কালিমাটি অনলাইন

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

বুধবার, ৩০ জুলাই, ২০১৪

০৩) অর্ক চট্টোপাধ্যায়


ফ্রি ইনকামিং কল


তাকিয়ে দেখলাম মোবাইল ফোনটার দিকে। টেবিলের ওপর দিব্যি শুয়ে রয়েছে, হয়তো আলতো করে একটু ঘুমিয়েও নিচ্ছে। মনে মনে ভাবলাম, কখন ফোন আসবে আর শয়তানটার নিদ্রাভঙ্গ হবে! অথচ ওই ফোনে যদি আর কোনোদিন কোনো ফোন না আসে, তাহলেই আমার সব থেকে খুশি হবার কথা! আমি চাই ওই ফোনের মৃত্যু হোক। এখুনি সারা জীবন জ্বালিয়ে এখনো শান্তি হয়নি হতচ্ছাড়ার

যে ফোনটাকে টেবিলের ওপর শুয়ে থাকতে দেখছেন কিম্বা অন্তত আমার মনে মনে চেবানো এই শব্দগুলো ভেদ করে দেখার চেষ্টা করছেন আপনারা, সেটি আমার  জীবনের শেষ মোবাইল ফোন। এর আগে আমার অন্য কোনো মোবাইল ফোন ছিল কিনা তা আমি নিজেও ভুলে গেছি আজকাল এতটাই প্রাগৈতিহাসিক মনে হয় ওই হতচ্ছাড়া ফোনের আগের সব কিছু, কেমন যেন ঝাপসা হয়ে যায় মাথাটা; যেন  তখনো মানুষ আগুন জ্বালাতে শেখেনি। 

ঝামেলাটা অবশ্য এই অধমের কল্যাণেই শুরু হয়েছিল আমার ফোনে আমি লাইফটাইম ইনকামিং কার্ড ভরিয়েছিলাম। অর্থাৎ পৃথিবী ধ্বংস হয়ে গেলেও আমার ইনকামিং কল বন্ধ হবে না। কিন্তু এহেন জাঁদরেল কার্ড ভরিয়ে সবে মাত্র নিশ্চিন্ত মনে ব্যালেন্স চেক করছি, যন্ত্রকন্ঠে উদ্ভট ইংরেজি উচ্চারণে কোনো এক ভদ্রমহোদয়া  বলে উঠলেন, ইওর সার্ভিস উইল বি ডিসকানেক্টেড ইফ ডু  নট রিচার্জ বাই  সেপ্টেম্বর এইটটিনটু থাউস্যান্ড টুয়েন্টি সিক্স” তবে রে! এত বড় কথা! ঝুপ করে  গেল মাথাটা গরম হয়ে। সঙ্গে সঙ্গে মোবাইল কোম্পানি অফিসে গিয়ে হানা দিলাম।  ডেস্কের উল্টো দিকের মেয়েটিকে বললাম, এই যে ম্যাডাম, কী ধরনের জোচ্চুরি!   আমি ভরলাম লাইফটাইম ইনকামিং, আর এখানে বলে কিনা অনলি টিল টু থাউস্যান্ড টুয়েন্টি সিক্স! আপনাদের কি ধারণা, আমার তো একটি সতেজ যুবকের আয়ু আর   মাত্র বারো বছর! এইটা শোনার পর থেকে আমার রাতের ঘুম উড়ে গেছে,   খাবারদাবারও ঠিকমতো হজম হচ্ছে না। এর চলতে থাকলে তো আমি এক ডজন   বছর ঘোরার আগেই পটল তুলব ম্যাডাম! মানুষের কনফিডেন্স কেড়ে নেবার  অধিকার আপনাদের কে দিল বলুন দেখি? মেয়েটি আমার কথা শুনে আমার দিকে   এমনভাবে তাকালো যেন আমি ভারত বিশ্বকাপ ফুটবলে কোয়ালিফাই করে গেছে, এজাতীয় কোনো কথা বলেছি। খানিকক্ষণ থতমত খেয়ে শেষে বলল, স্যার, ওটা  আপনার লাইফটাইম নয়, ওটা মোবাইলসেটের লাইফটাইম আর কি! আমাদের তো একটা নির্দিষ্ট সময় ধরে নিতে হয়, তাই ১২ বছর আমাদের সেটটা চলবে, এমন   একটা সময় ধার্য করা হয়েছে যদিও এই কথা শুনে আমি কিঞ্চিৎ আশ্বস্ত হলাম,  কিন্তু সঙ্গে সঙ্গেই আমার যুক্তিনিষ্ঠ জিজ্ঞাসু মন থেকে পরবর্তী প্রশ্নটা সুরুৎ করে বেরিয়ে এলো, আচ্ছা আপনি এতটা শিওর হয়ে কী করে বলতে পারেন যে, এই  সেটটা ১২ বছরই টিকবে! ১১ বা ১৩ বছরও তো টিকে যেতে পারে!  সেক্ষেত্রে  আমরা লাইফটাইম ইনকামিং কার্ডের কী হবে আমি জানতে চাই এবার  মেয়েটির মুখের ভাবটা খানিক ভারতীয় ক্রিকেট টিমের ওভারসিজ পারফরমেন্সের মতো হয়ে উঠল সে ঠিক কী বলবে, ভেবে পেল না। 

যাক এরপর থেকে নানা যুদ্ধ হয়েছে। আমার নাছোড়বান্দা আক্রমণের জ্বালায় কোম্পানি বাধ্য হয়ে আমায় জানায়, ফোন যতদিন কাজ করবে ততদিনই   আমি ফ্রি ইনকামিং পাব এবং এরকম একটা সুখবর পেয়ে আমি আনন্দিত হই। আর ওই আনন্দেই যেন তন্দ্রা লেগে যায়। এরপর ওই মর্কট ফোন ১২, ১৫, ২০, ২২  ছাপিয়ে ৩০ বছরের দিকে পা বাড়ায়। আগে কোম্পানি যিনি বস ছিলেন, তাঁর    মহাপ্রয়াণের পর যখন তাঁর ছেলে মসনদে এসে বসেন, তিনি ৩০ বছর ধরে চলতে  থাকা এমন তাজ্জব ফোনের খবর পেয়ে তৎক্ষণাৎ আমাকে ওদের কোম্পানি মোবাইল  ফোন প্রোমোট করার জন্য অনুরোধ জানান। ততদিনে আমি রিটায়ারও করেছি।  কাজের চাপ কম থাকায় আমিও খোশ মেজাজে ওই বিজ্ঞাপন করে পাড়ার ক্লাবের সান্ধ্য আড্ডায় কিছুটা নামযশ কুড়োই আর কী কিন্তু ক্রমে ফোন যখন ৪০ আর  আমি ৭০এ পা দিই, তখন আমার আস্তে আস্তে বিরক্ত লাগতে থাকে। আমি বুড়ো   হয়ে গেলাম, ফোনটার মরণ তো দূরস্থান, একটু ক্ষয়ক্ষতিও হলো না! বহাল তবিয়তে  রয়েছে মক্কেল। ক্রমশ আমার ৭৫, ফোনের ৪৫ নাহ, এবার গা জ্বলে উঠতে থাকে ঈর্ষায়। মনে হয়, একদিন আমি মরে যাব, কিন্তু এই শয়তান ঠিক রয়ে যাবে। আমার কেনা কবেকার এই ন্তরটা শেষে আমাকেই টেক্কা দিয়ে যাবে? আমার ৭৯,  ফোনের ৪৯ ইতিহাস হয়ে গেল আদিপ্রস্তর যুগের পর ভারতের ফুটবল টীম বিশ্বকাপে খেলার সুযোগ পেয়ে গেল, ক্রিকেট টিমও ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া আর সাউথ আফ্রিকায় পরপর তিনটে সিরিজ জিতে ঘরে ফিরল; কিন্তু না, এই শয়তান ফোন  হাফ সেঞ্চুরীর মুখে, তখনও দিব্যি লড়ে যাচ্ছে। ফোনের ওপ্রান্তে গলাগুলো সব  মরে পাল্টে গেলেও এই ফোন মৃত্যুহীন। ঠিক করলাম ৫০ বছর হয়ে যাক, তারপর একটা দিনও যদি বাঁচতে দিই ওকে, না মরে তো তখন আমি নিজেহাতে ওকে গুলি করে মারব, ১২তলা বাড়ির ছাদ থেকে ছুঁড়ে ফেলে দেব!

কিন্তু না। ৫০এর আগেই ঘটে গেল ঘটনাটা। না, না, এমনটা ভাবার কোনো কারণ নেই যে ওই মর্কট মরে শান্তি দিল আমায়। উল্টে আমার জীবনই আমায় শান্তি দিয়ে চলে গেল। অর্থাৎ আমি গেলুম মরে। না, না, আপনাদের ভয়ের কোনো কারণ নেই। আমার ট্র্যাজিক কাহিনী আপনাদের বলা ছাড়া এই নিরীহ ভূতের অন্য কোনো অভিসন্ধি নেই। এখন এই হতচ্ছাড়া শয়তানের ৫০ হলো, এখনো নট আউট, আর আমি কিনা টেবিলের উল্টোদিকের দেওয়ালে ফ্রেমবন্দী? দেখুন বলতে বলতেই শালা হারামজাদা কুঁই কুঁই করে বেজে উঠছে। আমার নাতি এসে হাতে নিলো রও একটা ফ্রি ইনকামিং কল  

1 কমেন্টস্:

  1. বাহ! সুন্দর ফ্ল্যাশ ফিকশন, যা প্রায় প্যারাবলের সীমানা ছুঁয়ে আছে।

    উত্তরমুছুন