কালিমাটি অনলাইন

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

সোমবার, ২৭ অক্টোবর, ২০১৪

০৭) মেঘ অদিতি


অন্তর্মুখ

বনের অনেকটা গভীরে বাঁক খেলে গেছে যে পথটা, সে পথ ধরে হেঁটে চলেছে এক বৌদ্ধ শ্রমণ। তার গেরুয়ার রঙ দুলে দুলে আদর ছড়াচ্ছে ঘাসের সবুজে। আকাশটা ঠিক নীল নয় আজ, দারুণ এক বেগুনি আভার আকাশ হয়ে উঠেছে!

কোথাও বেজে উঠল ঢাক আচমকা দ্রিমি-দ্রিমি-দ্রিমি। বহুদূর থেকে ক্রমে ঘন হয়ে এলো তার আওয়াজ। তারপর আবার হঠাৎ সেই দ্রিমি-দ্রিমি শব্দ বদলে হয়ে গেল  ঝন ঝন ঝন আর ভেসে এলো এক তীক্ষ্ণ চিৎকার। ওই তীক্ষ্ণতা আমাকে ভয় পাইয়ে দিল মনে হতে থাকল, সমস্ত পৃথিবী ঝনঝন শব্দে ভেঙে পড়ছে।

স্বপ্ন থেকে নিজেকে ফেরাতে যেটুকু সময় লাগল, তার ভেতর প্রথমেই মনে এলো, মিঠু নির্ঘাত কিছু একটা অপকর্ম করেছে, নইলে ছোটমা অত রেগে গেল কেন? তারপর মনে হলো, মিঠুকে মা তো অত বকে না, যতটা বকে আমাকে বা দেয়াকে। দুরুদুরু  বুকে পাশ ফিরে দেয়াকে ডাকতে গিয়ে মনে পড়ল, দেয়া নেই। গত সন্ধ্যাতেই ও চলে গেছে হস্টেলেটুপ করে এক দলা দানাদার ঈর্ষা জুড়ে বসল মনেচোখ কুঁচকে তাকালাম ওর বালিশটার দিকে। বালিশের এক কোণে দেয়ার মাথার একটা চুল নির্বিকার চেয়ে আছে আমার দিকে আহ... বুকটা ফাঁকা ফাঁকা ফের

ও দেয়া... ও দেয়াং আমায় ফেলে হস্টেলে চলে গেলি কেন রে?

একটা ছায়া দুলে উঠল ঘরের দেওয়ালেতাকিয়ে দেখি দরজায় মিঠু  দাঁড়িয়ে। বুয়া এত্তগুলো প্লেট ভেঙে ফেলেছে, তাই মা খুব রেগে গেছে, আর তোকেও খুব বকছে  এখনও ঘুমাচ্ছিস বলে গম্ভীর গলায় একটানা বলেই ও দৌড়ে পালাল। মিঠুটা মায়ের খুব ন্যাওটা। হবে নাই বা কেন, মিঠুর বয়স যখন মোটে এক বছর তখনই আমাদের মা আমাদের ফেলে কোনো এক সকালে কোথায় যেন হারিয়ে গেল! তারপর ছোটমা সংসারে এলো, আর তখন সেই ছন্নছাড়া সংসারে মিঠু ছোটমাকে আঁকড়ে ধরল দু’হাতে ছোটমা'ও মিঠুকে বুকে টেনে নিয়েছিল তখন, তাইতো আমাদের চাইতে ছোটমা ঢের বেশি মা হয়ে উঠতে পেরেছে মিঠুর কাছেই

আমাদের মা, না বাড়িতে একটাও ছবি নেই তার। বাবা কবে সেসব কোথায় সরিয়ে দিয়েছে সত্যি বলতে আজকাল মনে মনেও তাকে আর খুঁজে পাই না। মা তো  হারিয়েই গেছে আমাদের জীবন থেকে অথবা নিজেকে সরিয়ে নিয়েছে আমাদের কাছ থেকে এত দূরে যে, চাইলেও তার নাগাল আর কখনও পাব না আমরা। মাকে খুব  ভাবতে গেলে মনে পড়ে মা'র দীঘল ঘন চুলে এসে পড়েছে সূর্য কিরণ। মা দুলে দুলে  কী একটা গান গাইছে। তারপর হঠাৎ একসময় হারিয়ে যায় মা আর কোথাও তাকে পাই না।

বিছানা ছাড়তে গিয়ে মনে পড়ল, আজ ভর্তি পরীক্ষার রেজাল্ট দেবে। দেয়া কি আগে ভাগেই হস্টেলের নামে তাই সরে পড়ল যাতে যে কোনো রকম নাজুক পরিস্থিতি এড়ানো যায়! কে জানে। দেয়াটা খুব মেধাবীঢাকা মেডিকেলে গত বছরই ও চান্স  পেয়ে এখন দিব্যি আছে, আমার মতো লুকিয়ে তাকে চলতে হয় না। আমার হয়নি। আর্মড ফোর্সেস মেডিকেল কলেজ ভর্তি পরীক্ষার নিয়ম অনুযায়ী শারীরিক যোগ্যতা না থাকায় আমি সেখানে পড়ার সুযোগ পাইনিএকটার বেশি ভর্তি পরীক্ষা দেওয়া যাবে না, একথা বাবা শুরুতেই আমাদের দু' বোনকে জানিয়েছিল। পরীক্ষার জন্য কোথাও  কোচিং অব্দি আমাদের নেওয়া হয়নি, বাবার কড়া নিষেধ। তবু দেয়া বাধা টপকে ঠিক লক্ষ্যে পৌঁছাতে পেরেছে, অথচ আমি... কী করব, আমার যে প্রায়ই জ্বর হয়!  জ্বর এলে শরীর এত খারাপ লাগে যে, আমি কিছু খেতেও পারি না।

ডাইনিংরুমে ভয়ে ভয়ে উঁকি দিলাম একবার। বাবা নেই। মিঠু টেবিলে বসে হোম ওয়ার্ক করছে। আমাকে দেখে পেন্সিল কামড়াতে কামড়াতে মা'কে বলল, মা রিয়াআপু  এসেছে। ছোটমা আমার দিকে একবার তাকিয়ে মুখ ফিরিয়ে নিল। বিরক্তি নিয়ে আমার জন্য রাখা রুটি আর আলু ভাজার প্লেটটা সামান্য ঠেলে দিয়ে বলল, দিনরাত পড়ে পড়ে ঘুমোলে আর চান্স মিলবে কোথায়! শুনেই ভেতরটা চুপসে এইটুকনি হয়ে গেল। এবারও যদি চান্স না পাই, কী যে হবে! না পারার যন্ত্রণা নিয়ে রোগা শরীরে আমি তো এমনিতেই নেই হয়ে আছি, এবারও যদি ভাগ্য প্রসন্ন না হয়... রুটিটা বিস্বাদ লাগছে।

দেয়াকে টেক্সট করলাম, ভীষণ ভয় ভয় করছে বলে। দেয়া উত্তরে শান্ত থাকতে বলে জানালো, ক্লাস শেষ হলে আমাকে কল করবে। বেলা বাড়তে থাকল আপন মনে সঙ্গে রাজ্যের কোলাহল নিয়ে। আমার বুকের ভেতরটায় থেকে থেকে হাঁপ ধরল, হাঁপ ছেড়ে জাগল আশা, ফের শীত শীত করতে লাগল

ঘড়িতে বারোটা

টিভির নিউজ চ্যানেল অন করলাম। সুন্দরী সংবাদ পাঠিকা হাসিমুখে খবর পড়ছে। নিচে স্ক্রল করছে ব্রেকিং নিউজ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের 'ক' ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষার  ফল প্রকাশ।

কম্পিউটার খুলে নিজের রোল নাম্বারটা দিয়ে রেজাল্ট সার্চ করতে হাত কেঁপে যাচ্ছে বারবার। ভুলভাল রোল নাম্বার টাইপ করছি। দেয়াটা থাকলে তবু একটু ভরসা পেতাম মনে।

পুরো রেজাল্টশীটের কোথাও নিজের রোল নাম্বারটা খুঁজে পাচ্ছি না। চারদিক ঝাপসা লাগছেছোট মায়ের ফোন বাজছে

বাবা ফোন করেছে। টুকরো টুকরো শব্দগুলো মায়ের ঘর থেকে ছিটকে ছিটকে আসছে  আমার দিকে।

টিভির স্ক্রিনে স্ক্রলিং নিউজ, ভারতের অন্ধ্রপ্রদেশ ও উড়িষ্যার দিকে ধেয়ে আসছে প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড় 'হুদহুদ'



0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন