তার পরিক্রমণ অব্যহত রাখে; পরিক্রমণের নির্দিষ্ট গতি থাকলেও গন্তব্য নেই, কেননা পরিক্রমণাটাই জরুরী অংশ জীবনের। পরিক্রমণের মধ্য দিয়েই তো সে অতিক্রম করবে নিজেকে, বারবার নতুনতম হয়ে উঠবার জন্য। সব সংকট সংশয় প্রশ্ন প্রতিপ্রশ্ন নিয়ে সে কি হয়ে
উঠতে সক্ষম হবে একজন প্রকৃত মানুষ যে আত্মউন্মোচনের পর্বান্তরগুলিকে জলবিভাজিকা
ভেবেও কেবল আত্মগত এক মানুষই যেন হয়ে উঠতে চায়। আঞ্চলিক হতে চেয়েও সে কিন্তু তাকে অতিক্রমও করে আসে
দৃঢ়তায়, কেননা ব্যক্তিগতের দিকে
বিহ্বলতা নিয়ে উড়ে যাওয়াটাকে ভিন্নমাত্রা দিতে চেয়ে
সে মোচনের স্বাদ পায়,
আর নেচারের আগাপাশতলা নন্দনতত্বের কাঁটাবনে হাঁটতে
হাঁটতে প্রার্থনাগানের মতো সে হাঁটু মুড়ে বসে পড়ে।
0 কমেন্টস্:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন