প্রথম রমজান
রমজানের প্রথম দিনে রোজা রাখাটা বেশ মজার। দিনের শুরুটা একটু বেনিয়ম — ব্রাশ করা নেই, ব্রেকফাস্ট করা নেই। অনেক সময় অনেকেই এগুলোর কোনো কোনোটা বা দুটোই বাদ দিয়ে থাকেন। কিন্তু নিয়ম করে নিয়ম ভাঙার শুরুর দিনটা বেশ খুশির। দুপুরে লাঞ্চে যাওয়া নেই। সেই সময় চাইলেই যা খুশি পড়া যায়। আর সন্ধ্যের দিকে ইফতার নিয়ে একা একা বসে আগের আগের বছরগুলোতে কী কী ঘটেছিল তাই ভাবা।
আমার প্রথম রোজা রাখার অভিজ্ঞতা বেশ মনে আছে। সেদিন ছিল বেষ্পতিবার, আমাদের স্কুল ছুটি থাকত। সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখি বাপি চা খাচ্ছে, কিন্ত মায়ের চায়ের কাপ তোলা আছে যথাস্থানে। মা রোজা রেখেছে, তাই। আমার বায়না, আমিও রোজা রাখব। মা যুক্তি দিল — “তুই তো ব্রাশ করে নিয়েছিস।” আমি তখন ক্লাস ওয়ানে পড়ি, আমায় হারানো অতই সোজা? আমার মুতোড় জবাব — “ক্যালেণ্ডারে কোথায় লেখা আছে ব্রাশ করলে রোজা ভেঙে যায়?”
তখন কিছু কিছু দোকান থেকে রমজান মাসের ক্যালেণ্ডার দিত। ইংরাজি বা বাংলা বছরের তারিখের সঙ্গে মিলিয়ে রমজান মাসের তারিখ এবং সেহরি-ইফতারের সময়। ক্যালেণ্ডারের পাতা ভরাতে তাতে লেখা হতো সেহরির পর রোজা রাখার নিয়ত বা ইফতারের আগের দোয়া এইসব। আরও থাকত কী কী কারণে রোজা ভেঙে যেতে পারে, তার তালিকা। সেখানে আরও একবার তল্লাশি চালিয়ে মা আবিষ্কার করল আমার কথাই ঠিক, টুথপেস্টের ব্যবহারে রোজা ভেঙে যায় এমন কথা সেখানে লেখা নেই।
কিন্তু ঐটুকু ছেলেকে কি নির্জলা উপবাস করতে দেওয়া যায়? তাই মা খড়কুটোর মতো কিছু যুক্তি আঁকড়ে ধরল — “বাচ্চাদের রোজা রাখতে নেই। ক্যালেণ্ডারে সব কথা লেখা থাকে না।” ইত্যাদি। কিন্তু যা ছাপা অক্ষরে লেখা নেই, তাতে আমার বিশ্বাস তখন একেবারেই শিথিল। অতএব আমি রোজা রাখবই। মায়ের শেষ অস্ত্র — “রোজা রাখলে নামাজও পড়তে হবে। মুখে জালতি বাঁধা গরুর মতো ঘুরলে হবে না।” আমি তাতেই রাজি। বাড়ির কাছে মসজিদে গিয়ে নামাজ পড়া ছাড়া অন্যান্য বেষ্পতিবারের সঙ্গে পার্থক্য এমন কিছুই ছিল না। তারপর দিনের শেষে ইফতার সাজিয়ে বসা আর মা গরিবের আজানের সঙ্গে সঙ্গে ছোলা, আদা, খেজুর সহযোগে রোজা শেষ করা। সেদিন ইফতারের সেই সরবতের সঙ্গে এত মধুর তৃপ্তি মিশেছিল, ভোলার নয়!
তবে রোজা রাখাটা সব সময়ই যে সুন্দর অভিজ্ঞতা তা নয়। এক রমজান মাসে প্রাগে ছিলাম, তখন সেখানে গ্রীষ্ম। প্রাগের গ্রীষ্ম আমাদের শেষ বসন্তের মতোই মোহময়। কিন্তু সূর্যোদয় আর সূর্যাস্তের ব্যবধান এত বেশি যে, প্রথম দিনই ত্রাহি-ত্রাহি রব। প্রায় সতেরো ঘণ্টার ম্যারাথন রোজা। সেদিনটা ছিল রবিবার, তাই বাঁচোয়া। সোমবার অফিস। সাতটার পর আঙুল আর কি-বোর্ডের ওপর নড়তে চায় না। বাইরে ফটফটে সূর্যের আলো, বিকেল সবে। কিন্তু শরীরের ঘড়ি কী আর ঐ সূর্যাস্তের পাগলামো শুনতে চায়! প্রাগে থাকাকালীন সেই ছিল আমার সসেই রমজানের শেষউ পবাস।
অফিস করতে করতে রোজা রাখার প্রসঙ্গে হায়দ্রাবাদের কথা মনে পড়ে যায়। নিজামদের এই শহরে রমজান মাসে থাকাটা অনেক পূণ্যের ফল। রাস্তার ধারে সুস্বাদু হালিমের দোকান একের পর এক। মুম্বাইয়েও ব্যাপারটা এলাকা বিশেষে একইরকম, শুধু খুঁজে নিতে হয়। তবে সারা পৃথিবী ঘুরেও আমাদের পাড়ার হাসুকাকুর আলুর চপের মতো তৃপ্তি আর কোথাও নেই। কোনও আদিখ্যেতা নয়, নির্জলা সত্যি।
একটা মজার ঘটনা বলি। যদিও এটা রমজানের প্রথম দিনে ঘটেনি।
তখন আমি মিশনে পড়তাম। ক্লাস সেভেন। ক্লাস এইট থেকে বাধ্যতামূলক রোজা রাখতে হতো। তাই উঁচু ক্লাসের দাদারা আর সব স্যারেরা যখন ইফতারের জন্যে সারি দিয়ে বসেছেন হস্টেলের একতলা আর দোতলার বারান্দায়, আমরা তখনও মাঠে বল পেটাচ্ছি। ইফতার শুরু হওয়ার নিয়ম মাগরিবের আজানের সঙ্গে সঙ্গে। এজন্য সাধারণত মাইক্রোফোন এবং স্পিকারের ব্যবস্থা থাকত। কিন্তু সেদিন কোনও কারণে সেগুলো কাজ করছিল না। যেহেতু খালি গলায় আজান ওপর-নিচে ঠিক মতো শোনা যাবে না, তাই ব্যবস্থা করা হয়েছিল ঘণ্টা দেওয়ার। স্কুলে যেমন গোল থালার মতো ঘণ্টা থাকে, তেমনই একটা ঘণ্টা এবং হাতুড়ি আমাদের খাবার ঘরের পাশে রাখা থাকত। একবার ঘণ্টা পড়লে ফাইভ-সিক্স, দু’বারে সেভেন-এইট — এইভাবে সব ক্লাসের ছেলেরা ঘণ্টা শুনে খেতে আসত। আমাদের সুপারিনটেনডেন্ট হাসেম স্যারের তাড়ায় আমরা তখন মাঠ থেকে উঠে হাত-পা ধুচ্ছি। দেখি খাবার ঘরের ঘণ্টাটা হাতে নিয়ে বড় হুজুর রান্নাঘরের আবদুল্লাদাকে বোঝাচ্ছেন — “আমি দোতলার বারান্দা থেকে হাত নাড়লে ঘণ্টা দিবি।” আবদুল্লাদাও বেশ জোরে জোরে মাথা নাড়াচ্ছে।
এই ফাঁকে বলে নিই, বড় হুজুর ছিলেন আমাদের আর বি শিক্ষক। তিনি নামাজও পড়াতেন। এছাড়াও মিশনের বাজার করা থেকে ছেলেদের জন্যে রান্নার তদারকি এবং দাঁড়িয়ে থেকে সবাইকে খাওয়ানোর মতো গুরুদায়িত্ব পালন করতেন।
যাইহোক, হুজুর আবদুল্লাদাকে বুঝিয়ে যাওয়ার মিনিট তিনেক পর মদতস্যার নিচের বারান্দা থেকে কাকে যেন চেঁচিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন — “হ্যাঁরে, আজান দিচ্ছে নাকি? আওয়াজ পাচ্ছি মনে হচ্ছে।” আজান দেওয়ার তখনও মিনিট পাঁচেক দেরি ছিল। কিন্তু সামনে ইফতার নিয়ে বসে থাকতে থাকতে খিদে পাওয়াটা স্বাভাবিক, বিশেষত সারাদিন না খাওয়ার পরে। তাই বেশ কিছু ছাত্রও নিচ থেকে একই প্রশ্ন ছুঁড়ে দিল ওপরের বারান্দায়। নিচে ছাত্রদের গোলমাল থামাতে বড় হুজুর ওপর থেকে ধমক দিলেন — “চুপ!” ভুল করে বোধহয় হাতও নেড়ে ফেলেছিলেন। আবদুল্লাদা একদৃষ্টিতে দোতলার বারান্দার দিকে তাকিয়ে ছিল, হুজুর হাত নাড়লেই ঘণ্টা দেবে। সে বেচারাও সারাদিন না খেয়ে, কাঁহাতক আর খিদে চেপে রাখা যায়! তাই বড় হুজুরের হাতনাড়া দেখেই সে দিল ঘণ্টায় এক ঘা — ঠং!
বড় হুজুর দিশেহারা। তিনি ঘণ্টা দিতে বলেননি, অথচ ঘণ্টা পড়ে গেল। যারা সেই ঘণ্টা শুনে খেতে আরম্ভ করেছে, তাদের রোজা সম্পূর্ণ না হওয়ার পুরো দায় তাঁর ঘাড়ে। আবদুল্লাদার দিকে ওপর থেকে একটা ভষ্ম করে দেওয়া দৃষ্টি নিক্ষেপ করে তিনি চেঁচিয়ে সবাইকে খেতে বারণ করলেন। যাইহোক, অনেকেই খেজুর বা শসা মুখে পুরে দিয়েছিল। তারা ফলস এ্যালার্মের দায় ঘণ্টা এবং আবদুল্লাদার ওপর চাপিয়ে দিয়ে আবার অপেক্ষা করতে আরম্ভ করল। কয়েক মিনিট পর হুজুরের ইশারায় ঠিক ঘণ্টাটা পড়ল — ঠং!
কিন্তু যারা একবার ঠকেছে তারা কিছুতেই আর দ্বিতীয়বার ভুল করতে রাজি নয়। কে জানে বাবা! আবদুল্লাদা হয়তো আবার ভুল করেছে! তাছাড়া আজানের শব্দও তো কানে আসছে না! আবার নিচে থেকে অনেকে চেঁচাতে আরম্ভ করল — “হুজুর! এবার কি খাব? এটা কি ঠিক ঘণ্টা?” বড় হুজুর সবার চেঁচামেচিতে তিতিবিরক্ত হয়ে দোতলা থেকে নিচে এসে নিজের হাতে ঘণ্টা তুলে নিয়ে বললেন — “এই দ্যাখ। আমি ঘণ্টা দিচ্ছি। খা এবার সব। খাওয়ার জন্যেই তো রোজা রাখিস তোরা।” আবার ঘণ্টা পড়ল — ঠং!
পুরো ব্যাপারটা দেখে আমি বেশ মজা পেয়েছি তখন। আমার মনে হলো, একদিনে তিনটে ঘণ্টা পড়া মানে সেটা মিশনের ইতিহাসের পাতায় ঢুকে গেল। তা আমিও কেন ইতিহাস থেকে বাদ যাই? এদিক ওদিক দেখে নিয়ে ঘণ্টা আর হাতুড়ি তুলে নিয়ে আমিও এক ঘা বসালাম — ঠং!
ওমা! কে জানত, হুজুর কাছাকাছিই ছিলেন। আমার দিকে রে-রে করে তেড়ে এলেন। আমি কোনও মতে তাঁর পেল্লাই চাঁটি বাঁচিয়ে একছুটে ঘরের মধ্যে।
হুজুর নিচ থেকে তখন চেঁচাচ্ছেন শুনছি — “পালিয়ে যাবে কোথায়? একটু পরেই তো খেতে আসতে হবে।” আমার বুক শুকিয়ে গেল। কথাটা মিথ্যে নয়। বড় হুজুরের নজর গলে একটা মাছিও ডাইনিং রুমে ঢুকতে পারে না, আমি তো কোন ছার! সন্ধ্যেবেলা হুজুরের ভয়ে টিফিন করতেই গেলাম না। সাহিদদা এসে দুটো খবর দিল।
এক – বেগুনি-মুড়ি দিচ্ছে।বেগুনিটা নাকি খুবই ভালো হয়েছে।
দুই – বড় হুজুর সাহিদদাকে জিজ্ঞাসা করেছেন আমি কোথায়।
আমি মোটামুটি নিশ্চিত হয়ে গেলাম হুজুরের রাগ আজ রাতের মধ্যে আর পড়ছে না। কাল সকালে গিয়ে ক্ষমা-টমা চেয়ে নেব। এখন ক্ষমা চাইতে গেলে কপালে বিস্তর দুঃখ আছে। হয়তো কান ধরে খাবার ঘরের সামনে ঘণ্টাখানেক দাঁড়াতে হবে বা পিঠে ধাঁই ধপাধপ পড়বে।
সন্ধ্যেবেলা পড়া-টড়া হয়ে যাবার পর একটা ঘণ্টা পড়ল। ফাইভ-সিক্সের ছেলেরা খেয়ে এল। দুটো ঘণ্টা পড়ল সেভেন-এইটের সবাই গেল। আমি খালি রুমে খাটের ওপর বসে বিস্কুটের কৌটোটা তখনই খুলব নাকি আর একটু খিদে পেলে খুলব ভাবছি; এমন সময় সাহিদদা দেখি খেয়েদেয়ে একটা থালা হাতে নিয়ে ঢুকছে। স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে একটু হেসে-টেসে নিয়ে সে বলল — “বড় হুজুর বললেন, রোহণ মনে হয় আজ আর এদিকে আসবে না। তুই ওর ভাতটা নিয়ে রুমেই চলে যা।”
এখনও রমজান মাস এলে বড় হুজুরকে দারুণ মিস করি।
রমজানের প্রথম দিনে রোজা রাখাটা বেশ মজার। দিনের শুরুটা একটু বেনিয়ম — ব্রাশ করা নেই, ব্রেকফাস্ট করা নেই। অনেক সময় অনেকেই এগুলোর কোনো কোনোটা বা দুটোই বাদ দিয়ে থাকেন। কিন্তু নিয়ম করে নিয়ম ভাঙার শুরুর দিনটা বেশ খুশির। দুপুরে লাঞ্চে যাওয়া নেই। সেই সময় চাইলেই যা খুশি পড়া যায়। আর সন্ধ্যের দিকে ইফতার নিয়ে একা একা বসে আগের আগের বছরগুলোতে কী কী ঘটেছিল তাই ভাবা।
আমার প্রথম রোজা রাখার অভিজ্ঞতা বেশ মনে আছে। সেদিন ছিল বেষ্পতিবার, আমাদের স্কুল ছুটি থাকত। সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখি বাপি চা খাচ্ছে, কিন্ত মায়ের চায়ের কাপ তোলা আছে যথাস্থানে। মা রোজা রেখেছে, তাই। আমার বায়না, আমিও রোজা রাখব। মা যুক্তি দিল — “তুই তো ব্রাশ করে নিয়েছিস।” আমি তখন ক্লাস ওয়ানে পড়ি, আমায় হারানো অতই সোজা? আমার মুতোড় জবাব — “ক্যালেণ্ডারে কোথায় লেখা আছে ব্রাশ করলে রোজা ভেঙে যায়?”
তখন কিছু কিছু দোকান থেকে রমজান মাসের ক্যালেণ্ডার দিত। ইংরাজি বা বাংলা বছরের তারিখের সঙ্গে মিলিয়ে রমজান মাসের তারিখ এবং সেহরি-ইফতারের সময়। ক্যালেণ্ডারের পাতা ভরাতে তাতে লেখা হতো সেহরির পর রোজা রাখার নিয়ত বা ইফতারের আগের দোয়া এইসব। আরও থাকত কী কী কারণে রোজা ভেঙে যেতে পারে, তার তালিকা। সেখানে আরও একবার তল্লাশি চালিয়ে মা আবিষ্কার করল আমার কথাই ঠিক, টুথপেস্টের ব্যবহারে রোজা ভেঙে যায় এমন কথা সেখানে লেখা নেই।
কিন্তু ঐটুকু ছেলেকে কি নির্জলা উপবাস করতে দেওয়া যায়? তাই মা খড়কুটোর মতো কিছু যুক্তি আঁকড়ে ধরল — “বাচ্চাদের রোজা রাখতে নেই। ক্যালেণ্ডারে সব কথা লেখা থাকে না।” ইত্যাদি। কিন্তু যা ছাপা অক্ষরে লেখা নেই, তাতে আমার বিশ্বাস তখন একেবারেই শিথিল। অতএব আমি রোজা রাখবই। মায়ের শেষ অস্ত্র — “রোজা রাখলে নামাজও পড়তে হবে। মুখে জালতি বাঁধা গরুর মতো ঘুরলে হবে না।” আমি তাতেই রাজি। বাড়ির কাছে মসজিদে গিয়ে নামাজ পড়া ছাড়া অন্যান্য বেষ্পতিবারের সঙ্গে পার্থক্য এমন কিছুই ছিল না। তারপর দিনের শেষে ইফতার সাজিয়ে বসা আর মা গরিবের আজানের সঙ্গে সঙ্গে ছোলা, আদা, খেজুর সহযোগে রোজা শেষ করা। সেদিন ইফতারের সেই সরবতের সঙ্গে এত মধুর তৃপ্তি মিশেছিল, ভোলার নয়!
তবে রোজা রাখাটা সব সময়ই যে সুন্দর অভিজ্ঞতা তা নয়। এক রমজান মাসে প্রাগে ছিলাম, তখন সেখানে গ্রীষ্ম। প্রাগের গ্রীষ্ম আমাদের শেষ বসন্তের মতোই মোহময়। কিন্তু সূর্যোদয় আর সূর্যাস্তের ব্যবধান এত বেশি যে, প্রথম দিনই ত্রাহি-ত্রাহি রব। প্রায় সতেরো ঘণ্টার ম্যারাথন রোজা। সেদিনটা ছিল রবিবার, তাই বাঁচোয়া। সোমবার অফিস। সাতটার পর আঙুল আর কি-বোর্ডের ওপর নড়তে চায় না। বাইরে ফটফটে সূর্যের আলো, বিকেল সবে। কিন্তু শরীরের ঘড়ি কী আর ঐ সূর্যাস্তের পাগলামো শুনতে চায়! প্রাগে থাকাকালীন সেই ছিল আমার সসেই রমজানের শেষউ পবাস।
অফিস করতে করতে রোজা রাখার প্রসঙ্গে হায়দ্রাবাদের কথা মনে পড়ে যায়। নিজামদের এই শহরে রমজান মাসে থাকাটা অনেক পূণ্যের ফল। রাস্তার ধারে সুস্বাদু হালিমের দোকান একের পর এক। মুম্বাইয়েও ব্যাপারটা এলাকা বিশেষে একইরকম, শুধু খুঁজে নিতে হয়। তবে সারা পৃথিবী ঘুরেও আমাদের পাড়ার হাসুকাকুর আলুর চপের মতো তৃপ্তি আর কোথাও নেই। কোনও আদিখ্যেতা নয়, নির্জলা সত্যি।
একটা মজার ঘটনা বলি। যদিও এটা রমজানের প্রথম দিনে ঘটেনি।
তখন আমি মিশনে পড়তাম। ক্লাস সেভেন। ক্লাস এইট থেকে বাধ্যতামূলক রোজা রাখতে হতো। তাই উঁচু ক্লাসের দাদারা আর সব স্যারেরা যখন ইফতারের জন্যে সারি দিয়ে বসেছেন হস্টেলের একতলা আর দোতলার বারান্দায়, আমরা তখনও মাঠে বল পেটাচ্ছি। ইফতার শুরু হওয়ার নিয়ম মাগরিবের আজানের সঙ্গে সঙ্গে। এজন্য সাধারণত মাইক্রোফোন এবং স্পিকারের ব্যবস্থা থাকত। কিন্তু সেদিন কোনও কারণে সেগুলো কাজ করছিল না। যেহেতু খালি গলায় আজান ওপর-নিচে ঠিক মতো শোনা যাবে না, তাই ব্যবস্থা করা হয়েছিল ঘণ্টা দেওয়ার। স্কুলে যেমন গোল থালার মতো ঘণ্টা থাকে, তেমনই একটা ঘণ্টা এবং হাতুড়ি আমাদের খাবার ঘরের পাশে রাখা থাকত। একবার ঘণ্টা পড়লে ফাইভ-সিক্স, দু’বারে সেভেন-এইট — এইভাবে সব ক্লাসের ছেলেরা ঘণ্টা শুনে খেতে আসত। আমাদের সুপারিনটেনডেন্ট হাসেম স্যারের তাড়ায় আমরা তখন মাঠ থেকে উঠে হাত-পা ধুচ্ছি। দেখি খাবার ঘরের ঘণ্টাটা হাতে নিয়ে বড় হুজুর রান্নাঘরের আবদুল্লাদাকে বোঝাচ্ছেন — “আমি দোতলার বারান্দা থেকে হাত নাড়লে ঘণ্টা দিবি।” আবদুল্লাদাও বেশ জোরে জোরে মাথা নাড়াচ্ছে।
এই ফাঁকে বলে নিই, বড় হুজুর ছিলেন আমাদের আর বি শিক্ষক। তিনি নামাজও পড়াতেন। এছাড়াও মিশনের বাজার করা থেকে ছেলেদের জন্যে রান্নার তদারকি এবং দাঁড়িয়ে থেকে সবাইকে খাওয়ানোর মতো গুরুদায়িত্ব পালন করতেন।
যাইহোক, হুজুর আবদুল্লাদাকে বুঝিয়ে যাওয়ার মিনিট তিনেক পর মদতস্যার নিচের বারান্দা থেকে কাকে যেন চেঁচিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন — “হ্যাঁরে, আজান দিচ্ছে নাকি? আওয়াজ পাচ্ছি মনে হচ্ছে।” আজান দেওয়ার তখনও মিনিট পাঁচেক দেরি ছিল। কিন্তু সামনে ইফতার নিয়ে বসে থাকতে থাকতে খিদে পাওয়াটা স্বাভাবিক, বিশেষত সারাদিন না খাওয়ার পরে। তাই বেশ কিছু ছাত্রও নিচ থেকে একই প্রশ্ন ছুঁড়ে দিল ওপরের বারান্দায়। নিচে ছাত্রদের গোলমাল থামাতে বড় হুজুর ওপর থেকে ধমক দিলেন — “চুপ!” ভুল করে বোধহয় হাতও নেড়ে ফেলেছিলেন। আবদুল্লাদা একদৃষ্টিতে দোতলার বারান্দার দিকে তাকিয়ে ছিল, হুজুর হাত নাড়লেই ঘণ্টা দেবে। সে বেচারাও সারাদিন না খেয়ে, কাঁহাতক আর খিদে চেপে রাখা যায়! তাই বড় হুজুরের হাতনাড়া দেখেই সে দিল ঘণ্টায় এক ঘা — ঠং!
বড় হুজুর দিশেহারা। তিনি ঘণ্টা দিতে বলেননি, অথচ ঘণ্টা পড়ে গেল। যারা সেই ঘণ্টা শুনে খেতে আরম্ভ করেছে, তাদের রোজা সম্পূর্ণ না হওয়ার পুরো দায় তাঁর ঘাড়ে। আবদুল্লাদার দিকে ওপর থেকে একটা ভষ্ম করে দেওয়া দৃষ্টি নিক্ষেপ করে তিনি চেঁচিয়ে সবাইকে খেতে বারণ করলেন। যাইহোক, অনেকেই খেজুর বা শসা মুখে পুরে দিয়েছিল। তারা ফলস এ্যালার্মের দায় ঘণ্টা এবং আবদুল্লাদার ওপর চাপিয়ে দিয়ে আবার অপেক্ষা করতে আরম্ভ করল। কয়েক মিনিট পর হুজুরের ইশারায় ঠিক ঘণ্টাটা পড়ল — ঠং!
কিন্তু যারা একবার ঠকেছে তারা কিছুতেই আর দ্বিতীয়বার ভুল করতে রাজি নয়। কে জানে বাবা! আবদুল্লাদা হয়তো আবার ভুল করেছে! তাছাড়া আজানের শব্দও তো কানে আসছে না! আবার নিচে থেকে অনেকে চেঁচাতে আরম্ভ করল — “হুজুর! এবার কি খাব? এটা কি ঠিক ঘণ্টা?” বড় হুজুর সবার চেঁচামেচিতে তিতিবিরক্ত হয়ে দোতলা থেকে নিচে এসে নিজের হাতে ঘণ্টা তুলে নিয়ে বললেন — “এই দ্যাখ। আমি ঘণ্টা দিচ্ছি। খা এবার সব। খাওয়ার জন্যেই তো রোজা রাখিস তোরা।” আবার ঘণ্টা পড়ল — ঠং!
পুরো ব্যাপারটা দেখে আমি বেশ মজা পেয়েছি তখন। আমার মনে হলো, একদিনে তিনটে ঘণ্টা পড়া মানে সেটা মিশনের ইতিহাসের পাতায় ঢুকে গেল। তা আমিও কেন ইতিহাস থেকে বাদ যাই? এদিক ওদিক দেখে নিয়ে ঘণ্টা আর হাতুড়ি তুলে নিয়ে আমিও এক ঘা বসালাম — ঠং!
ওমা! কে জানত, হুজুর কাছাকাছিই ছিলেন। আমার দিকে রে-রে করে তেড়ে এলেন। আমি কোনও মতে তাঁর পেল্লাই চাঁটি বাঁচিয়ে একছুটে ঘরের মধ্যে।
হুজুর নিচ থেকে তখন চেঁচাচ্ছেন শুনছি — “পালিয়ে যাবে কোথায়? একটু পরেই তো খেতে আসতে হবে।” আমার বুক শুকিয়ে গেল। কথাটা মিথ্যে নয়। বড় হুজুরের নজর গলে একটা মাছিও ডাইনিং রুমে ঢুকতে পারে না, আমি তো কোন ছার! সন্ধ্যেবেলা হুজুরের ভয়ে টিফিন করতেই গেলাম না। সাহিদদা এসে দুটো খবর দিল।
এক – বেগুনি-মুড়ি দিচ্ছে।বেগুনিটা নাকি খুবই ভালো হয়েছে।
দুই – বড় হুজুর সাহিদদাকে জিজ্ঞাসা করেছেন আমি কোথায়।
আমি মোটামুটি নিশ্চিত হয়ে গেলাম হুজুরের রাগ আজ রাতের মধ্যে আর পড়ছে না। কাল সকালে গিয়ে ক্ষমা-টমা চেয়ে নেব। এখন ক্ষমা চাইতে গেলে কপালে বিস্তর দুঃখ আছে। হয়তো কান ধরে খাবার ঘরের সামনে ঘণ্টাখানেক দাঁড়াতে হবে বা পিঠে ধাঁই ধপাধপ পড়বে।
সন্ধ্যেবেলা পড়া-টড়া হয়ে যাবার পর একটা ঘণ্টা পড়ল। ফাইভ-সিক্সের ছেলেরা খেয়ে এল। দুটো ঘণ্টা পড়ল সেভেন-এইটের সবাই গেল। আমি খালি রুমে খাটের ওপর বসে বিস্কুটের কৌটোটা তখনই খুলব নাকি আর একটু খিদে পেলে খুলব ভাবছি; এমন সময় সাহিদদা দেখি খেয়েদেয়ে একটা থালা হাতে নিয়ে ঢুকছে। স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে একটু হেসে-টেসে নিয়ে সে বলল — “বড় হুজুর বললেন, রোহণ মনে হয় আজ আর এদিকে আসবে না। তুই ওর ভাতটা নিয়ে রুমেই চলে যা।”
এখনও রমজান মাস এলে বড় হুজুরকে দারুণ মিস করি।
0 কমেন্টস্:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন