দুর্গতিনাশিনী এবং শরৎ
বাংলাদেশ। কুমিল্লা শহরের লালমাই পাহাড়ের কাছে কোটবাড়ি শহরতলী। লালমাই-এর পায়ের তলায় একটা শান্ত সবুজ দীঘল গ্রাম। আমার কিশোরবেলা।
বাইরে পড়েছে ফিনফিনে হালকা শাদা কুয়াশার চাদর। তখন সন্ধ্যা রাত। বাতাসে একটা মৃদুমন্দ সুখের ঘ্রাণ। রাত বাড়ার সাথে ঘ্রাণটা গাঢ় হয়। কুয়াশার চাদরটাও বুঝি জড়িয়ে ধরে আরো নিবিড় হয়ে। আমি দূর থেকে তার ছায়া দেখি। দূরের গ্রামে কুপি বাতির আলোগুলো যেন জ্বলজ্বলে হীরে! জ্বলে থাকে আমার বুকের মধ্যে। আকাশে তাকালে চকচকে ধারালো ছুরির মতো জোৎস্না দেখে বুঝেতে পারি শরৎ এসেছে। সাথে কত রকম তারার মেলা! ছোট্ট দু'চোখ ভরে তখন অদ্ভুত সুন্দরতার আবেশ। বুঝি না, কাকে বলে দুঃখ তাপ খরা। জীবন জুড়ে যেন প্রবহমান শুধু শরৎ। গ্রামের আল বেয়ে শেষে আমার ঘর, আমার বাড়ি। তিনতলার খোলা ঝোলানো বারান্দা। তার নিচে একতলার সাথে লাগোয়া শিউলি গাছ। আহা! কী সুঘ্রাণ! এই শিউলি আমাকে চিনিয়েছে শরতের ঐশ্বর্য। কী অতুল তার বৈভব! সারাটা রাত তার গন্ধে আমি জেগে থাকি। মায়ের কোলের কাছে এপাশ ওপাশ করি। কখন ভোর হবে! কোনো মতে সূর্য উঁকি দিলেই আমি এক ছুটে বেড়িয়ে পড়ি বারান্দায়। ঝোলানো বারান্দায় ঝুলে পড়ে তাকাই নিচে। ও আমার শিউলি! সখী! সারারাত গন্ধে বিভোর করে আবার পালিয়ে যাস নি তো! যেদিন নিচে গাছতলা দেখি ফুলে ফুলে ছাওয়া। সে যে কী আনন্দ! এক দৌড়ে ছুটে যাই গাছতলায়। ফুলের সাজি ভরে ঘরে আনি ফুল। বুকে লাল ক্ষত। সাদা শিউলি। সারা বাড়ি সুগন্ধে মৌমাতাল। ফুল ঘরে রেখে দিয়ে স্কুলে চলে যাই। বাড়ি ফিরি আবার শিউলির টানে। সারাদিন বারান্দায় বসে শিউলি ফুলে মালা গাঁথি। আর যেদিন আলসে ঘুমে সূর্যের অলক্ষ্মী রোদ ঢুকে পড়ে ঘরে, একটাও শিউলি নেই পড়ে নিচে, শূন্য রাস্তা। সেদিন গাঁথা হয় না ফুলমালা। ছোট্ট মেয়েটির মনে কী গভীর বেদনা বাজে সারাদিন একা একা! এমনি ছিল আমার শরৎ ভোর। ছোটবেলায়। শিউলির সাথে আসত উমা। বাপের বাড়ি বেড়াতে। কী যে আনন্দ উমার নাইওরীতে!
আমরা মাঝে মাঝে আসতাম গ্রাম টিলা কুপিবাতির আলো ছেড়ে অন্য এক শহরে। সে আর এক সুন্দর। বাংলাদেশের ব্রক্ষ্মপুত্র নদীর পায়ের কাছে তার বাস। নাম ময়মনসিংহ। আমার খালার বাড়ি। সেখানে চারপাশে শুধু উমার শঙ্খ বাজে শরতের সন্ধ্যা ভোরে। কত যে আলোর লহরে সাজতো সারাটা শহর! আমরা বড়দের সাথে ঘুরে দেখতে বের হতাম পাড়ায় পাড়ায় দুর্গা পুজোর আয়োজন। সন্ধ্যায় হতো আরতি নাচ। ধোঁয়ার কুন্তলী পাকিয়ে পাকিয়ে সে প্রবল নৃত্য আমারও মনের গভীর থেকে গভীরে হারিয়ে যেত। আমি সুযোগ পেলেই লুকিয়ে ছুঁয়ে দেখতাম দুর্গার হাত। পায়ের নিচে বাহন সিংহ। কী সাহস রে বাবা! সিংহের পিঠে চড়েছে যে মেয়ে না জানি তার কী সাহস! অসম্ভব সুন্দর তার চোখ। গলার মালা। আমি তাকিয়ে দেখতাম রোজ, ছুঁয়ে দেখতাম তার পায়ের পাতা। এ ছিল নিত্য সন্ধার রাগ। তারপর একদিন বাজতো তার শঙ্খনাদ। স্বামীর ঘরে ফেরার। সারা শহর যেন পাগলপ্রায় আমার প্রিয় তপস্বীনিকে বিদায় জানাতে। দশমী। ব্রক্ষ্মপুত্তে হতো বিসর্জন। আমার বুকেও বাজতো বাঁশি। রাগ বেহাগ। সন্ধ্যেটা তখন লাগতো ম্রিয়মান, অন্ধকার আর নিষ্প্রভ। আজও শরৎ আসে। শিউলি আসে। উমা আসে। অসুরেরা নাশ হয় না। সদম্ভে আজও অসুর ঘুরে বেড়ায় পালে ও পলকে। আড়ষ্ট হয়ে পড়ে সুধীজন, শুভসৃষ্টি। দুর্গতিনাশিনী ফিরে যায় আপন আলয়ে। তার দশভুজে দশ অস্ত্র নিষ্কর্ম। অসুরের কাছে কি পরাজিত আজ উমা উন্মাদিনী অসুরবিনাশী দুর্গতিনাশিনীর সব সিদ্ধি!?
এখনও শিউলি ফোটে। রাতের গভীরে তারারা হাসে। সারাদিন মেঘেরা আকাশে ছুটোছুটি করে। ব্রক্ষ্মপুত্রে ছেঁড়াপাল উড়িয়ে মাঝি গান ধরে। তবু কোথায় যেন ঝুলে থাকে একটি মৃত চাঁদ অসংখ্য জীবিত নক্ষত্রদের সাথে।
শাপলা আপনার সাথে ময়মনসিংহ ঘোরা হয়ে গেল।ভাল লাগল
উত্তরমুছুনশাপলা আপনার সাথে ময়মনসিংহ ঘোরা হয়ে গেল।ভাল লাগল
উত্তরমুছুনস্মরণীয় দিনগুলি, খুব ভালো লাগলো। শরতে শাপলাও ফোটে, কিন্তু শাপলার স্মৃতি কই আপু?
উত্তরমুছুনযাওয়া হয়নি ময়মনসি্হ তবে লেখাটিতে আমি ঘুরে আসলাম শরতের ময়মনসি্হ .ভালো লাগলো।
উত্তরমুছুন