টিচারস্ ডে
হ্যাঁ আমাদের সময়,
এখনকার সময়ের তুলনা টানতেই হচ্ছে আবার। আমাদের সময়েও শিক্ষকরা ছিলেন, কিন্তু
শিক্ষক দিবস পালনের এমন ধুম ছিল না। গিফট দেওয়ার জন্য ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে
প্রতিযোগিতা ছিল না। স্কুলে বেশিরভাগ দিদিদেরই ব্যবহার বা পড়ানোয় আন্তরিকতার
ত্রুটি দেখতে পেতাম না। শিক্ষক দিবসের দিন প্রেয়ার লাইনে একটু শ্রদ্ধাজ্ঞাপন পাঠ
ছাড়া আমাদের কোনো আলাদা উৎসব থাকত
না। উপহার দেওয়ার রেওয়াজ তখনও চালু হয় নি। আর যেহেতু তিন
বছর বয়স থেকেই প্রাইভেট টিউশন নেওয়ার চলও ছিল না তখন, তাই স্কুলের বাইরের স্যার বা
দিদিদের জন্য গ্রিটিংস কার্ড বা ফুল বা পেনের বিক্রি আলাদা ভাবে বাড়ে নি সেই সময়ে।
স্কুল বললেই দিদিদের
কথা মনে পড়ে। মনে পড়ে, এক ইতিহাসের বৃদ্ধা দিদি ছিলেন, যিনি দু’একলাইন রিডিং পড়িয়েই জানালা দিয়ে তাকিয়ে থাকতেন আর একটু বাদেই ঢুলতে
শুরু করতেন। আর আমাদের খিকখিক শুরু হতো। আর একজন সংস্কৃতর দিদি ছিলেন, খুব বদরাগী। তাঁর হাতের কানমলা বা দু’এক চড়চাপড় খায় নি, এমন মেয়ে খুব
কম ছিল স্কুলে। তাঁর সব সময়ে
টার্গেট থাকত বাঁ কান। সত্যি বলতে কি, সেই স্কুলজীবন থেকেই আমার বাঁ কান একটু
লম্বা হয়ে আছে তাঁর কৃপায়। ভয় পেতাম ঠিকই, কিন্তু মনে কোনোদিন অশ্রদ্ধা জাগে নি। মারধোরের
জন্য আমাদের তাঁর বিরুদ্ধে থানাপুলিশও করতে হয় নি। যেহেতু
মনিটর থাকতাম বেশির ভাগ সময়ে, টিচার্স রুমে আমার ছিল অবারিত দ্বার। যে কোনো সমস্যা নিয়ে হাজির হতাম। এক
দিদি ছিলেন, যাঁর স্বভাব ছিল জনে জনে ডেকে তার বাড়ির খবর নেওয়া। কি দিয়ে খেয়ে
এলাম, ইত্যাদি সম্বন্ধে অবাধ কৌতূহলের জন্য তাঁকে আমরা নাম দিয়েছিলাম, ‘হাঁড়ির
খবর’। বিরক্ত হতাম আমরা খুব তাঁর ওপরে, কিন্তু এখন
বুঝি, কতটা আন্তরিক ছিলেন ছাত্রীদের প্রতি। আমার মুখের ওপর এসে পড়া কোঁচকানো ঝাঁকা
চুল নিয়েও তাঁর অশান্তির শেষ ছিল না। পারলে ন্যাড়া করে দিতেন ঠিক। স্টাফ রুমে
একদিন তো চিরুনি আর হেয়ার ব্যান্ড নিয়ে তেড়ে এসেছিলেন, আমি পালিয়ে বেঁচেছিলাম।
জীবন বিজ্ঞানের এক
নতুন অল্প বয়সী দিদি এলেন আমাদের স্কুলে। নতুন বলেই হয়তো তাঁর পড়ানোয় কী উৎসাহ! রোজ রোজ রঙিন চার্ট নিয়ে
আসতেন, আর আমাদের সেই চার্ট ঘিরে উদ্দীপনা বাড়ত। ব্যাঙের
পৌষ্টিক তন্ত্র পড়াতে গিয়ে আস্ত ব্যাঙ নিয়ে চলে এলেন ক্লাসে। তারপর ট্রেতে সেই
ব্যাঙ কেটে দেখালেন পৌষ্টিক তন্ত্র। সেই সময়েই আমি এবং আরও কয়েকজন অতি উৎসাহী
ব্যাঙ কাটতে শিখে ফেলি তাঁর কাছ থেকে। সিলেবাসের
বাইরে বলে কিছু ছিল না তখন। আর যাঁর কথা না বললে
আমার অপরাধ হবে, তিনি হলেন আমাদের প্রিয় ভূগোল দিদি। আমি তখন ক্লাস এইট। নতুন এলেন
তিনি কোনো এক ইংরেজি মাধ্যম
স্কুল থেকে। শুনেই আমরা তটস্থ। না জানি ইংরেজি বুকুনি দেবেন কত! কিন্তু
প্রথম দিন এসেই আমাদের মন জয় করে নিলেন তিনি। একগাল হাসি আর সহজ সাবলীল ব্যবহারে
তিনি প্রথম দিনেই আমাদের মন জিতে নিলেন। আর একটা বিষয়কে ঘিরে যেভাবে ক্রেজ নিয়ে
এলেন আমাদের মধ্যে, তা এক কথায় বিরল। ভূগোল বলতে আমরা তখন সবাই অজ্ঞান। যাদের কাছে
ভূগোল ছিল ভীতিপ্রদ, তারাও ভূগোলকে কাছে টেনে নিল এই দিদির
বোঝানোর কারণে। আমাদের আর বাড়িতে পড়তে হতো না, মুখস্থ করতে হতো না দুলে
দুলে, খালি হাতে নিঁখুত ম্যাপ আঁকা অভ্যেস হয়ে গেছিল প্রায় সবার। ছাত্রীরা ভূগোল
অন্ত প্রাণ, ভূগোলের দিদি অন্ত প্রাণ। আমি তো ঠিক করেই ফেলেছিলাম, ভূগোল নিয়েই
পড়ব। যদিও ভবিষ্যতে ভূগোলের ভূত নেমে গেছিল ঘাড় থেকে। এই দিদিকে আমরা পেয়েছিলাম
মাত্র দু’বছর। তিনি অন্য কোনো স্কুলের হেড মিস্ট্রেস
হয়ে চলে যান। আর আমরা অনাথ হয়ে যাই। অনেক বছর বাদে ওনার সঙ্গে দেখা হয়েছিল একবার।
বয়স বেড়েছে যতটা, তার চেয়ে বেশি বুড়োই দেখাচ্ছিল ওঁকে। মুখে লেগে থাকা সেই হাসি আর
নেই। কিছুক্ষণ পরে বললেন, ওঁর একমাত্র মেয়ের ক্যানসার। সন্তানের চিন্তায় তিনি বদলে
গেছেন। সেই তাঁর সাথে শেষ দেখা। জানি না এখন
উনি কেমন আছেন, ওঁর মেয়ে কেমন আছে!
আর একজনের কথা না
বললেই নয়, তিনি হলেন আমার বাংলার দিদি। উনিই প্রথম আমার মনে লেখালেখির বীজ
পুঁতেছিলেন। সেই ঘটনার কথা আজও মনে পড়লে আমি বেশ লজ্জা পাই, সঙ্গে সঙ্গে আনন্দে মন
ভরে ওঠে। সম্ভবত তখন আমার ক্লাস সেভেন, স্কুলের পরীক্ষায় রচনা লিখেছিলাম এক। বিষয়
ছিল, একটি পোস্টকার্ডের আত্মকথা। বিজ্ঞানভিত্তিক বা তথ্যভিত্তিক রচনায় বেশি
নাম্বার পাওয়া যায় জেনেও, আমি ওই বিষয় নিয়েই লিখেছিলাম। এখন আর মনে নেই কী লিখেছিলাম। তবে আমার
উত্তরপত্রটি সেদিন বাংলার দিদি সারা স্কুলে পড়িয়ে শুনিয়েছিলেন। আমার তখন মনে
হচ্ছিল, হে ধরণী দ্বিধা হও, ভেতর
ভেতর এক কাঁপুনি টের পাচ্ছিলাম। তারপরে দিদি বলেছিলেন, ‘যা মনে আসবে, লিখে রাখবি,
বুঝেছিস? তোর হাতে লেখা আছে’। হ্যাঁ,
সেই কথা আমি রেখেছিলাম। যা মনে আসত, সে ডায়েরিই হোক বা খাতায়
লিখে রাখতাম। আর সেই গোপন লেখালেখির সাক্ষী কাউকে রাখতাম না। এই তো কিছুদিন আগে
আজীবন কুমারী থেকে যাওয়া সেই একলা মানুষটির সাথে আবার দেখা। অশক্ত পায়ের জন্য
হাঁটতে পারেন না প্রায়; চোখ,
কান, শরীর গেছে। এভাবেই কেটে যাবে তাঁর বাকি জীবন। সেদিনও
আমি কিন্তু ওঁকে সঙ্কোচে বলতে পারি নি, দিদি, দেখুন, আমি কিন্তু এখনও লিখে যাচ্ছি
আপনার কথা মতো!
আর আমাদের বড়দিকে
‘মাসীমা’ বলে ডাকত পুরো স্কুল। তাঁকে সমীহ করে চলত সবাই। তাঁকে দেখলেই আমার
ইন্দিরা গান্ধীর পার্সোনালিটির কথা মনে পড়ত। সব সময়ে ঘোমটা টেনে থাকা তাঁর ছায়া দেখলে সবাই ‘টাইট’
হয়ে যেত। স্কুলের ছুটির পরে আমাদের একটুও আড্ডা দেওয়ার উপায় ছিল না ওঁর জন্য। উনি
সবার শেষে স্কুল থেকে বেরোতেন। উনি ওঁর ঘর থেকে বেরোচ্ছেন দেখেই, আমাদের অবস্থা
ঢিলে হয়ে যেত। সঙ্গে সঙ্গে চোঁ দৌড়। ক্লাস নাইনে উনি যখন আমাদের ইংরেজি পড়াতে
এলেন, তখন ভয় কাটল। আর অসম্ভব ভালো পড়াতেনও বটে। সে সময়ে ওনার কাছ থেকে
যেভাবে আমরা ট্রান্সলেশন শিখেছি ক্লাসে, জানি না এখনকার ক’জন প্রাইভেট টিউটর সেই দায়িত্ব নিয়ে শেখাবেন! স্কুলে
দলীয় রাজনীতির দাপট সে সময়ে
সেভাবে চালু হয় নি। প্রথমে সিপিএম এবং পরবর্তীকালে তৃণমূলের লোকেরাও তাঁকে
একবাক্যে মেনে নিয়েছেন। তিনি ছিলেন স্তম্ভের মতো। তাঁর রিটায়ারমেন্টের পরে স্কুলে রাজনীতির
কোন্দল ঢুকেছে। কত ঘেরাও, পুলিশ,
আরও কত কী! মাসীমা চলে গেলেন আর
স্কুলের ডিসিপ্লিনও চলে গেল অনেকটা। যদিও পরবর্তীকালে স্কুলের বিল্ডিং বেড়েছে,
ছাত্রীর সংখ্যা বেড়েছে, বাইরে থেকে দেখতে গেলে বাড়বাড়ন্ত অনেকটাই হয়েছে। কিন্তু
এখনও পুরনো যাঁরা আছেন, তাঁদের সঙ্গে দেখা হলে বলেন, আমরা আর সেভাবে পড়াই না; আসি যাই, মাইনে পাই, ব্যাস্, আমাদের ডিউটি শেষ।
ছাত্রীদেরও
তেমন আগ্রহ দেখি না শেখার। যেন স্কুলে আসতে হয় আসে, পড়াশোনা যা হয়, সবই নাকি কোচিং ক্লাসে!
খারাপ লাগে সেই
দিদিদের মুখে এমন কথা শুনলে। এত উৎসাহের অভাব কবে থেকে তৈরি হলো? কবে থেকে বেড়ে গেল এই দূরত্ব? হয়তো যুগের সাথে সবই পরিবর্তিত হয়
এভাবেই! আন্তরিকতা কমে যান্ত্রিকতা বাড়ছে।
সিলেবাস, প্রশ্নের ধরন যেমন বদলাচ্ছে, পড়ানোর ধরনেরও তেমন তেমন বদল ঘটছে।
এটাই বোধহয় স্বাভাবিক। এখনকার ছাত্রছাত্রীদের দেখে বুঝেছি, ওরা অনেক বেশি কাজের।
অর্থাৎ কীভাবে কার থেকে কতটা আদায় করে নিতে হয়, ওরা জানে। আমাদের সময়েও কি নিচুমানের শিক্ষক
ছিলেন না? তবুও আমরা তাঁদের বাতিল করতে পারি নি সম্ভ্রমে, শ্রদ্ধায়। এখনকার
ছেলেমেয়েরা সেটা সহজেই করে ফেলে। ভালো শিক্ষক এখনও নিশ্চয়ই আছেন,
থাকবেনও। ছাত্র-শিক্ষকের চিরকালীন এই বন্ধন থেকে যাবে ঠিক। শুধু বন্ডিং-এর ধরনটা
বদলাবে, এই যা!
0 কমেন্টস্:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন