কালিমাটি অনলাইন

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

রবিবার, ২০ সেপ্টেম্বর, ২০১৫

অন্তরা চৌধুরী

চোখ ধরেছে মেঘের ছাতা







শাহ্রুখ খানের সেইচল্ছাইয়া ছাইয়ামনে আছে? কিংবা সইফ আলি খানেরইয়ে হাওয়ায়ে গুনগুনায়ে’? ভোর চারটের সময় যখন কালকা স্টেশনে নামলাম, তখনকার মনের অবস্থা বলে বোঝানোর নয় চেপে বসলাম সেই বহু স্মৃতি বিজড়িতশিবালিকটয়ট্রেনে ভোরের অন্ধকারে ওই দূর পাহাড়ের গায়ে আলো দেখে বেশ রোমাঞ্চিত হচ্ছিলাম ভাবতেই অবাক লাগছিল যে, আমরা নাকি ঐ পাহাড় পেরিয়ে আরো  অনেক উঁচু পাহাড়ে যাব ট্রেন তো বেশ ধীর গতিতে তার যাত্রা আরম্ভ করল একটা অদ্ভুত জিনিস লক্ষ্য করলাম, কালকা স্টেশন এবং কালকা থেকে সিমলার যাত্রাপথে আধুনিকতার কোনো ছোঁয়া নেই অর্থাৎ ইংরেজরা যেভাবে ঐ স্টেশন তৈরি   করেছিল, সে এখনো সেভাবেই আছে তারা যে হাতিল্যাম্প ব্যবহার করত, সেই  ঐতিহ্যমণ্ডিত হাতিল্যাম্পই এখনো সিগন্যাল রূপে ব্যবহৃত হয়

সবাই বলে যে শীতের দেশে যেতে হয় শীতের সময় যারা বলে, তাদেরকে বুড়ো  আঙ্গুল দেখানোর ফলটা ভোগ করলাম যখন প্রবল বৃষ্টি শুরু হলো ভরা শ্রাবণে  একমাত্র পাগল ছাড়া কেউ বেড়াতে যায়! যায় বৈকি! ভ্রম পাগলরাই যায় আসলে  গতানুগতিক চিন্তাভাবনা থেকে বেরিয়ে গিয়ে যারা ভাবে, সমকাল তাদেরকেই পাগল  বলে সে বলে বলুক! কু-ঝিকঝিক আওয়াজে বেশ নেশা ধরে গেছে কতগুলো যে  টানেল পেরলাম, গুনতেই ভুলে গেছি তারপর আসল পৃথিবীর সেই দীর্ঘতম টানেল  নাচতে প্রবল ইচ্ছে করছিল কিন্তু অনেক কষ্টে নিজেকে সামলে আমরা সিমলামুখী কিন্তু গাইতে বাধা কোথায়? গুনগুন করছিলামতু হ্যায় ফুলো মে কালিওমে, ইয়া মেরি খাঁবো কি গালিওমে দেখলাম কৌতূহলী হয়ে লোকজন তাকাচ্ছে ভারি তো আমার বয়েই গেল!

কাশৌলী
                                                                                   
আমাদের গন্তব্য চিরাচরিত সিমলা নয় তার বদলে বেছে নিয়েছিলাম হিমাচল প্রদেশের একটা ছোট্ট গ্রাম - কাশৌলি ছবির মতো সুন্দর সেই গ্রাম শীতের পাহাড়কে  অনেকেই দেখেছে কিন্তু বর্ষায় পাহাড়ের অন্যরূপ বরফে আচ্ছন্ন পাইন গাছে ঘেরা পাহাড় সুন্দর হলেও সে শীতে কুঁকড়েই থাকে কিন্তু বর্ষা হিমালয় পর্বতমালা যেন  নবযুবতী পাইন গাছের ফাঁক দিয়ে মেঘ নেমে আসছে রাস্তায় মাঝ রাস্তায় ট্রেন থামলে গরম ভেজ প্যাটিস আর কফি মন্দ লাগল না মেঘের সাদা চাদর মুড়ি দিয়ে আমরা নামলাম কুমারহাটি নামক একটা ছোট্ট স্টেশনে সেখান থেকে গাড়িতে করে গেলাম কাশৌলি প্রথমে বেশ মজাই লাগছিল; কিন্তু রাস্তা যখন ক্রমশঃ দুর্গমগিরি কান্তার মরু দুস্তর পারাবার হেহতে লাগল, তখন নিজের অজান্তেই একটা মৃত্যুভয় কাজ করছিল ভাবছিলাম পালকের মতো শূন্যে ভাসতে ভাসতে যদি... ড্রাইভারের  হাসিতে সম্বিত ফিরে পেলাম হিমাচলের ড্রাইভার নাকি গাড়ি চালাতে সব থেকে পারদর্শী সে আমাকে আশ্বস্ত করল -‘ব্যাহেনজী, আপকো ডরনেকি কই জরুরত  নেহি আমিও তার কথায় আশ্বস্ত হয়ে দাঁতের দোকান খুলে বসলাম এমন সময় দেখি ঐ দুর্গম এলাকায় কেন্দ্রীয় বিদ্যালয়ের স্কুলবাস বাসের ভেতরে যারা ছিল তাদের প্রত্যেকেরই বয়স আড়াই থেকে তিন বছর এরা যদি এখানে পড়তে আসতে পারে, তবে আমি কেন বেড়াতে আসতে পারি না!

গাড়ি থেকে যখন নামলাম, তখন বৃষ্টি হয়ে গিয়ে মেঘ একদম পরিষ্কার পাইন গাছে  ঘেরা কাঠের তৈরি সুন্দর কটেজ দেখে মুগ্ধ হয়ে গেলাম ব্যালকনি থেকেই ওপারে  দেখা যাচ্ছে বরফে ঢাকা তীব্বত সোয়েটার বা চাদরের প্রয়োজন না থাকলেও স্নান করতে গিয়ে জল বুঝিয়ে দিল - ‘আমি যে সে জল নই বরফ গলা জলে পুষ্ট আমি হিমাচলের জলপেল্লাই সাইজের আলুর পরোটা আর টকদই দিয়ে সকালটা বেশ ভালোই কাটল দুপুরেও সুখাদ্য ভাত, ডাল আর সিমলা মির্চ-এর তরকারি মাছ,  মাংস খেতে হিমাচলের লোকেরা মোটেই পছন্দ করে না ডালটাই তাদের প্রিয় খাদ্য

দাগসাই

বিকেলে গেলাম দাগসাই হেরিটেজ মিউজিয়ামে, যেখানে তিনদিন মহাত্মা গান্ধীকে বন্দী করে রাখা হয়েছিল জেলের পুরোটাই কাঠের তৈরি, যাতে কয়েদীরা কেউ হেঁটে গেলে  নিরাপত্তা রক্ষীরা সহজেই বুঝতে পারে যে জেলটিতে মহাত্মা গান্ধীকে বন্দী করে রাখা হয়েছিল, সেটা এতটাই ছোট যে কেউ বসতে পারবে না তাকে শুধু দাঁড়িয়েই থাকতে হবেলাগে রাহো মুন্না ভাইসিনেমাতে সঞ্জয় দত্ত মহাত্মা গান্ধীকে দেখতে পেতো বলে যে আমিও পাব, এমন ভাবার কোনো কারণ নেই ব্রিটিশরা সত্যি কী অদ্ভুত  ছিল!

ফিরে আসাছি। হঠাৎ চোখে পড়ল রাস্তায় ধারে অজস্র নাসপাতি গাছ আর বেদানা গাছ তাতে থোকা থোকা নাসপাতি আর বেদানা ধরে আছে বেদানা তখনও সাবালক হয়ে ওঠেনি কিন্তু নাসপাতি তখন সদ্য যুবক হিমাচলের লোক সাবালক, নাবালক, যুবক কোনো নাসপাতি বা বেদানাকেই পাত্তা দেয় না কিন্তু তাই বলে  আমরা পশ্চিমবঙ্গবাসী পাত্তা দেব না, সেটা কী করে হয়! প্রায় জোর করেই মাঝরাস্তায় গাড়ি থামিয়ে নাসপাতি পাড়তে শুরু করলাম -‘আহা কি আনন্দ নাসপাতি পাড়াতে! পরের দিন সকালে সেই ড্রাইভার ভাইসাহাব প্রায় দশ কেজি নাসপাতি তার বাড়ির গাছ থেকে পেড়ে দিয়ে গেল ভাবা যায়!

মাঙ্কী পয়েণ্ট

পরের দিন গন্তব্য মাঙ্কী পয়েন্ট এয়ার ফোর্সের আওতায় পুরো অঞ্চলটা মোবাইল, ক্যামেরা ড্রাইভারের কাছে গচ্ছিত রেখে নির্দিষ্ট পরিচয় পত্র দেখিয়ে ভেতরে গেলাম মাঙ্কী পয়েণ্টের মাহাত্ম্য - পবনপুত্র হনুমানজী লক্ষ্মণের জন্য বিশল্যকরণী নিয়ে যাবার সময় ওই পর্বতের ওপরে কিছুক্ষণ বিশ্রাম করেছিলেন তাই সেখানে তাঁর একটি পায়ের ছাপ আছে শুধু ধর্মভীরু বলে নয়, মনের মধ্যে একটা সুপ্ত ইচ্ছেও ছিল - ‘যাই, দেখেই আসি এসেছি যখন - কী আছে ওখানে!ঘন্টা বাজিয়ে প্রবল বৃষ্টিকে  উপেক্ষা করে আমাদের যাত্রাপথ শুরু হলো পর্বত গাত্রে লেখা ৬৭২০ ফুট উঁচুতে  নাকি আমরা অবস্থান করছি পাহাড় কেটে কেটে সিঁড়ি থাকলেও রাস্তা কিন্তু মোটেও অল্প নয় যতবারই ওপরে মন্দিরের দিকে তাকাই ততবারই মনোবল ভেঙ্গে যায় নাঃ আর পারছি না কিন্তু শরীরকে উপেক্ষা করে মন বলছে চল মনের জোর বাড়ানোর জন্য পর্বত গাত্রে মাঝে মাঝেই হিন্দীতে লেখা আছে - জয় বজরংবলী, তোড় দে দুশমন কি গলি আমার মনে পড়ছিল মরুতীর্থ হিংলাজের সেই গান - ‘কতদূর আর কতদূর বলো মা  

আমাদের দুর্দশা দেখে লালমুখো বেবুনগুলো মনের আনন্দে বিদ্রূপ করছে অবশেষে যখন পৌঁছলাম তখন দেখলাম নিচের আর কিছুই দেখা যাচ্ছে না আমরা এখন মেঘেদের রাজ্যে এটাকেই বোধহয় স্বর্গ বলে! কী মনোরম সেই দৃশ্য সমস্ত পথশ্রমের  ক্লান্তি প্রকৃতি এক নিমেষে তার সৌন্দর্য দিয়ে ভুলিয়ে দিল অক্সিজেনের পর্যাপ্ত ঘাটতি থাকা সত্ত্বেও ভোগপ্রসাদ কিনে পুজো দিলাম ওখানে প্রসাদ রূপে ঠাকুরকে দেওয়া হয় মুড়ি, ছোলা আর নকুলদানা মন্দির চত্বরে রয়েছে সেই মৃত সঞ্জীবনী গাছ হনুমানজী ঐখানে একটা পা দিয়ে বিশ্রাম করেছিলেন তো বুঝলাম, কিন্তু আরেকটা পা? সেটা নাকি সিমলার জাকুতে দিয়েছিলেন সত্য সেলুকা! কী বিচিত্র এই হনুমানজী! সেখান  থেকে নেমে এসে এককাপ গরম চায়ে নরম চুমুক নেমে এসে গেলাম বহু পুরনো বৃটিশ আমলের একটি চার্চে শান্ত মন আরো শান্ত হয়ে গেল সেখান থেকে গেলাম সুইসাইড পয়েণ্ট না, আমার সুইসাইড করার কোনো ইচ্ছে নেই কিন্তু দেখতে ক্ষতি কী? গাড়ি থেকে নেমে পাহাড়ী পথের সৌন্দর্য উপভোগ করতে করতে সেই জীবন-মৃত্যুর সীমানায় এসে পৌঁছলাম বড্ড কবিত্ব হয়ে যাচ্ছে বুঝতে পারছি আসলে  ওরকম একটা জায়গায় গেলে জীবন-মৃত্যু সম্পর্কে দার্শনিক হওয়াটাই স্বাভাবিক নির্দিষ্ট জায়গায় গিয়েই দেখি পাহাড়ের ঢাল খাড়া ভাবে নেমে গেছে টোপগল্পটা পড়া থাকলে পাঠকের বুঝতে সুবিধে হবে অত সুন্দর জায়গায় গিয়ে কেন যে মানুষ... যাইহোক সেটা আমার আলোচ্য বিষয় নয় সেখান থেকে গেলাম সানসেট  পয়েণ্ট
   মেঘেদের ভেদ করে পর্দা
   সূর্যকে ধরবার স্পর্ধা...

সূয্যিমামা দেখা দিলেন না। তিনি তখন মেঘেদের সঙ্গে লুকোচুরি খেলায় বড়ই ব্যস্ত  তাই ওখান থেকে চলে এলাম আসতে আসতে দেখলাম পথের ধারে পাহাড়ের কোলে ভুট্টা বিক্রি হচ্ছে। উনুনের আয়োজন নিতান্তই সামান্য দু-চারটে কাঠকয়লার ওপর লোহার জালতি দিয়ে ভুট্টা পোড়ান হচ্ছে পথশ্রমে ক্লান্ত হয়ে সেই ভুট্টাই তখন পরম উপাদেয় খাদ্যবস্তু এরপর ঘরে ফেরার পালা রাস্তাতেই এক জায়গায় গাড়ি থামিয়ে খেয়ে নিলাম মোমো মহারাজকে উদর পরিতৃপ্তি করে নিজেদের ডেরায় ফিরে এলাম রাতে আবার সেই ডাল, ঘী দেওয়া মোটামোটা রুটি আর স্যালাড, সঙ্গে টকদই  প্রথম প্রথম খেতে ভালোই লাগছিল কিন্তু মাছ-ভাতে মোড়া বাঙালি আর কাঁহাতক ডাল রূটির অত্যাচার সহ্য করবে! কিন্তু কিছু করার নেই পড়েছ হিমাচলীদের হাতে, রুটি খেতে হবে সাথে

সোলান ভ্যালী

পরের দিন সকালে মূলোর পরোটা আর আদার চাটনী খেয়ে রওনা হলাম সোলান ভ্যালীর উদ্দেশ্যে যদিও কাশৌলীর মতো শান্ত, নির্জন সে নয় আধুনিকতায় সে  নিজেকে সজ্জিত করেছে সেটাই তার সৌন্দর্য এখানেই দেখা মিলল সোনার আপেলের অত চমকানোর কিছু নেই! সোনার ডিম হতে পারে, আর আপেল হতে পারে না? আসলে সেই আপেলের গাত্রবর্ণ সোনার মতো স্বাদে গন্ধে অতুলনীয় অল্পেতে স্বাদ  মেটে না স্বাদের ভাগ হবে না এতদিন যে আপেল খেয়ে আমরা অভ্যস্ত অর্থাৎ বালি বালি খেতে, রুগী রুগী গন্ধ বলে নাখ সিঁটকিয়েছি, কিন্তু মোটেই সে রকম নয় বেশ রসাল হালকা টক দামও বেশ অল্প তাই এর নাম গোল্ডেন অ্যাপেল টুকটাক বাজার করে ক্লান্ত হয়ে গেলে, খেয়ে নিন হিমাচল প্রদেশের স্পেশাল কুলফী একটা খেলে আরেকটা আপনাকে খেতেই হবে


অনেক ঘোরা হয়েছে, খাওয়া হয়েছে এবার মন চল নিজ নিকেতনে পায়ে ব্যথা না হলেও লিখে লিখে আমার হাতে ব্যথা হয়ে গেছে দেবভূমি হিমাচলের সেই ছোট্ট গ্রামের অমলিন স্মৃতি আজও নতুনের মতোই চির নতুন 



0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন