কালিমাটি অনলাইন

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

রবিবার, ২০ সেপ্টেম্বর, ২০১৫

ইন্দ্রনীল সেনগুপ্ত

দেশ বিদেশ বিশ্বাস




১৮৪৮এ কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো প্রকাশ সম্ভব হতো না, যদি না কার্ল মার্ক্স ব্রিটিশ লাইব্রেরির সংস্পর্শে আসতেন। ১৮১৮ থেকে ১৮৮৩ ব্যাপৃত মার্ক্সিয় উপস্থিতি পৃথিবীর ধ্যান ধারণা এবং মানচিত্রই বদল করে দিয়েছিল। অকল্পনীয় শিল্প এবং সামাজিক পরিবর্তনের সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে মার্ক্স ঘোষণা করেছিলেন, পুঁজিবাদ নিজের ধ্বংস নিজেই আহ্বান করে নিয়ে আসবে এবং তাঁর স্থান নেবে সাম্যবাদ। মার্ক্সের এই ভবিষ্যৎবাণী এখনও মেলেনি। কোনোদিন মিলবে কিনা তাও জানা নেই। কিন্তু একটা কথা স্বীকার করতেই হয়, পুঁজিবাদের চরিত্রটাও এখন অনেক বদলে গেছেপুঁজিবাদী ব্যবস্থার মধ্যেও বহু সাম্যবাদী সিদ্ধান্ত ঢুকে গেছে। মার্ক্সের সময়ে পুঁজিবাদ এবং আজকের পুঁজিবাদের মধ্যে বিস্তর ফারাক।

যাইহোক ঐ ব্রিটিশ লাইব্রেরিতে মার্ক্সের আনাগোনা সন্দেহের চোখে দেখতে শুরু করেছিল ব্রিটিশ সরকার। ব্রিটিশ পুলিস লাইব্রেরিতে হাজির হয়ে লাইব্রেরিয়ান ভদ্রলোককে নানা প্রশ্নবাণে বিদ্ধ করতে লাগল। উদ্দেশ্য, মার্ক্সের বিরুদ্ধে কোনো  আপত্তিকর তথ্যাদি পাওয়া গেলে তাঁকে সরাসরি গ্রেপ্তার করা। মার্ক্সের লেখা তখন সারা পৃথিবীব্যাপী আলোড়ন তুলেছে এবং পুঁজিবাদের চোখে মার্ক্স ক্রমশ বিপজ্জনক ব্যক্তিত্বে রূপান্তরিত হচ্ছেন।

মার্ক্স সম্পর্কে আপনার কী ধারণা।
লোকটি খুবই বিরক্তিকর।
পুলিশ খুব উৎসাহিত। যাক তাহলে গ্রেপ্তারের একটা ছুতো পাওয়া গেল
কীরকম কীরকম?
ভদ্রলোক বড় পরিশ্রম করান আমাদের কর্মচারীদের।
সে কী! কীভাবে?  
মোটা মোটা সব দর্শন আর ইতিহাসের বই, আরও নানা বই, খুব অল্পসময়ের মধ্যেই পড়ে ফেলেন, কীসব নোট করেন, আবার অন্য বই এনে দিতে বলেন। আমাদের প্রতিটা কর্মচারীকে ওঁকে নিয়ে খুবই ব্যস্ত থাকতে হয়।
তাহলে তো বিপজ্জনক লোক মশাই, গ্রেপ্তার করতে হয় দেখছি!

বিপজ্জনক? বিপজ্জনক তো আপনি। আপনার পরনে পুলিসের উর্দি, কোমরে রিভলভার। কিন্তু উনি তো একেবারেই সাদামাটা। কোনো আগ্নেয়াস্ত্র সঙ্গে রাখেন  না। আর আপনাকেও অনুরোধ, এই লাইব্রেরির এলাকাটা আমার এক্তিয়ারে পড়ে। এখানে আপনার জারিজুরি খাটবে না। এখানে কোনো ভাবে শান্তিভঙ্গ হলে তার  জন্য আপনিই দায়ী থাকবেন। আপনাকে অনুরোধ, অবিলম্বে এই এলাকা ত্যাগ করুন।
লাইব্রেরিয়ানের কথায় সেদিন পুলিস চলে গেছিল।

আমরা পাশ্চাত্যের যতই নিন্দে করি, সেখানে কিছুটা হলেও আইনের শাসন বরাবরই আছে। জালিয়ানওয়ালাবাগের হত্যাকাণ্ডের দায়ে জেনারেল ডায়ারের বিচার হয়েছিল। প্রতিষ্ঠানগুলির স্বাধিকার আজও অনেকাংশেই বজায় আছে।

পাশ্চাত্যের সেরা ঠিকানা পছন্দের বিচারে এখন আর ইংল্যান্ড নয়। আমেরিকা অনেকের কাছেই স্বপ্নের দেশ। একমাত্র গন্তব্য। আমারও একসময়ে তাই মনে হতো। শুনে শুনে, ছবি দেখে। তৃতীয়বার আসার পর সেই স্বপ্নের ঘোরটা আর নেই। প্রথমবার  দেখার পর থেকেই অবশ্য অনেকটাই মোহমুক্তি ঘটে গেছে।

আমেরিকা ভালো না মন্দ এই প্রশ্নের এক কথার উত্তর হ্যাঁ বা না তে দেওয়া যায় না। আমি বলি, আমেরিকা আলাদা এবং আমেরিকা একটা অভ্যেস। আমেরিকার অভ্যেস করতে গেলে নিজেকে ভীষণ শৃঙ্খলাবদ্ধ হতে হবে। ঘরে যেমন কার্পেট পাতা আছে, সেই কার্পেট যদি গরম ইস্তিরি লেগে পুড়ে যায় তবে বাড়ির লিজ কোম্পানি দু’হাজার ডলার নিয়ে নেবে। এটা একটা উদাহরণ মাত্র আসলে নিজের কাজগুলো নিজেকেই করতে হবে। নিজের কাজ বলতে কি বোঝায় সেই ধারণা আমাদের দেশের ধারণার সঙ্গে মিলবে না। এখানে নিজের কাজের ব্যাখ্যা ব্যাপক। গাড়ি চালানো, ধোয়া মোছা, রক্ষণাবেক্ষণবাড়িধোয়া মোছা রক্ষণাবেক্ষণ। বাজার হাট, রান্নাবান্না, চা-জলখাবার, পুষ্যি পালন, টুকটাক সারাই ইত্যাদিএ সমস্ত কাজই হয় নিজে অথবা পরিবারের সদস্যদের মধ্যে ভাগাভাগি করে করতে হবে। লোক রেখে কাজ করানো প্রচুর পয়সার ব্যাপার। দু’ঘণ্টা ঠিকে কাজের দাম সত্তর ডলার। রোজ দু’ঘণ্টা কাজ করাতে গেলে মাসে দু’হাজার ডলারের ওপর খরচা।
লোকের কাছ থেকে সেবা নেবার ব্যাপারটাই ভুলে যেতে হবে। অজস্র মেশিন। ডিশ ওয়াশার বাসন মাজে, ভ্যাকিউম ক্লিনার ঘর সাফ করে। বাড়িতে স্ক্রু-ড্রাইভার টুল বক্স জামা কাপড় কাচা ইস্তিরির ব্যাপার রাখতেই হবে।


সব থেকে আদর্শ অবস্থান আমেরিকায় রোজগার করে দেশে গিয়ে খরচ করা। তখন বেশ বড়লোক বড়লোক মনে হবে নিজেকে। যদি কেবল যথেচ্ছ গাড়ি চাপাটাই বড়লোকামির লক্ষ্মণ হয়, তবে আমেরিকার সকলেই বড়লোক। আমরা আমেরিকা প্রবাসী ভারতীয়দের দেখে মুগ্ধ হই। অবাক বিস্ময়ে তাঁদের আনা চকোলেট, পারফিউম, লিপস্টিক, লিকার, সিগারেট–এর মধ্যে ডিউটি ফ্রি শপিং ও ধরে নিতে হবে - উপভোগ করি, চাকচিক্যে মোহিত হই। আমি ভালো মন্দর বিচার করে উঠতে পারি না। কেবল ভাবি আমেরিকা ইজ ডিফারেন্ট।

আমেরিকাকে নিরবচ্ছিন্ন বা একতরফা সুখের দেশ বলে যাঁরা ভাবেন এবং এখানে বসবাসের কথা ভাবেন, তাঁদের আমি দু’বার ভেবে দেখতে বলবঅবশ্য দেশে  কিছুই করতে পারছেন না এবং যে কোনো ঝুঁকি নেবার বাধ্যবাধকতা চলে এসেছে,  এমন মানুষেরা অবশ্যই আসতে পারেন। বেড়াবার জন্য আসতে পারেন। উন্নত গবেষণা বা পড়াশোনার জন্যও আসতে পারেন। সে সুযোগ এখানে আছে। কিন্তু  তা’হলেও আমেরিকাকে রপ্ত করার মতো নমনীয়তা থাকতে হবে রক্তের মধ্যে।  নয়তো ব্যর্থতা বাধ্যতামূলক।

আমেরিকার হাসপাতালে আমার নাতি জন্মগ্রহণ করল। ওদের নিয়মানু্যায়ী মার্কিন ভূখণ্ডে জন্মানো সমস্ত শিশুই আমেরিকার নাগরিক। পিতামাতার নাগরিকত্ব বা ভিসা পাসপোর্ট যাই হোক না কেন। খবর পেয়েই হাসপাতাল লাগোয়া চার্চ থেকে পাদ্রীবাবারা নবজাতকের ঘরে উকি মারলেন। সঙ্কোচের সঙ্গে জিজ্ঞেস করলেন,  উপহার হিসেবে খ্রিষ্টান ধর্মগ্রন্থ উপহার নিতে কোনো ধর্মীয় বা অন্যান্য বাধা আছে  কিনা। আমার কন্যা জামাতা অবশ্য বলল যে, অন্যের মতের প্রতি তাদের শ্রদ্ধা  আছে এবং বাইবেল উপহার নিতে তাদের আপত্তি নেই।

নাতির দুই ঠাকুমা দিদিমা অর্থাৎ আমার গিন্নি এবং বেয়ান খবর শুনে বলাবলি করলেন, দেখ বাপু বাচ্চাকে আবার খ্রিষ্টান না বানিয়ে দেয়! অবশ্য রামকৃষ্ণের সেই উক্তিও স্মরণ করলেন তাঁরা। ধর্ম একটাই থাক কিন্তু অন্যকে ভালোবাসতে তো বাধা নেই। যত মত তত পথ। বিশ্বাস তার নিজস্ব শক্তিতেই মানুষকে বেঁধে রাখে। এত প্রোপাগান্ডা কি কোনো তফাৎ আনে? আমেরিকা যদি অভ্যাসে ঢুকে যায় তাহলে মুস্কিল।

ডালাসের কৃষ্ণতরুকে নিয়ে আমার লেখা কিছুটা আবার উদ্ধৃত করিঃ
“কিছুদিন দেশে থাকলেই তফাৎগুলো এত প্রকট হতে থাকে যে অনেকেই পরবর্তী  সুযোগেই আবার অ্যামেরিকা ফিরে আসেন। আমেরিকাতে বাড়ি গাড়ি আসবাব ইত্যাদি পার্থিব জিনিস জোগাড় করা এখানে ভারতীয়দের পক্ষে দুঃসাধ্য কিছু নয়।  বাঙালিরা এখানে সকলেই অল্প বিস্তর প্রতিষ্ঠিত। এথনিক গ্রুপ হিসেবে ভারতীয়রা সবার আগে রয়েছেন। শিক্ষা বা পারিবারিক রোজগার এই দুই ক্ষেত্রেই অন্য সবাইকে অনেক পেছনে ফেলে ভারতীয় সম্প্রদায় এগিয়ে আছেন। অবশ্য টমাস ফ্রিডম্যান তাঁর ‘দি ওয়ার্ল্ড ইজ ফ্ল্যাট’ পুস্তকে বুদ্ধিমত্তার পলায়নকে (Brain drain)  এজন্য দায়ী করেছেন। ভারতীয়দের সেরা অংশের গন্তব্য অ্যামেরিকা

ডালাসের মতো শহরে বাজারহাট নিয়ে কো্নো সমস্যাই নেই। ভারতীয় বা বাঙালি  চাহিদা অনু্যায়ী অনেক দোকান - যেমন প্যাটেল ব্রাদার্স, ইন্ডিয়া বাজার ইত্যাদি। ভারতীয় পাকিস্তানি বাংলাদেশী সমস্ত মসলা সবজি মাছ মাংস সবই অঢেল চালান আসে। মায়ানমার থেকেও ইলিশ বা রুই মাছের চালান আসে।

যাতায়াতে গুঁতোগুঁতির কষ্ট ভোগ করতে বা ট্র্যাফিক জামে ঘণ্টার পর ঘণ্টা আটকে থাকতে হয় না। সর্বত্রই অসংখ্য কারপার্ক আছে। রোজগার করলেই গাড়ি চাপা যায় রোজগারের তুলনায় তেলের দাম যথেষ্ট কম। গাড়ি বাড়ি অফিস দোকান সর্বত্রই বাতানুকূল যন্ত্র চলে। ঘাম বা গরম টের পাওয়া যায় না।

কৃষ্ণ এখন সর্বহারাদের থেকে অনেক এগিয়ে আছে স্বাচ্ছন্দ্যে। কিন্তু তবুও মনের কোণায় কোথাও একাত্মতা গড়ে ওঠে অজস্র বঞ্চিত মানুষের সাথে। এক ধরনের স্মৃতি মেদুরতায় সে বিচরণ করে কলকাতার অলিগলিতে। প্রতি রবিবার বেলা একটা থেকে দুটো পর্যন্ত মাঝে মাঝে কোনো কো্নো দিন কৃষ্ণ ব্যস্ত থাকে আন্তরিক  রেডিও নিয়ে। ডালাস ভিত্তিক বেতার কেন্দ্র ফান এশিয়ার সাপ্তাহিক একঘণ্টার একটি স্লট বরাদ্দ আছে আন্তরিকের জন্য। বাংলা গান চলে তাতে। অনুরোধ মতো  বা নিজের পছন্দ মতো গান বাজায়, কথা বলে কৃষ্ণ। অন্য বাঙালিরাও এই  অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন। সম্পূর্ণটাই স্বেচ্ছাশ্রম। দুহাজার সাত সালে আন্তরিক  পুজো কমিটির সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে এই অনুষ্ঠানের শুরুকায়া গ্রুপের অর্চনকে বলতেই সে তৎক্ষণাৎ সুর দিয়ে তৈরি করল থিম সং। বলা বাহুল্য, আন্তরিকের পুজোয় অন্তত এক হাজার বাঙালি যোগ দেন। আগে এটাই একমাত্র পুজো কমিটি  ছিল। এখন সে জায়গায় তিনটি পুজো হয় ডালাসে।


স্বাতী (কৃষ্ণতরুর স্ত্রী)ও কৃষ্ণতরুর মতে, অ্যামেরিকাতে যে কাজই মানুষ করে তা  অত্যন্ত মন দিয়ে করে, কোনো আপোষ করে না - এই দায়িত্বশীলতা শিক্ষণীয়। ঠিকমতো কাজ না করলে চাকরি চলে যেতে পারে, এই ভয় বা আজন্মলালিত  সংস্কৃতি এখানে মানুষকে কর্তব্য পরায়ণ করে। বিচ্যুতি সর্বত্রই থাকে। এখানেও আছে। তবুও সব মিলিয়ে শান্ত আর নিরুদ্বিগ্ন জীবন। আমি নিজেও তিন দফায় আট মাসের বেশি আমেরিকাতে কাটিয়েছি। আমার নিজের অভিজ্ঞতায় এটাই বুঝি যে, আমেরিকাতে পরিশ্রম আর প্রতিভার কদর আছে। অন্যের মাথায় কাঁঠাল  ভেঙ্গে, ফাঁকিবাজি বা ঠকবাজি না করে যদি কেউ নিজের প্রতিভা ও পরিশ্রমের প্রতিদান খোঁজে, তবে আমেরিকায় বসবাস করলে সে ঠকবে না। ওদের সঙ্গে আমি  একমত হই। অজস্র অভিমান নিয়ে বিদেশেই থেকে যাবে স্বাতীরা অথচ মনের মধ্যে লালন করবে দেশ। পরবর্তী প্রজন্মের ভারতীয়ত্ব হয়তো আরও ক্ষীণ হয়ে যাবে”


0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন