কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

সোমবার, ২৭ অক্টোবর, ২০১৪

০৯) অলোকপর্ণা


মাতালদা

গভীর রাতে, পাড়ায় চাঁদ উঠলে মাতালদা বাড়ি ফেরে। জেগে থাকলে এরপরই রত্নামাসি প্রচুর ক্যালায় ওকে। গালিগালাজ-চিৎকার ভরা সে সব রাতে ঘুমটা আমার স্মুদলি এসে যায়। অন্যান্য দিন অপেক্ষা করতে করতে বারান্দার দেওয়ালে হেলান দিয়ে রত্নামাসি ঘুমিয়ে গেলে, মাতালদা যখন টলতে টলতে ঘরে ঢুকেই আবার বেরিয়ে এসে রত্নামাসির কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়ে, বাথরুম করতে উঠে বারান্দায় উঁকি দিয়ে যাওয়া আমার আর ঘুম আসে না।

রত্নামাসি মাতালদার বউ, তিনি বয়সের নিয়মেই আমার মাসি ছিলেন, আর মাতালদা পাড়ার সব্বাইকার দাদা। এই পাড়াতুতো নামগুলো ছোটবেলার হাঁটুতে, কনুইটায় বা থুতনির খেলতে গিয়ে কেটে যাওয়া দাগগুলোর মতোই; চাঁদ,   তারা, সূর্যের মতো প্রাচীনতম। হঠাৎ একদিন যাতে হাত পড়তে খেয়াল হয়, একদিন ব্যথা লেগেছিল! নিজের নামের থেকেও একটা প্রাচীন লণ্ড্রীর দোকান ছিল মাতালদার। তার সাইন বোর্ডটা আরোই প্রাচীন ছিল বলে তাতে লেখা মাতালদার আসল নামটা আর বোঝা যেত না। মধ্যবিত্ত নব্বইয়ের দশকে যখন সেখানে পাড়ার লোক জামা কাপড় নিয়ে জড়ো হতো, দোকানের শো কেসে  সাদা জামা সাদা প্যান্ট পরা বলিউডি নায়ক হাসিমুখে দাঁড়িয়ে থাকত, কলকাতা কে পাশ কাটিয়ে মাতালদার বুধবারের আগে পারব না শুনতে শুনতে আমরা ইস্কুলে চলে যেতাম। কয়লার আঁচে গরম সেই ইস্ত্রি তুলতে তুলতে মাতালদার টি বি ধরা পড়লে দোকানটা বন্ধ করে দিতে হয়। বোধহয় এর পর থেকেই মাতালদা মাতালদা হয়েছিল। স্কুলে আসা যাওয়ার পথে লণ্ড্রী পার করার সময় তবু আমরা কয়লার গন্ধ পেয়েছি বেশ কবছর। তারপর এক সময় আর গন্ধটা খেয়াল করতাম না, যেমন খেয়াল নেই ঠিক কখন মাতালদা মাতালদা হয়ে উঠল, আর প্রায়ই রাতে রত্নামাসির গালি আর মাতালদার চিৎকার শুনতে শুনতে ঘুমোনো অভ্যাস করে ফেললাম আমি।

যেসব রাতে মাতালদা বাড়ি ফিরত না, বুঝতাম সকাল হলে তাকে নিয়ে নয়া খোরাক পাড়ায় আসতে চলেছে। মাতালদাকে নাকি কোনো পৌরসভার বাঁধানো  ড্রেনে পা ঝুলিয়ে বসে থাকতে দেখা গেছে আগের রাতে, জিজ্ঞেস করলে উত্তর পাওয়া গেছে, ঢেউ গুনছি। অথবা রাস্তার অন্ধকার রকে বসা মাতালদার মুখে টর্চের আলো ফেলতে সে বলে উঠেছে, উফ, আস্তে! কানে লাগছে...!
টর্চ নিভে যেত। এসব রাত শেষে বাথরুম করতে উঠে বারান্দায় উঁকি মারতে  গিয়ে দেখতাম, রত্নামাসি মাতালদা
কে ধরে ধরে নিয়ে ঘরে ঢুকে পড়তেই বারান্দার দেওয়ালে, হেলান দিয়ে ঘুমিয়ে পড়তে পড়তে তৈরি হওয়া রত্নামাসির মাথার তেলচিটে দাগে ভোর হচ্ছে। যদিও আমরা জানতাম, বাপিকাকুর সাথে  রত্নামাসির তখন খুব চলছে, তবু ওইসব ভোরবেলয় তা মনে করতাম না আমি। তাই এরপর আর ঘুম আসত না আমার।

একটু বড় হতে কোচিং ক্লাস বাঙ্ক করা শিখলাম যখন, তখন বি গ্রেডেড সিনেমা হলের নাইট শোতে ঢুকলে প্রায়ই রত্নামাসি আর বাপি কাকুকে অন্ধকারে দেখতে পেতাম। যেহেতু আমি আর রত্নামাসি দুজনেই অপরাধী, সেহেতু দুজনের মধ্যে পারস্পরিক বোঝাপড়া তৈরি হয়ে গিয়েছিল। তেমনই এক  রাতে মিস সোনালীর শরীর দুলিয়ে নাচ চলাকালীন বাপিকাকু রত্নামাসির কোলে মাথা রেখে শুতেই কোত্থেকে তাদের সামনে এসে দাঁড়ায় মাতালদা, শালা খানকী বাপিকে এলোপাথাড়ি মারতে শুরু করতেই হলের জনা চল্লিশেক মুখ তাদের দিকে ফিরে যায়। দুটো টর্চ তখন হলের দরজার দিকে থেকে রত্না মাসিদের দিকে ছুটে আসতেই সুযোগ বুঝে আমি পালিয়ে আসি। আর প্রার্থনা করি যেন মাতালদা আমায় খেয়াল না করে।
সেদিন রাতে অনেক চিৎকার আর গালির আওয়াজে ঘুম আসতে আসতে শুনতে পেয়েছিলাম মাতালদা আর্তনাদ করে উঠল,
তুমি আমায় মাতাল বললে!
রত্নামাসির চিৎকার,
হ্যাঁ, কারণ তুই তাই।
পরদিন সকালে উঠে শুনেছিলাম এরপরেই নাকি রত্নামাসিকে ঘর থেকে ধাক্কা মেরে বের করে দিয়েছিল মাতালদা। অথচ পাড়ার সবাই ওকে
মাতাল বলেই ডেকে এসেছে এতদিন।

রত্নামাসি বাপিকাকুর সাথে পাড়া ছেড়ে দেওয়ার পর এক সপ্তাহ মাতালদা মদ ছোঁয়নি। বাথরুমে যাওয়ার ফাঁকে বারান্দায় উঁকি দিলে আমি দেখতে পেতাম, মাতালদা বারান্দার দেওয়ালের তেলচিটে দাগটার সামনে, মেঝেতে শুয়ে আছে।  এরকমই এক সপ্তাহ পর ঠিক রাত বারোটা আটে পাড়ায় চাঁদ উঠলে মাতালদাকে বারান্দায় উঠে আসতে দেখি। দেখি কয়েক মুহূর্ত তেলচিটে দাগের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থেকে
ধুর বাল বলে মাতালদা আবার রাস্তায় নেমে এলো। টলতে টলতে হাঁটতে থাকা মাতালদাকে অদ্ভুত ভাবে রাস্তার কুকুরগুলো  কিচ্ছু বলল না। পাশ কাটিয়ে চলে যাওয়া রাতবাইক দেখে ওরা হয়ত তখন ভেবেছিল লোকটা ঠিকমতো ফিরে আসবে তো সকাল বেলা? আর তখনই, ঠিক তখনই কুকুরগুলোর মধ্যে ঈশ্বর নেমে আসেন।
ঘরে ফিরে আসার সময় মাতালদার বারান্দার দেওয়ালে তেলচিটে দাগটা আমি দেখে ফেলি। এসব রাতে আমার আর ঘুম আসে না।

0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন